সেই লেজকাটা ধূমকেতু।
তারা সব লক্ষ্মীছাড়ার দল!
তারা সব আগল-পাগল তুর্কি নাচার কল!
তারা সব ‘শিবঠাকুরের আপন দেশে’ লুকিয়ে থাকা ভুবনডাঙার দল!
৮৬০ বছর পর ‘শীতঘুম’ ভেঙে যে ছুটে আসছে সূর্যের টানে। মঙ্গলের চৌকাঠ ছুঁয়ে সূর্যকে পাক মেরে যে ফিরে যাবে এই সৌরমণ্ডলের একেবারে শেষ প্রান্তে থাকা বরফ-রাজ্য ‘উরট্ ক্লাউড’-এর সুবিশাল সাম্রাজ্যে।
শরীরটা তার আপাদমস্তক পাথুরে হলে হবে কি, ‘মন’টা তার আগাপাশতলা উড়নচণ্ডী! চেহারায় সে গ্রহাণু (অ্যাস্টারয়েড) আর চরিত্রে- ধুমকেতু (কামেট)।
আবার আচার-আচরণটা তার ধূমকেতুর মতো হলেও, ‘শিবঠাকুরের আপন দেশে’ লুকিয়ে থাকা অন্য উড়নচণ্ডী ধূমকেতুগুলোর মতো চেহারাটা পায়নি সে। পুরোটাই পাথুরে (রকি) তার শরীর। পায়নি সে বরফ এক কণাও, অন্য অন্য ধূমকেতুর মতো।
সে আরও কেন হতভাগ্য, জানেন?
আরও পড়ুন- গ্রহের রং বেছে এ বার প্রাণ খুঁজবেন বিজ্ঞানীরা!
লেজকাটা বলে। তার কোনও লেজ নেই বলে। তার শরীরে যদি বরফ থাকত কিছু, তা হলে ‘শীতঘুম’ ভেঙে বরফ-রাজ্য থেকে সূর্যের টানে আমাদের এই তারাটির দিকে ধেয়ে আসার সময় সেটা তার লেজ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু সেই সৌভাগ্য থেকে তাকে বঞ্চিত করেছেন খোদ ‘শিবঠাকুর’ই (ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি-রহস্য)। তাই তাকে ৪৬০ কোটি বছর ধরে মুখ লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে আমাদের সৌরমণ্ডলের একেবারে শেষ প্রান্তে থাকা বরফ-রাজ্যে।
সেই লেজকাটা ধূমকেতু।
এই লেজকাটা ধূমকেতুটির নাম- C/2014-S3 (PanStarrs)। একে আবিষ্কার করা হয়েছিল ২০১৪-য়। এত দিন পর তার পৃথিবীর কাছে আসার খবরটি ছাপা হয়েছে বিজ্ঞান জার্নাল ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’-এ। মূল গবেষক ইউনিভার্সিটি অফ হাওয়াইজ’ ইনস্টিটিউটের জ্যোতির্বিজ্ঞানী কারেন মিখ জানিয়েছেন, সৌরমণ্ডলে পৃথিবীর জন্মের সময়েই এর জন্ম হয়েছিল। সৌরমণ্ডলের ভেতরের দিকে (ইনার সোলার সিস্টেম)। তাঁর গবেষণাপত্রটির শিরোনাম- ‘ইনার সোলার সিস্টেম মেটিরিয়াল ডিসকভারড ইন দ্য উরট্ ক্লাউড’।
কী বলছেন মূল গবেষক কেরেন মিখ?
