প্রতীকী ছবি।
কনফিউশন ওয়ার্স কনফাউন্ডেড। নাহ্, মাত্র তিন শব্দের ওই ইংরেজি প্রবাদ ছাড়া আর কিছুতে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না জ্যোতির্বিজ্ঞানে গত সপ্তাহে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে। যা বিরাট এক প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে পদার্থবিজ্ঞানীদের। বিজ্ঞানে সব ঠিকঠাক আছে তো? নাকি নতুন করে ভাবতে হবে আবার? আবিষ্কার করতে হবে এমন কিছু, যা এত দিন কল্পনাই করা যায়নি, যা দূর করবে এখনকার সব ধন্দ।
কনফিউশন একটা সংখ্যা নিয়ে। ওটা একটা মাপ। মাপটা আবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতই দামি যে, ওটা না-জানলে প্রায় কিছুই জানা হয় না ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বহু কাল ধরে ওই সংখ্যাটা কত, তা জানার জন্য মাথা খুঁড়ে মরছেন। জানতে তো পারছেনই না, উল্টে আবার উটকো বিপত্তি। নতুন পরীক্ষার ফলাফলে ওঁদের গালে হাত!
কোন সংখ্যা নিয়ে এই জটিলতা? ওটার পোশাকি নাম ‘হাব্ল কনস্ট্যান্ট’। নামের প্রথম অংশটা অবশ্যই আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুইন পাওয়েল হাব্ল থেকে। যাঁর মনে হয়েছিল, ওই সংখ্যাটা তিনি পেয়ে গিয়েছেন। আর দ্বিতীয় অংশটা বলে দিচ্ছে, সংখ্যাটা একটা ধ্রুবক। বদলাবে না। বদলাবে কোটি কোটি বছরে, কোনও এক যুগে নয়।
হাব্ল কনস্ট্যান্ট কী? সোজা কথায়, ব্রহ্মাণ্ডের আয়তনে বড় হওয়ার রেট। বিশ্ব তো লুচির মতো ফুলেফেঁপে বড় হচ্ছে ক্রমশ। তা ১ সেকেন্ডে কতটা বাড়ছে? উত্তরটাই হল হাব্ল কনস্ট্যান্ট। উত্তর পাওয়ার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন প্রায় ৯০ বছর ধরে। বিফল প্রয়াস। কী ভাবে, শোনা যাক।
আমাদের গল্প শুরু হবে প্রায় একশো বছর আগে, ১৯২০-র দশকে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের শৈশবকাল। আজকের মতো নানা দিকে অনুসন্ধান তখন কল্পনারও বাইরে। বিশ্বতত্ত্ব যেন ধর্মীয় কাজিয়া। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কি জন্মেছিল কোনও এক মুহূর্তে? নাকি তা অজর-অমর, কোনও জন্ম নেই তার, চির কাল ধরে টিকে আছে? এই দুই প্রশ্ন ঘিরে বিজ্ঞানীরা দ্বিধাবিভক্ত। এমনকি যে আলবার্ট আইনস্টাইন, যাঁর আবিষ্কার জেনারেল রিলেটিভিটি বলে দিল ব্রহ্মাণ্ড পরিবর্তনশীল, তিনিও এই প্রত্যয়ে দৃঢ় ছিলেন যে, ব্রহ্মাণ্ডের বদল হয় না। দৃঢ়তার প্রমাণ? নিজের আবিষ্কার জেনারেল রিলেটিভিটির ফর্মুলা পাল্টে দিলেন তিনি।
ব্রহ্মাণ্ড যে কোনও এক দিন জন্মেছিল, তা প্রমাণ হয়েছে বছর পঞ্চাশ আগে। কিন্তু মহাবিশ্ব যে স্থিতিশীল নয়, বিবর্তন হচ্ছে তার, ফুলেফেঁপে আয়তনে বাড়ছে সে, এমন ধারণার শুরু তারও পঞ্চাশ বছর আগে। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান অ্যাস্ট্রনমিক্যাল সোসাইটি-র সম্মেলনে আরিজ়োনা-য় লোয়েল অবজ়ারভেটরি-র জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভেস্টো মেলভিন স্লিফার প্রমাণ দাখিল করেন পরিবর্তনশীল বিশ্বের। দেখান, এক-একটা নক্ষত্রপুঞ্জ ক্রমশ দূরে— আরও দূরে— সরে যাচ্ছে।
