প্রাণের আশার আলো দেখানো সেই ভিন গ্রহ ‘কে২-১৮বি’। ছবি- নাসার সৌজন্যে
কেটলিতে টগবগ করে জল ফোটার সময় তার মুখ দিয়ে যেমন ধোঁয়া বেরিয়ে আসে, তেমনই একটি ভিন গ্রহের বায়ুমণ্ডল থেকে জলীয় বাষ্পের ধোঁয়া বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। বোঝা গেল, জলে ভেসে যাচ্ছে সেই ভিন গ্রহ। দেখা গেল, সেই গ্রহটি রয়েছে তার তারামণ্ডলের হ্যাবিটেব্ল জোনে। যেখানে থাকলে প্রাণের অস্তিত্বের জোরালো সম্ভাবনা থাকে। এমন ভিন গ্রহের হদিশ মিলল এই প্রথম।
আমাদের সৌরমণ্ডল থেকে ১১০ আলোকবর্ষ দূরের সেই ভিন মুলুকের ভিন গ্রহটি তার নক্ষত্র থেকে রয়েছে সেই দূরত্বে, যেখানে থাকলে গনগনে তাপে জ্বলা তারাটি পুরোপুরি জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে দিতে পারে না তার গ্রহটিকে। অক্ষত থাকে সেই ভিন গ্রহের বায়ুমণ্ডল। আর সেই পাথুরে গ্রহটির পিঠেও বয়ে যেতে পারে তরল জলের ধারা।
গ্রহটির নাম- ‘কে২-১৮বি’। ১১০ আলোকবর্ষ দূরে, ‘লিও’ নক্ষত্রপুঞ্জে সেই ভিন গ্রহটি রয়েছে যে তারামণ্ডলে, সেখানে রয়েছে আরও একটি গ্রহ। ‘কে২-১৮এ’।
রয়েছে জল, হাইড্রোজেন, হিলিয়াম গ্যাসও
মহাকাশে থাকা ‘হাবল স্পেস টেলিস্কোপ’ ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ওই তারামণ্ডল ও সেখানকার দু’টি ভিন গ্রহের যে সব ছবি ও তথ্যাদি পাঠিয়েছিল। সেই সব তথ্য বিশ্লেষণ করে ‘কে২-১৮বি’ গ্রহটি থেকে জলীয় বাষ্প বেরিয়ে আসার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পেরেছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ‘সেন্টার ফর স্পেস এক্সোকেমিস্ট্রি ডেটা’র জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসের স্বাক্ষরও মিলেছে বলে গবেষকদের দাবি।
ভিন গ্রহ ‘কে২-১৮বি’: কী, কেমন? দেখুন নাসার ভিডিয়ো
তাঁদের গবেষণাপত্রটি গত ১০ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার অ্যাস্ট্রোনমি’তে। ‘কে২-১৮বি’ ভিন গ্রহটি নাসার কেপলার স্পেস টেলিস্কোপের চোখেই প্রথম ধরা পড়েছিল চার বছর আগে। ২০১৫-য়।
সেই গ্রহের পিঠেও বইতে পারে জলের ধারা!
গবেষকরা জানিয়েছেন, সেই ভিন গ্রহে যে শুধুই বায়ুমণ্ডল আর জলীয় বাষ্পের অস্তিত্বের স্বাক্ষর মিলেছে, তা-ই নয়; ‘কে২-১৮বি’ গ্রহটি তার নক্ষত্রটি থেকে যে দূরত্বে রয়েছে, তাকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, ‘গোল্ডিলক্স জোন’ বা ‘হ্যাবিটেব্ল জোন’। এটাই সেই গ্রহে প্রাণের সম্ভাবনা সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের আশাকে জোরালো করে তুলেছে। কঠিন (বরফ), তরল ও গ্যাস (জলীয় বাষ্প)- হ্যাবিটেব্ল জোনে জলকে থাকতে হবে তিনটি অবস্থাতেই।
কোনও তারামণ্ডলে কোনও গ্রহ তার নক্ষত্রটি থেকে দূরত্বের নিরিখে গোল্ডিলক্স বা হ্যাবিটেব্ল জোনে থাকলে তার তাপমাত্রা এমন হতে পারে যাতে সেই পাথুরে গ্রহটির পিঠেও তরল জলের ধারা বইতে পারে অনায়াসে। ভিন গ্রহটিতে তরল জল, বায়ুমণ্ডল রয়েছে আর সেটি রয়েছে ‘বাসযোগ্য এলাকা’য়, এর আগে এমনটি আর বিজ্ঞানীদের নজরে পড়েনি।
আরও পড়ুন- একটা সাফল্যের পিছনে অজস্র ব্যর্থতা! বিজ্ঞানের ইতিহাসই তো ইসরোর সম্বল
তাই জলীয় বাষ্প বেরিয়ে আসার এই অভিনব আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের কৌতূহলী করে তুলেছে, কে-২-১৮বি গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনায়। গত শতাব্দীর নয়ের দশক থেকে আজ পর্যন্ত ২৭/২৮ বছরে প্রায় চার হাজার ভিন গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে। এর আগে কোনও ভিন গ্রহেই একই সঙ্গে তরল জল ও বায়ুমণ্ডলের উপস্থিতি আর সেই গ্রহটিকে তার নক্ষত্রমণ্ডলের হ্যাবিটেব্ল জোনে থাকতে দেখা যায়নি।
সেই ভিন গ্রহে রয়েছে প্রাণও?