তাঁর গবেষণাপত্রে মিখ যা জানিয়েছেন, তার মূল নির্যাস- খেদ-ক্ষোভ কিছু কম নয় এই লেজকাটা ধূমকেতুটির। পৃথিবীর জন্মের সময় এই সৌর সংসার থেকে কার্যত, সে গুপ্তধন চুরি করে পালিয়েই গিয়েছিল! সেই সুদূরতম অতীতে, ৪৬০ কোটি বছর আগে। তখন আমাদের সৌরমণ্ডলে ঘন, জমাট, অগ্নিগর্ভ গ্যাসের মেঘ থেকে শরীর গড়ে উঠছে আমাদের সূর্যের। গড়ে উঠছে বৃহস্পতির মতো এই সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে বড় গ্রহ। শরীর গড়ে উটছে শনির। নেপচুন, ইউরেনাসের। বিশাল আলোড়ন চলছিল তখন আমাদের ‘মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি’তে। ঘন, জমাট, অগ্নিগর্ভ গ্যাসের মেঘে। আমাদের সৌরমণ্ডলের জন্মের সময়। অনেকটা সেই সমুদ্র-মন্থনের মতো। আর সেই ‘মন্থন’ থেকে যেমন অমৃত উঠে এসেছিল, তেমনই আমাদের গ্যালাক্সিতে ওই আলোড়ন থেকেই জন্ম হয়েছিল সূর্যের। এই সৌরমণ্ডলের বড় বড় গ্রহের।
২০১৪-য় যখন প্রথম দেখা মিলেছিল লেজকাটা ধূমকেতুর।
‘শিবঠাকুরে’র সেই উদ্দাম নাচে তোলপাড় এই সৌরমণ্ডলে যখন সৃষ্টির তাড়নায় আলোড়িত হচ্ছে ঘন, জমাট, অগ্নিগর্ভ গ্যাসের মেঘ, তখনই সেখান থেকে ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে আসছিল যেমন বৃহস্পতি, শনির মতো বড় বড় গ্রহগুলো, তেমনই ফুলকির মতো ছিটকে ছড়িয়ে পড়ছিল এই লেজকাটা ধূমকেতুর মতো পাথুরে খুব ছোট ছোট (বড় জোর এক থেকে দশ কিলোমিটার) গ্রহাণুগুলো। সদ্য গড়ে ওঠা সূর্যের শরীরে তখন প্রচণ্ড খিদে। যাকে পারছে, তাকেই গিলতে চাইছে। গিলেও নিচ্ছে। বৃহস্পতি, শনির মতো বড় গ্রহগুলোকেও যে গিলে খাওয়ার চেষ্টা করেনি সূর্য, এমনটা ভাবলে ভুল হবে। চেষ্টা করেছিল, পারেনি। বড় গ্রহগুলোর ‘জাত্যভিমান’ (জোরালো অভিকর্ষ বল) থাকায়। কিন্তু লেজকাটা ধূমকেতুর মতো ছোট ছোট গ্রহাণুগুলোর সে উপায় ছিল না। তখন সূর্যের গ্রাস থেকে বাঁচার জন্য তাদের হাতে একটাই অস্ত্র ছিল। কৌণিক ভরবেগ (অ্যাঙ্গুলার মোমেন্টাম)। যে বেগই তাদের ছিটকে বের করে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল সৌরমণ্ডলের একেবারে শেষ প্রান্তে, বরফ-রাজ্য উরট্ ক্লাউডে। সূর্যের গ্রাসে চলে যাওয়ার চেয়ে উরট্ ক্লাউডে কোটি কোটি বছর ধরে শীতঘুমে গা-ঢাকা দিয়ে থাকাটাকেই শ্রেয় বলে মনে করেছিল লেজকাটা ধূমকেতুর মতো গ্রহাণুগুলো।
এই লেজকাটা ধূমকেতু সম্পর্কে কী বলছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা?
কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)-এর অধিকর্তা, বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘এর গোটা শরীরটাই পাথুরে। অনেকটা গ্রহাণুর মতো। তবে পুরোপুরি গ্রহাণু নয়। কৌণিক ভরবেগের জন্য তাকে ছিটকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল অনেক দূরে, উরট্ ক্লাউডে। বা, বলা ভাল- বুধ, মঙ্গল, পৃথিবীর মতো ছোট ছোট পাথুরে গ্রহগুলো যখন একের পর এক গড়ে উঠছে, তখন সেই এলাকা থেকেই এই লেজকাটা ধূমকেতুর মতো ছোট ছোট পাথুরে মহাজাগতিক বস্তুগুলো বহু গুপ্তধন নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল সৌরমণ্ডলের একেবারে শেষ প্রান্তে, বরফ-রাজ্যে। গুপ্তধন বলতে, পৃথিবীর মতো পাথুরে গ্রহগুলো তৈরি হওয়ার সময় সোনা, প্ল্যাটিনামের মতো বহু মূল্যবান যে ধাতুগুলোর সৃষ্টি হচ্ছিল, তাদেরই একটি বড় অংশ নিয়ে একেবারেই স্মাগলারের মতো পালিয়ে গিয়েছিল এই লেজকাটা ধূমকেতুগুলোর মতো উড়নচণ্ডী মহাজাগতিক বস্তুরা। এদের কক্ষপথ ধূমকেতুর মতো হলেও, বিন্দুমাত্র বরফ নেই বলে তার লেজও গজাতে পারেনি। লেজকাটা ধূমকেতু হয়েই থাকতে হচ্ছে তাকে। এই গ্রহাণুগুলো অবশ্য মঙ্গল আর বৃহস্পতির মধ্যে থাকা গ্রহাণুপুঞ্জের (অ্যাস্টারয়েড বেল্ট) অন্য গ্রহাণুগুলোর মতো নয়। গ্রহাণুপুঞ্জের সবক’টি গ্রহাণুকেই সূর্যের তাপ সইতে হয়, হচ্ছে। তা আমাদের তারাটির কাছে রয়েছে বলে। কিন্তু এই লেজকাটা ধূমকেতুর মতো গ্রহাণুগুলো সৌরমণ্ডলের একেবারে শেষ প্রান্তে থাকে বলে তারা সূর্যের তাপ একরকম পায়নি বললেই চলে। তাই এগুলোকে বলে ‘আনকুক্ড’ বা ‘আনবেক্ড’। এমন গ্রহাণুর হদিশ মিলল এই প্রথম। লেজকাটা এই ধূমকেতুগুলোকে বলা হয়, ‘ম্যাঙ্কস্ কামেট্স’। সম্ভবত, আমাদের সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র ‘আলফা সেনটাওরি’র টানে বা অন্য কোনও কারণে হালে সে তার কৌণিক ভরবেগ কিছুটা খুইয়েছে। তাই সে কোটি কোটি বছর পর ছুটে আসছে সূর্যমুখী হয়ে। দ্বিচারিতা এর ছত্রে ছত্রে। যে ধরনের আলো এদের পিঠ থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখে বলা যায়, এগুলো ‘S’ টাইপের গ্রহাণু। যেমন গ্রহাণু রয়েছে মঙ্গল আর বৃহস্পতির মধ্যে থাকা গ্রহাণুপুঞ্জে। বিশাল একটা এলাকা জুড়ে রয়েছে ‘উরট্ ক্লাউড’। যা শুরু হয়েছে পৃথিবী থেকে ৫০ হাজার অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট দূরত্ব থেকে। আর যা ছড়ানো রয়েছে ২ লক্ষ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট দূরত্ব পর্যন্ত। এর মধ্যে এমন হাজার কোটি মহাজাগতিক বস্তু রয়েছে। তবে এর কক্ষপথ মঙ্গল গ্রহ পর্যন্ত। তাই মঙ্গল ছাড়িয়ে তার পৃথিবী পর্যন্ত আসার কোনও সম্ভাবনা নেই।’’
লেজকাটা ধূমকেতু- দেখুন ভিডিও।
মুম্বইয়ের ‘টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’ (টিআইএফআর)-এর পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক শুভব্রত মজুমদার বলেছেন, ‘‘যখন আমাদের সৌরমণ্ডল তৈরি হচ্ছিল, তখন অত্যন্ত ঘন, জমাট, অগ্নিগর্ভ একটা গ্যাসের মেঘ তৈরি হয়েছিল। সূর্য তৈরি হওয়ার পর ওই মেঘ তার চার পাশে একটা চাকতি (ডিস্ক) তৈরি করেছিল। সেখান থেকেই বিভিন্ন গ্রহের জন্ম হয়। সেই সময়েই কৌণিক ভরবেগের জন্য একেবারে সৌরমণ্ডলের শেষ প্রান্তে ছিটকে গিয়েছিল এই লেজকাটা ধূমকেতুর মতো কোটি কোটি গ্রহাণু। এগুলোর চেহারাটা বড়জোর এক কিলোমিটার থেকে দশ কিলোমিটার পর্যন্ত। এদের কক্ষপথটা অনেকটা চুরুটের মতো।’’
কেন এই লেজকাটা ধূমকেতু সম্পর্কে এতটা উৎসাহ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের?
কারণ, তাঁরা মনে করেন, পৃথিবী সৃষ্টির সময়েই এই ধরনের পাথুরে গ্রহাণুগুলো তৈরি হয়েছিল বলে প্রাণ সৃষ্টির সহায়ক জৈব অণুগুলো থাকতে পারে এদের শরীরে। আর যেহেতু কয়েকশো কোটি বছর ধরে এই লেজকাটা ধূমকেতু ‘উরট্ ক্লাউডে’র বরফ-রাজ্যে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে, তাই সেই জৈব অণুগুলো সূর্যের তাপে এখনও নষ্ট হয়ে যায়নি।
কোন কোন জৈব অণুর হদিশ মিলতে পারে লেজকাটা ধূমকেতুতে?
সন্দীপবাবু জানাচ্ছেন, ‘‘অ্যামাইনো অ্যাসিড, প্রোটিন, রাইবোজ, অ্যালডিহাইড, অ্যাডেনাইন, গুয়ামিন, সাইটোসিন আর গ্লাইসিনের মতো জৈব অণুগুলো মিলতেই পারে এদের শরীরে। পৃথিবী সৃষ্টির সময়ে ওই সব গুপ্তধন নিয়েই তারা ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল উরট্ ক্লাউডের জমাট বাঁধা বরফ-রাজ্যে। সেই স্মাগলারই আবার ফিরে আসছে।’’
আর শুভব্রতবাবু বলছেন, ‘‘এই লেজকাটা ধূমকেতুর মতো যদি আরও কয়েকটার হদিশ মেলে, তা হলে সৌরমণ্ডল সৃষ্টির বিভিন্ন মডেল যাচাই করে নেওয়াটা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে। তাই এই লেজকাটা ধূমকেতুটিকে নিয়ে এতটা উৎসাহ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের।’’
লেজকাটা ধূমকেতুই জানাতে পারে জন্ম-রহস্য। দেখুন ভিডিও।
ছবি- নাসার সৌজন্যে।