আমাদের কাহিনিতে এ বার প্রবেশ করবেন হাব্ল। ক্যালিফর্নিয়ার প্যাসাডিনায় মাউন্ট উইলসন অবজ়ারভেটরির এই জ্যোতির্বিজ্ঞানী ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে এক পেপার লেখেন ‘অ্যাস্ট্রফিজিক্যাল জার্নাল’-এ, গ্যালাক্সিদের ঔজ্জ্বল্য এবং দূরত্ব ব্যাখ্যা করে। এর পর ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে সেই বিখ্যাত পেপার। ছাপা হল ‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’ জার্নালে। প্রতিপাদ্য এক সম্পর্ক। গ্যালাক্সিদের দূরত্ব এবং দূরে সরে যাওয়ার বেগের। হাব্ল দেখালেন, যে গ্যালাক্সি যত দূরে, তা পৃথিবী থেকে দূরে চলে যাচ্ছে তত বেশি বেগে। ধরা যাক, দুটো গ্যালাক্সি। একটা আমাদের থেকে ২৫ আলোকবর্ষ (১ সেকেন্ডে ৩০০,০০০ কিলোমিটার দৌড়ে আলো ১ বছরে যতটা দূরত্ব পাড়ি দেয়, তা ১ আলোকবর্ষ; মান ৯,৪৬০,৭৩০,৪৭২,৫৮১ কিলোমিটার) দূরে, আর অন্যটা ৫০ আলোকবর্ষ দূরে। তা হলে, প্রথম গ্যালাক্সি যদি ১ সেকেন্ডে ১০০ কিলোমিটার দূরে সরে যায়, তো দ্বিতীয়টা ১ সেকেন্ডে দূরে যাবে ২০০ কিলোমিটার)।
গ্যালাক্সি দূরে সরে যাচ্ছে মানে ব্রহ্মাণ্ড আয়তনে বাড়ছে। কারণ গ্যালাক্সিগুলো শূন্যস্থানের মধ্যে দূরে সরছে না, দূরে সরার ফলে নতুন শূন্যস্থান তৈরি হচ্ছে। সে বৃদ্ধির হার আবার ওই নিয়ম মেনে। যত দূরে, তত জোরে। নিয়মটা পরিচিত হয়ে যায় ‘হাব্ল ল’ নামে। ওই সূত্র আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার এক বড় ভিত। এখন নামবদল হয়েছে সূত্রটার। ওটা এখন ‘হাব্ল-লেমাইত্রে ল’। অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, ওই নিয়ম ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কার করেছিলেন আরও এক জন। তিনি হলেন বেলজিয়ান পাদ্রি জর্জ অঁরি জোসেফ এদোয়ার্দ লেমাইত্রে। তাই ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রনমিক্যাল ইউনিয়ন গত বছর ওদের অধিবেশনে ওই নামবদলের সিদ্ধান্ত নেয়।
যে নাম বদলায়নি, তা ওই ‘হাব্ল কনস্ট্যান্ট’। সূত্র অনুযায়ী, গ্যালাক্সির দূরে সরার বেগ তার দূরত্বের সঙ্গে সমানুপাতিক। তা হলে, কত দূরত্বে থাকলে তা কী বেগে সরবে (বেগ আর দূরত্বের ভাগফল), সেটা পাল্টাবে না। ওটাই ‘হাব্ল কনস্ট্যান্ট’। দূরত্বের ফ্যাক্টর বাদ দিয়ে বলা যায়, ওটা সরাসরি ব্রহ্মাণ্ড কী হারে সাইজ়ে বাড়ছে, সে খবর আমাদের দেয়। খবর জানা ভীষণ জরুরি। মহাবিশ্বের বর্তমান সাইজ় (গ্যালাক্সিরা কত দূর ছড়িয়েছে), বয়স (প্রসারণ বেগ বেশি হলে বয়স কম, বেগ কম হলে বয়স বেশি) কিংবা ভবিতব্য (বেগ বাড়ছে, না কমছে)— এ সব মহা প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে ওই হাব্ল কনস্ট্যান্টের মধ্যে। ওর নির্ভুল মান জানতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা উদ্গ্রীব তো হবেনই!
উদ্গ্রীব ছিলেন লেমাইত্রে কিংবা হাব্লও। দুজনে দু’রকম প্রসারণ বেগের কথা বলেছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানে দূরত্ব সব পেল্লায় বলে তা মাপা হয় মেগাপারসেক এককে। ১ মেগাপারসেক= ৩,২৬০,০০০ আলোকবর্ষ। লেমাইত্রে হিসেব কষেছিলেন, ব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণ বেগ প্রতি মেগাপারসেকে সেকেন্ডে ৬২৫ কিলোমিটার। হাব্লের মনে হয়েছিল, তা সেকেন্ডে ৫০০ কিলোমিটার। আজকের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানেন, ও সব মাপ হাস্যকর বেশি। তবে ওঁদের যুগের প্রযুক্তি দিয়ে এর চেয়ে বেশি নিখুঁত মাপে পৌঁছনো সম্ভব ছিল না।
লেমাইত্রে এবং হাব্ল প্রয়াত হলে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা হাব্ল কনস্ট্যান্ট মাপেন। হাব্ল-শিষ্য অ্যালান রেক্স স্যানডেজ় পরীক্ষা করে দেখেন, ওই মান প্রতি মেগাপারসেকে সেকেন্ডে ৫০ কিলোমিটার। অন্য দিকে, জেরার্দ দ্য ভাকুলেয়ার্স তাঁর পরীক্ষায় পান ওই মান হল সেকেন্ডে ১০০ কিলোমিটার। একটা আর একটার অর্ধেক! এত তারতম্য কি মানা যায়? ও দুই মাপের গড় কষলেও ঝামেলা। মহাবিশ্বের বয়স দাঁড়ায় তা হলে কোনও কোনও নক্ষত্রের চেয়ে কম! এ তো বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি-র মতো ব্যাপার। গেরো কাটাতে ১৯৯০ সালে মহাশূন্যে পাঠানো হল হাব্ল স্পেস টেলিস্কোপ। উন্নত পরীক্ষা করে গোলমাল মেটাতে। মিটল না।
হাব্ল স্পেস টেলিস্কোপে সংগৃহীত তথ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন দুজন। ইলিনয়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ওয়েন্ডি লরেল ফ্রিডম্যান এবং বালটিমোরে জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের নোবেলজয়ী অধ্যাপক অ্যাডাম গাই রিস। ফ্রিডম্যানের গবেষণায় হাব্ল কনস্ট্যান্ট ধরা পড়েছে ৭২, রিসের গবেষণায় ৭৪। ও দিকে আবার কিছু বিজ্ঞানী গবেষণা করেছেন ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি-র তরফে মহাশূন্যে পাঠানো প্লাংক কৃত্রিম উপগ্রহ নিয়ে। বিগ ব্যাং বা মহা বিস্ফোরণে এই ব্রহ্মাণ্ডের জন্মের পর পদার্থ এবং এনার্জি যে ভাবে চার দিকে ছড়িয়েছে, তা বিশ্লেষণ প্লাংক-এর দায়িত্ব। তার তথ্য থেকে ওই বিজ্ঞানীরা হাব্ল কনস্ট্যান্ট পেয়েছেন ৬৭.৮। কোন মানটা ঠিক?
নির্ধারণ করতে নেমেছিলেন ফ্রিডম্যান। পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করেছেন ১৬ জুলাই। হাব্ল কনস্ট্যান্ট গণনায় লাগে দুটো জিনিস। কোনও গ্যালাক্সি কত বেগে সরছে, আর তার দূরত্ব। বেগ গণনা অত কঠিন নয়। যে কায়দায় ট্রেন স্টেশন থেকে দূরে গেলে তার হুইসলের আওয়াজ কমে যায়, সে কৌশল প্রয়োগে গ্যালাক্সি কত বেগে সরছে, তা জানা যায়। কঠিন কাজ গ্যালাক্সির দূরত্ব নির্ণয়। এ ক্ষেত্রে ভরসা নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্য। তাতে আবার সমস্যা। তারা দূরের, কিন্তু নিজস্ব ঔজ্জ্বল্য বেশি বলে মনে হবে বুঝি তা কাছের। বিভ্রম এড়াতে এত দিন যে নক্ষত্র দেখা হত, তাদের নাম সেফিড। এদের নিজস্ব ঔজ্জ্বল্য কতটা, তা গণনা করা যায়। সেফিডে কাজ হয়নি, তাই ফ্রিডম্যান এ বার গণনা করেছেন রেড জায়েন্ট নক্ষত্র নিয়ে। এ রকম তারার ঔজ্জ্বল্য লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বাড়তে বাড়তে হঠাৎ এক সময় কমে যায়। ফ্রিডম্যান এ রকম তারার সাহায্যে গ্যালাক্সিদের দূরত্ব মেপেছেন। এতে ওঁর গণনায় হাব্ল কনস্ট্যান্টের মান দাঁড়িয়েছে ৬৯.৮। অর্থাৎ, ৬৭.৮-এর বেশি, কিন্তু ৭৪-এর কম।
সুতরাং, ধন্দ বাড়ল বই কমল না। তবে কি পরীক্ষায় গোলমালের মূলে কোনও কিছু? সেই ‘কিছু’টা আসলে কী? মহাবিশ্বে উপস্থিত অজানা কণা? পরিব্যাপ্ত নতুন কোনও ফোর্স? ‘মৌলিক পদার্থবিদ্যা এখন সরু সুতোয় ঝুলছে’, মন্তব্য করেছেন ফ্রিডম্যান।