অধ্যাপক আবদুস সালাম।
বহু দিন মনে ছিল আশা, মানুষকে করে তুলব বিজ্ঞানমনস্ক। অবশ্যই সেটা এক মহৎ উদ্দেশ্য, কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক হলেই কি মন কুসংস্কার-মুক্ত হয়? বহু দিনের অভিজ্ঞতা বলছে, হয় না। বহু মানুষ, যাঁরা সারা জীবন বিজ্ঞান নিয়েই কাটিয়েছেন, বিজ্ঞান যাঁদের পেশা, তাঁদের মন কি সব সময়েই কুসংস্কার-মুক্ত হয়? তাঁদের অনেককেই কি তাবিজ, মাদুলি, আংটি ইত্যাদি পরতে দেখা যায় না? পণ্ডিতমশাইকে ডেকে, পঞ্জিকা ঘেঁটে শুভ দিন, শুভ তিথি ঠিক না করে ক’জনের সাহস আছে সন্তানের বিবাহের দিন-ক্ষণ ঠিক করার? বছর বছর বহু বিজ্ঞান জাঠার আয়োজন করেও কি এই প্রথার এতটুকু কোনও পরিবর্তন ঘটানো গিয়েছে? আমেরিকার মতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় উন্নত দেশেও কি সর্বত্র ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়াতে দেওয়া হচ্ছে? কেন হচ্ছে না?
আমার মতে, এর কারণ দু’টি। প্রথমত, আধুনিক বিজ্ঞান মূলত মানুষের মনস্তত্ত্ব অস্বীকার করেই গড়ে উঠেছে। আইনস্টাইন বলতেন, বিজ্ঞানের সূত্রগুলি তো বলে দেয় না মানুষ তাকে কী ভাবে ব্যবহার করবে। যেমন E=mc2। এই সূত্রে কি বলা আছে, “ইহা ব্যবহার করিয়া বোমা বানাইবে না?” মানুষ যে দিন আগুন আবিষ্কার করেছিল, সে দিন কি সে জানত যে, আগুন দিয়ে যেমন রান্না করা যায়, শীতের রাতে আরাম পাওয়া যায়, তেমনই আগুন দিয়ে শত্রুর ঘরও ধ্বংস করা যায়? আগুন কী ভাবে ব্যবহার করা হবে, আগুনের বিজ্ঞানে কি তার কোনও ইঙ্গিত আছে? নেই। তা হলে মানুষকে কে বলে দেয় আগুন কী ভাবে ব্যবহার করতে হবে? আইনস্টাইনের মতে, এই সমস্ত বিধান সুস্থ সমাজের রীতির মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত থাকে। সেটা হয় কী ভাবে? না, সমাজে কিছু মহাপুরুষের মাধ্যমেই এগুলি প্রকাশ পায়। যেমন হয়েছিল আমাদের দেশে মুনি-ঋষিদের মাধ্যমে, গৌতম বুদ্ধের মাধ্যমে, ইহুদিদের মধ্যে মোজ়েসের মাধ্যমে, পশ্চিম এশিয়ায় জিশু, জরাথ্রুস্ট ও মহম্মদের মাধ্যমে, চিনে কনফুসিয়াসের মাধ্যমে। মানুষের অন্তর্জগতে বিজ্ঞানের কোনও ভূমিকা নেই, অন্তত, আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক বিজ্ঞানের। একমাত্র বিশুদ্ধ বিজ্ঞানচর্চাই এই অন্তর্জগতের হদিশ দেয়। কিন্তু ক’জনই বা সেটা আস্বাদন করতে পারেন? এইখানেই আসছে দ্বিতীয় কারণটি। এই বিপুল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে মানুষ বড়ই একা ও অসহায়। এই বিশ্বজগতের যাবতীয় ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ কার্যকারণ সম্বন্ধ বিজ্ঞান দেখাতে অক্ষম। এক সময় মনে হয়েছিল, এটি সাময়িক সীমাবদ্ধতা। বিজ্ঞানের ক্রম-অগ্রসরের মধ্যে দিয়ে এই সীমা অতিক্রম করা যাবে। কিন্তু দেখা গেল, ঘটল ঠিক তার উল্টোটাই। আধুনিক বিজ্ঞান আবিষ্কার করল এই জটিল জগতের অবশ্যম্ভাবী অনির্দেশ্যতার (আনপ্রেডিক্টেবিলিটি) কথা। আরও জানা গিয়েছে, অণু-পরমাণুদের জগতে অনিবার্য অনিশ্চয়তার কথা (হাইজ়েনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি)। ব্যক্তি মানুষ এই সমস্ত অনির্দেশ্যতার শিকার। মানুষের জীবনে কখন যে কী ঘটে, বলা যায় না। সে অসহায়। সে এমন কিছুকে আঁকড়ে ধরতে চায়, বিশ্বাস করতে চায়, যা তাকে শান্তি দেবে, স্বস্তি দেবে। ধর্মের মধ্যে, আচারের মধ্যে সে সেই আশ্রয় পায়। বিজ্ঞান এই বিশ্বাস, এই শান্তি, এই আশ্রয় তাকে দিতে পারে না।
আমার বৃদ্ধা মায়ের কথা প্রায়ই ভাবি। আজ অন্তত সত্তর বছর ধরে দেখে আসছি মা গুরুদেব নিয়ে, পুজোআচ্চা নিয়ে শান্তিতে, খুশিতে থাকেন। তাঁকে কি আমি বিজ্ঞান বোঝাতে পারব? কখনওই না। যদি নাছোড়বান্দার মতো চেষ্টা করে যাই, তাতে মা’র অশান্তিই বাড়বে। তাঁর বিশ্বাস ভেঙে দিলে তাঁর মধ্যে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে, বিজ্ঞান কি তাকে পূরণ করতে পারবে? তা হলে তাঁর শান্তি কেড়ে নেওয়ার অধিকার কি আমার আছে?
এ বার বলি তিন জন জগৎ-বিখ্যাত বিজ্ঞানীর কথা। প্রথমে নোবেলজয়ী অধ্যাপক আবদুস সালাম। তাঁর শরীর যখন বেশ ভেঙে পড়েছে, চলতে অসুবিধা বোধ করেন, সেই সময়ে ইটালির ট্রিয়েস্ট শহরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিয়োরেটিক্যাল ফিজ়িক্স (আইসিটিপি)-এ গিয়েছিলাম, তাঁর সঙ্গে দেখাও হল। প্রকাণ্ড অফিসে একা বসে আছেন। পাকা দাড়িতে মুখ ঢেকে গিয়েছে। দুর্বল দৃষ্টি, আধধরা গলা। কথাবার্তার মাঝে হঠাৎ নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে হাসিমুখে বললেন, “আমি এখন হোমিয়োপ্যাথি চেষ্টা করছি। দেখো, নেচারে হোমিয়োপ্যাথির সপক্ষে প্রবন্ধ বেরিয়েছে।” আহাম্মকের মতো চাল মেরে সেটাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করলাম। বললাম, “অধ্যাপক সালাম, আপনিও শেষ পর্যন্ত এই সব কুসংস্কার মানছেন?” দেখলাম, হাসিটা হঠাৎ ম্লান হয়ে গেল। অসহায় দৃষ্টি ঘরের জানালার দিকে চলে গেল। বুঝলাম, কী মারাত্মক ভুলটাই না করেছি। অসহায় মৃত্যুপথযাত্রীর বিশ্বাস কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। তার পর থেকে যখনই এই ঘটনা মনে পড়ে, অনুতপ্ত হই, লজ্জা বোধ করি।
দ্বিতীয় জন বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু। এক দিন সকালে নানা আলোচনার মধ্যে হাত দেখার কথা উঠল। আমি বিজ্ঞের মতো এই সব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বলতে শুরু করলাম। কিছু ক্ষণ শোনার পর তিনি বললেন, “শোন, তোকে একটা ঘটনার কথা বলি। আমি যখন শিশু তখন আমার হাতের একটা রেখা দেখে এক জন জ্যোতিষী বলেছিলেন আমার লেখাপড়া বেশি দূর হবে না। তার পর, বুঝলি, ইউরোপ থেকে ফিরে আসার পরে ওয়ালটেয়রে পরীক্ষা নিতে গিয়েছি। সেখানে এক আড্ডায় জ্যোতিষের কথা উঠল। আমি বললাম যে, আমার হাতের একটা রেখা দেখে এক জ্যোতিষী বলেছিলেন আমার লেখাপড়া বেশি দূর হবে না। সবাই খুব হাসলেন, কিন্তু এক জন বললেন, ‘দেখি কোন রেখাটা’। আমি দেখালাম। উনি কিছু ক্ষণ গম্ভীর মুখে চুপ করে থেকে বললেন, ‘কিন্তু এই রেখার অর্থ তো সম্পূর্ণ অন্য!’ আমি জিজ্ঞেস করাতে তিনি কিন্তু কিন্তু করে বললেন, ‘এর অর্থ আপনার এক সদ্যোজাত সন্তানের অপমৃত্যু হবে। আমি তো শুনে অবাক। সুদূর ওয়ালটেয়রের এই সম্পূর্ণ অচেনা অজানা ভদ্রলোকের পক্ষে আমার পরিবার সম্বন্ধে এই তথ্য জানাই অসম্ভব। অথচ ঘটনা হচ্ছে, তার ঠিক কিছু দিন আগেই আমার এক সদ্যোজাত সন্তানকে কোলে নিয়ে প্রতিবেশী এক মহিলা খেলছিলেন। পাশেই গরম দুধ ফুটছিল। হঠাৎ সন্তানটি সেই ফুটন্ত দুধের মধ্যে পড়ে যায়, ও মারা যায়।’’ আমরা তো সকলে হতবাক। কিছু ক্ষণ চুপ করে থেকে বিজ্ঞানাচার্য আমার দিকে তাকিয়ে করুণ হেসে বললেন, “কী বলবি?”
সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
তৃতীয় জন নোবেলজয়ী নিলস্ বোর। তাঁর বাড়ির সামনের দরজার উপর একটি ঘোড়ার নাল ঝোলানো থাকত। ডেনমার্কের মানুষের বিশ্বাস যে, এই নাল গৃহে সৌভাগ্য এনে দেয়। কৌতূহলী এক জন তাঁকে জিজ্ঞেস করে, “আপনি এই কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন?” তিনি মুচকি হেসে বলেছিলেন, “শুনেছি বিশ্বাস না করলেও ওটা কাজ করে।”
সত্যান্বেষী, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক রবীন্দ্রনাথও তাঁর শেষ কবিতায় বলে গিয়েছেন—
‘‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে,/ হে ছলনাময়ী।/ মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে/ সরল জীবনে।’’
এই সত্যকে তাচ্ছিল্য করলে কি বিজ্ঞানের মহিমা বাড়বে?
লেখক প্রাক্তন অধ্যাপক, সত্যেন্দ্রনাথ বসু ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস