পান্তাবুড়ি পান্তা খেতে ভালবাসত। ‘শুকনো লঙ্কা পোড়া, কাঁচা পেঁয়াজ আর নুন দিয়ে পান্তা খেয়ে বুড়ির কী আনন্দ।’ এই গরমে পান্তা ভাত খেয়ে অমন আনন্দ এই বাংলার অনেকেই উপভোগ করে থাকেন। কিন্তু এই ভাললাগাটা এদেশে ‘মার্জিনাল’। সনাতন বাঙালি রান্নার মেনুতে পান্তা ভাতের নাম ওঠে না কখনও। অথচ, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত, গরম ভাতের তুলনায় পান্তার উপকার বেশি। গ্রামবাংলার বড় একটা অংশ এই গরমে পান্তা ভাত খেয়ে কাজে বেরোয় নিত্য। এতে মাঠে-ঘাটে চড়া রোদে কাজ করতে সুবিধা হয় বলেই তাঁদের দাবি। পুষ্টিবিদরা সেই দাবি উড়িয়ে দিচ্ছেন না মোটে। পুষ্টিবিদ রেশমি রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘পান্তা ভাতের পুষ্টিগুণ বেশি। দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা থাকে। সবচেয়ে বড় কথা শরীর ঠান্ডা থাকে এই গরমে।’’ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ১০০ গ্রাম পান্তা ভাতে (১২ ঘণ্টা পর) ৭৩.৯১ মিলিগ্রাম আয়রন থাকে, গরম ভাতে সেখানে মাত্র ৩.৪ মিলিগ্রাম। এছাড়াও ১০০ গ্রাম পান্তাভাতে ৩০৩ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ৮৩৯ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম এবং ৮৫০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে। গরম ভাতে ক্যালসিয়াম মাত্র ২১ মিলিগ্রাম। প্রায় ১২ ঘণ্টা জলে ভিজে থাকায় স্বল্প অ্যালকোহলের উপস্থিতির জন্য পান্তা ভাত খেয়ে বেশ ঝিমুনি ভাব আসে।
পান্তা কী ভাবে বানায়?
গ্রামে রেওয়াজ, রাতে ভাত খাওয়ার পর অতিরিক্ততে জল ঢেলে দেওয়া। পুরোটা যেন জলের তলায় থাকে। তবে, খুব বেশি জল নয়। উপরে ঢাকনা। পরদিন সকালে তৈরি পান্তা। এর অনেক রকমফেরও আছে। যেমন, পান্তার ভাতটা একটু শক্ত ও অবিকৃত যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁরা রাতে ভাতটা একটু শক্ত অবস্থায় নামিয়ে নেন। জুড়িয়ে যাওয়ার পর (দু-তিন ঘণ্টার মধ্যে) জল ঢালেন।
অনেকে আবার ‘ফারমেন্টেশন’ একটু বেশি পছন্দ করেন। মানে ভাতটা একটু নরম হয়ে যাবে। এর জন্য রাতের ভাতটা একটু বেশি সিদ্ধ করতে পারলে ভাল। অল্প গরম থাকতে থাকতে জল ঢেলে দিতে হয়।
ইষৎ‘ টোকো’ স্বাদের করতে চান যাঁরা, তাঁরা গরম ভাতেই জল ঢেলে দেন আলাদা করে তুলে। এবার একটু নুন মিশিয়ে দিন। সামান্য গরম ফ্যান মিশিয়ে দিলে পরদিন ভাত টকে যাবে নিশ্চিত। কেউ কেউ সকালের ভাতে জল দিয়ে পরদিন খান। কেউ আরও একদিন রেখে দেন। তবে, বেশি ‘ফারমেন্টেশন’ ভাল নয়।
আসলে এক-এক জায়গায় পান্তার নাম এক, খেতে এক, বানানোর ধরন এক। ওড়িশায় যেটা পোখালা বলে, সেটা প্রথাগত ভাবে আগের দিনের রান্না করা ভাতকে জলে ভিজিয়ে রেখে পরদিন খাওয়া হয়। খাওয়ার আগে টক দই মিশিয়ে স্বাদটা একটু টক-টক করা হয়। এবার একটা পাত্রে সর্ষের তেল গরম করে শুকনো লঙ্কা, জিরে, সর্ষে, কারি পাতা নেড়ে পান্তা ভাতের উপর ফোড়ন দিলেই তৈরি পোখালা। আজকালকার দিনে অনেকে বাসি ভাত খাওয়া পছন্দ করেন না বলে সকালে ভাত রেঁধে সেটা ঠান্ডা করার পর জল ঢেলে পোখালা বানান। অসমে একে বলে পয়তা ভাত। ছত্তীসগড়ে বোরে ভাত। দক্ষিণ ভারতে নামগুলো একটু খটমটে হলেও বিষয়টা প্রায় এক। বাসি ভাত জলে ভেজানো। সকালবেলা সেই ভাতের জল ঝরিয়ে নুন, কাঁচা লঙ্কা আর নারকেল তেল ডলে খায় কোঙ্কন উপকূলে। পান্তার জলের সঙ্গে টক দই আর নুন মিশিয়ে আলাদা করে শরবতের মতো খাওয়ার চল রয়েছে দক্ষিণ ভারতে।
শুধু এপার আর ওপার বাংলাতেই যে কত রকমের পান্তা খাওয়া হয় তার হিসাব নেই। অধিকাংশ জায়গায় পান্তার সঙ্গে নুন-লঙ্কা আর পেঁয়াজ অতি অবশ্য থাকে। কেউ কাঁচা লঙ্কার বদলে শুকনো লঙ্কা তেলে মুচমুচে করে ভেজে মাখিয়ে নেন, কেউ পেঁয়াজ অল্প তেলে সামান্য ভেজে খেতে ভালবাসেন। এরপরেই যেটা আসে, সেটা হল গন্ধরাজ লেবু আর তার পাতা, আমের আচার। মুর্শিদাবাদের দিকে ছোলার ছাতু মেখে পান্তা খাওয়া হয়। ছোলার ছাতুর সঙ্গে কাঁচা সর্ষে তেল, কাঁচালঙ্কা আর পেঁয়াজ মেখে ঝুরো ঝুরো একটা চাট বানিয়ে পান্তার সঙ্গে খায় ওরা। চানাচুরের চাট বা ছোলা ভাজা দিয়েও চাট বানিয়ে খায় অনেকে। আগে অনেক জায়গায় পাকা আম বা কাঁঠাল দিয়ে পান্তা খাওয়া হত। রসগোল্লার রস মেখে পান্তাও খায় অনেকে। এমনকী পাটালি গুড় ভেঙে ভেঙে পান্তার সঙ্গে খায় এখনও। তবে, নুন মেশানো পান্তা ভাতের সঙ্গে মিষ্টির এই মাখামাখি আজকাল খুব একটা কেউ পছন্দ করেন না।
বরং পান্তার সঙ্গে যে চাটগুলো ভাল মাখে, তার মধ্যে একেবারে উপরের সারিতে রয়েছে আলুর ভর্তা বা আলু মাখা। সর্ষের তেলে শুকনো লঙ্কা আর পেঁয়াজ ভেজে সিদ্ধ আলুর সঙ্গে ভাল করে মেখে নিলেই তৈরি আলু ভর্তা। আলু ভাজাও খেতে ভাল লাগে পান্তার সঙ্গে। শুধু আলু কেন, পটল, চিচিঙ্গে, কুঁদরি—যে কোনও সব্জি ভাজা পান্তার সঙ্গে খাওয়া যায়।
কলকাতা ও শহরতলিতে ফুলুরি (পেঁয়াজি বা আলুর চপ হলেও চলবে) ভেঙে কাঁচা লঙ্কা আর পেঁয়াজ দিয়ে মেখে পান্তা খান অনেকে।
ওড়িশায় বড়ি-চূড়া দই পোখালার সঙ্গে জনপ্রিয়। দুই মেদিনীপুরেও বড়ি ভাজার চাট দিয়ে পান্তা খাওয়ার চল রয়েছে। এখানে বলে রাখি, বড়ি প্রচুর তেল টানে। তাই শুকনো কড়ায় কিছুটা নেড়ে তারপর অল্প অল্প তেল দিয়ে বাদামি করে ভেজে নিতে হয় বড়ি। আঁচ বেশি থাকলে পুড়ে যাবে। এবার চাট বানানোর জন্য বড়ি নামিয়ে ওই কড়াতেই একটু তেল দিয়ে শুকনো লঙ্কা ভেজে তুলুন। পেঁয়াজ সামান্য ভেজে নিন। একসঙ্গে লঙ্কা আর পেঁয়াজ ভাজলে কিন্তু লঙ্কা সেঁতিয়ে যাবে। এবার মুচমুচে বড়ি হাতে গুঁড়িয়ে তার সঙ্গে শুকনো লঙ্কা আর পেঁয়াজ মেখে নিন।
পোখালার সঙ্গে শাক ভাজা থাকে অতি অবশ্য। এর জন্য শুশনি শাক হল আদর্শ। শাক ভাল করে ধুয়ে কড়ায় তুলে ঢেকে রাখুন কিছুক্ষণ। জল বেরিয়ে শাক সিদ্ধ হয়ে যাবে আপনাআপনি। আলাদা করে জল দেবেন না। জল মরে শাক সিদ্ধ হয়ে এলে নামিয়ে নিন। এবার কড়ায় অল্প তেলে শুকনো লঙ্কা আর সর্ষে ফোড়ন দিন। সর্ষে ফাটতে শুরু করলে রসুন কুচি দিন। রসুন লাল হয়ে ভাজা হয়ে এলে একটু বেশি করে পেঁয়াজ দিয়ে ভেজে নিন। এবার সিদ্ধ শাক দিন। নুনটা এই সময় স্বাদ মতো দিলে ভাল। একদম শুরুতে সিদ্ধ করার সময় নুন দিলে মাপ বুঝতে না পেরে বেশি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিছুক্ষণ নেড়ে নামিয়ে নিন শাক ভাজা। একই ভাবে কলমি শাকও খাওয়া যায়। বেগুন ভর্তা গরম ভাতের সঙ্গে যেমন ভাল লাগে, তেমনই পান্তার সঙ্গে। বেগুনকে পুড়িয়ে কাঁচা লঙ্কা, কাঁচা তেল আর কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে মাখতে পারেন। কিন্তু ও হল বেগুন পোড়া। ভর্তা বানাতে আর একটু খাটনি আছে। কড়ায় তেল দিয়ে দারচিনি, লবঙ্গ ফোড়ন দিন। এবার পেঁয়াজ বাটা দিয়ে ভাল করে কষুন। আদা বাটা দিন। টোম্যাটো কুচি। তারপর বেগুন পোড়া দিন। ভাল করে নাড়তে হবে। নুন-চিনি স্বাদমতো। শুকনো হয়ে এলে নামিয়ে নিন। অনেকে আবার বেগুন ভেজে নেন প্রথমে। তারপর সেই ভাজা বেগুন কাঁচা পেঁয়াজ আর লঙ্কা দিয়ে মাখেন।
এই রাজ্যের উপকূলবর্তী এলাকাগুলোকে মাছ ভাজা দিয়ে পান্তা খাওয়া হয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় কুচো মাছ (বিশেষ করে মৌরলা) ভাজা। নুন-হলুদ মাখানো মৌরলা লাল করে সর্ষের তেলে ভাজতে হবে। কুচো চিংড়িকেও ভেজে পান্তার সঙ্গে খাওয়া যায়। পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা আর বড়ি ভাজার সঙ্গে মুচমুচে মাছ ভাজা গুঁড়ো করে যে চাট তৈরি হয়, তার তুলনা কিছুর সঙ্গে হয় না। বড় মাছের চাকাও ভাল করে ভেজে কাঁটা ছাড়িয়ে পেঁয়াজ, লঙ্কা, বড়ির সঙ্গে মেখে নিতে পারেন।
এছাড়া ডালের ভর্তা বা ডাল ফ্রাই দিয়ে পান্তা ভাল লাগে। রকমফের রয়েছে পদ্ধতির। যেমন মুসুর ডাল কাপড়ে পুঁটলি করে বেঁধে বা কৌটোর মধ্যে ভাতের হাঁড়িতে দিয়ে দিলে একসঙ্গে সিদ্ধ হয়ে যাবে। এমনিও মাপে-মাপে জল দিয়ে কম আঁচে ডাল সিদ্ধ করে নিতে পারেন শুকনো-শুকনো। এবার পেঁয়াজ, লঙ্কা দিয়ে মেখে নিতে হবে সিদ্ধ ডাল। আবার বাসি ডালকে কড়ায় শুকিয়ে ভর্তা বানানো যায়। ডালের বড়া ভেজে শুকনো লঙ্কা আর পেঁয়াজ ভাজা দিয়ে মাখলেও দারুন খেতে হয়।
রেসিপি ভিডিও: কচু বাটা
আর একটা সুস্বাদু চাট হয় পাঁপড় ভাজা দিয়ে। পাঁপড়কে তেলে ভেজে নিয়ে কুড়মুড়িয়ে ভেঙে নিন। এবার ভাজা পেঁয়াজ, বড়ি আর শুকনো লঙ্কার সঙ্গে ভাল করে মেখে নিতে হবে। পোস্ত বড়াও খুব ভাল। পোস্তকে ভাল করে মিক্সিতে বেটে নিন আঁট করে। মিক্সিতে শুকনো বাটতে অসুবিধা হলে শিলে বাটুন। একটু কাঁচালঙ্কা আর সামান্য সাদা সর্ষে মিশিয়ে দিলে ঝাঁঝ আসবে স্বাদে। এবার কাঁচা পিঁয়াজ দিয়ে মেখে বড়ার আকারে ফ্রাইং প্যানে ভেজে নিন। কাঁচা পোস্ত বাটা কাঁচা তেল, পেঁয়াজ, লঙ্কা দিয়ে মেখে খেতে বেশ।
শুশনি শাক, পান্তা, পোস্ত— লিখতে লিখতেই তো ঘুম চলে এল।