তবে সেই ভিন মুলুকের ভিন গ্রহে প্রাণের হদিশ পেতে গেলে আরও অনেকটা পথ পেরতে হবে, মনে করছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির (জেপিএল) ‘ইউরোপা (বৃহস্পতির চাঁদ) মিশন’-এর টিম লিডার বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ গৌতম চট্টোপাধ্যায় আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘‘ভিন গ্রহে একই সঙ্গে তরল জল ও বায়ুমণ্ডলের অস্তিত্বের কথা এই প্রথম জানা গেল। এও জানা গেল, সেই গ্রহ রয়েছে হ্যাবিটেব্ল জোনে। যা এর আগে আবিষ্কৃত প্রায় চার হাজার ভিন গ্রহে দেখা যায়নি। এটা অবশ্যই অভিনব। তবে এখনই কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনোটা সঠিক হবে না। কারণ, ওই ভিন গ্রহটি যে তারাটিকে প্রদক্ষিণ করছে, তা একটি ‘রেড ডোয়ার্ফ স্টার’। মৃত্যুদশায় পৌঁছনোর সময় কোনও তারা যে অবস্থায় এসে পৌঁছয়। তার রংটা হয়ে যায় লাল। আর তা চেহারায় ছোট হতে থাকে বলে তাকে বলা হয় ‘ডোয়ার্ফ’ বা ‘বামন’। ওই সময় তারাগুলি থেকে বেরিয়ে আসে মারাত্মক সব বিকিরণ। যা সেই তারামণ্ডলের হ্যাবিটেব্ল জোনে থাকা ভিন গ্রহটিতে প্রাণের টিঁকে থাকার পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে ওঠে।’’
খুব শীঘ্রই মহাকাশে রওনা হচ্ছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি)। যা হাব্ল বা কেপলারের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। গৌতমের আশা, ওই টেলিস্কোপ আগামী দিনে ‘কে২-১৮বি’ ভিন গ্রহটির গঠন, বায়ুমণ্ডল আর তা থেকে কী হারে কতটা পরিমাণে জলীয় বাষ্প বেরিয়ে আসছে, সেই সব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি দিতে পারবে।
চেহারায় পৃথিবীর ৮ গুণ!
তবে চেহারা ও ভরের নিরিখে সেই ভিন গ্রহটি পৃথিবীর চেয়ে অনেকটাই বড়। এই ধরনের ভিন গ্রহগুলিকে বলা হয়, ‘সুপার আর্থ’। গ্রহটি আকারে পৃথিবীর আট গুণ। ভর কতটা হতে পারে? গবেষকরা জানাচ্ছেন, পৃথিবী ও নেপচুনের ভরের মাঝামাঝি। এত বড় চেহারা ও ভারী গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ বল (সারফেস গ্র্যাভিটি) খুবই জোরালো হয়।
গবেষকরা তাঁদের গবেষণাপত্রে জানিয়েছেন, ‘কে২-১৮বি’ ভিন গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে থাকতে পারে নাইট্রোজেন ও মিথেন গ্যাসও।
সেই গ্রহেও মেঘ জমে আকাশে...
কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)’-এর অধিকর্তা বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘জলীয় বাষ্প যখন বেরিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে, তখন সেই গ্রহের বায়ুমণ্ডলে যে মেঘেরও জন্ম হয়, তা নিশ্চিত। ফলে, সেই মেঘের পরিমাণ কতটা আর সেই গ্রহের বায়ুমণ্ডলে কোথায় কোথায় মেঘের ঘনত্ব কতটা, তা এ বার মেপে দেখতে হবে। সেই গ্রহের বায়ুমণ্ডলে শতাংশের হিসাবে কতটা জলীয় বাষ্প রয়েছে, সেটাও জানা দরকার। তাই এই গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’’
ভিন গ্রহটির তাপমাত্রাও পৃথিবীর গড় তাপমাত্রার মতোই!
সন্দীপ অবশ্য ওই ভিন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের হদিশ পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। তাঁর বক্তব্য, গ্রহটি যে তারাটিকে প্রদক্ষিণ করছে, সেটি একটি রেড ডোয়ার্ফ। তার মানে, আমাদের সূর্য থেকে প্রতি মুহূর্তে যে তাপমাত্রার জন্ম হচ্ছে, ওই রেড ডোয়ার্ফ থেকে হচ্ছে তার তিন ভাগের এক ভাগ। ভিন গ্রহটির পিঠের গড় তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেখানে পৃথিবীর পিঠের গড় তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গ্রহটি তার নক্ষত্রের খুবই কাছে রয়েছে। ফলে, নক্ষত্রটিকে এক বার প্রদক্ষিণ করতে সময় নেয় মাত্র এক মাস। তবে তারাটি যেহেতু রেড ডোয়ার্ফ, তাই দেখা গিয়েছে, সূর্য থেকে প্রতি বর্গ মিটারে (প্রায় ১৪০০ ওয়াট) যতটা তাপশক্তি এসে পড়ে পৃথিবীর গায়ে, প্রায় ততটা তাপশক্তিই তার নক্ষত্র থেকে এসে পড়েছে ভিন গ্রহটির গায়ে। সন্দীপের প্রশ্ন, ‘‘আমরা যদি সেই তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারি, তা হলে সেই গ্রহে প্রাণের টিঁকে থাকতে অসুবিধাটা কোথায়?’’
আরও পড়ুন- চাঁদে নামার দিন বাছাইয়েই বোধহয় ভুল করল ইসরো, তবে আশা এখনও শেষ হয়ে যায়নি
তবে দেখতে হবে, সেই গ্রহেও বিভিন্ন ঋতু আসে কি না। তা হলে বুঝতে হবে তার বায়ুমণ্ডলেও মেঘের ঘনত্বের কমা-বাড়া হয়, সময়ের নিরিখে। সেখানে সব কিছু থেমে নেই। একটি সক্রিয়তা রয়েছে।
‘কে২-১৮বি’ ভিন গ্রহ সম্পর্কে হাব্ল স্পেস টেলিস্কোপের পাঠানো তথ্যাদি খতিয়ে দেখে আর এক দল গবেষকের একটি গবেষণাপত্র শীঘ্রই প্রকাশিত হতে চলেছে আর একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল জার্নাল’-এ। বিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ সেই গবেষণাপত্রের অপেক্ষায়, নতুন তথ্যাদি পাওয়ার আশায়।
প্রাণের জন্ম, টিঁকে থাকার জন্য আরও অনেক শর্ত পূরণের প্রয়োজন: দীপঙ্কর
তবে ভিন গ্রহটিতে প্রাণের সম্ভাবনা জোরালো হয়ে ওঠার জন্য আরও পথ হাঁটতে হবে বলে মনে করেন পুণের ‘ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আয়ুকা)’-এর অধ্যাপক, ইসরোর গর্বের উপগ্রহ ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’ প্রকল্পের সায়েন্স অপারেশনস বিভাগের প্রধান দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।
দীপঙ্করের বক্তব্য, ‘‘জলীয় বাষ্প বা জলভরা মেঘ মানেই সেই গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে, তা বলা যায় না। প্রাণের জন্ম ও টিঁকে থাকার জন্য আরও অনেকগুলি শর্ত পূরণের প্রয়োজন হয়। এমনকি, তার জন্য ঠিক ক’টি শর্ত রয়েছে, সে ব্যাপারেও যে আমাদের ধারণা রয়েছে, তা-ও নয়। প্রাণের অস্তিত্বের খোঁজ করার কাজটা শুরু হবে হবে তার পর।’’
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা