বিজ্ঞানী: কফিল আহমেদ চৌধুরী
যে কোনও সভ্যতার বিকাশে যেমন লৌহ-ইস্পাত শিল্প জরুরি, তেমনই কাঠ ছাড়া সভ্যতার প্রসার অসম্ভব। কাঠের উৎপত্তিস্থল গাছ। গাছ অনুযায়ী প্রাপ্ত কাঠের প্রয়োজন বুঝে যথাযথ ব্যবহারের ধারণা যিনি ভারতে প্রথম এনে দিলেন, তিনি বিজ্ঞানী কফিল আহমেদ চৌধুরী। একই সঙ্গে তিনি কাঠ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আর্থিক সাশ্রয়ের বিষয়টিও মাথায় রেখেছিলেন। জায়গা ভেদে চিরাচরিত কাঠের ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি বিকল্প প্রজাতির কাঠের সন্ধানও দেন। তার আগে কাঠের ব্যবহার ছিল প্রচলিত ধারণাভিত্তিক, নির্দিষ্ট কোনও বিজ্ঞানভিত্তিক রূপরেখা ছিল না। ভারতে কোন প্রজাতির কাষ্ঠল উদ্ভিদের কোথায় অবস্থান, সে বিষয়ে কোনও সুস্পষ্ট ধারণাও ছিল না তখন। ফলে বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন ক্ষেত্রে কোন কাঠ বেশি উপযোগী হবে, সে বিষয়ে অস্পষ্টতা থেকে যেত।
নোয়াখালিতে জন্মসূত্রে প্রাথমিক পর্বের পড়াশোনা শেষে কফিল চলে এলেন কলকাতা। ১৯২২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করে চলে গেলেন এডিনবরায়, ফরেস্ট্রি নিয়ে পড়বেন বলে। ডিগ্রি নিয়ে ভারতে ফিরে এলেন। ইতিমধ্যেই তিনি সঙ্গলাভ করেছেন সেখানকার বিখ্যাত গবেষকদের, যাঁরা উদ্ভিদচর্চায় পারদর্শী। মনের মধ্যে জন্ম নিল নতুনের অনুসন্ধান, নতুন কিছু ভাবতে হবে। গাছ থেকে কাঠ, আর এই কাঠের চরিত্র নির্দিষ্ট করতে হবে তার উৎপত্তি ও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী। সে জন্য চাই কাঠের বিবিধ ধর্মের শনাক্তকরণ। এর জন্য তিনি বেছে নিলেন বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ, যাদের কাণ্ড কাষ্ঠল চরিত্রের।
কফিল আহমেদের এই অনুসন্ধানের আগেই যদিও একটা বই বেরিয়েছিল, ‘ম্যানুয়াল অব ইন্ডিয়ান টিম্বার্স’, লেখক জে এস গ্যাম্বল। ১৮৮১-তে এই বই বেরনোর আগেই লর্ড ডালহৌসির আমলে ১৮৫৫-তে বন সংরক্ষণের ভাবনা শুরু হয়েছিল স্থায়ী ভাবে। পরাধীন ভারতে ফরেস্ট অ্যাক্ট চালু হয়েছে ১৮৬৫-তে। তারও আগে পৃথিবীতে প্রথম অরণ্য সংরক্ষণের আভাস পাওয়া যায় ১৮৪২-এর মাদ্রাজে, আলেকজ়ান্ডার গিবসন সাহেবের তত্ত্বাবধানে।
এই ধারাবাহিকতার সূত্রেই ১৮৭৮-এ দেহরাদূনে প্রতিষ্ঠিত হল ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট। ১৯২৭-এ কফিল আহমেদ সেখানে যোগ দিলেন উড টেকনোলজিস্ট হিসেবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কাঠের চাহিদা তখন তুঙ্গে। ব্রিটিশ সরকার দেহরাদূনের এই প্রতিষ্ঠানে একটি গবেষণাগার করতে চাইল, এবং একই সঙ্গে ভারতে অবস্থিত কাষ্ঠল বৃক্ষের অবস্থান চিহ্নিত করে ভারতীয় কাঠের ব্যবহারিক চরিত্র, গঠনতন্ত্র ও উপযোগিতা বিষয়ে একটি বই প্রকাশের উদ্যোগ করল। নিউইয়র্ক থেকে স্বল্পমেয়াদি চুক্তিতে দেহরাদূন এলেন অধ্যাপক ব্রাউন। কফিল সঙ্গী হলেন এই উদ্যোগের। এই সূত্রে এখানেই ঘটে গেল তাঁর বিশ্বপরিচয়। অধ্যাপক ব্রাউনের সহযোগী হয়ে তিনি পাড়ি দিলেন আমেরিকা। ‘কমার্শিয়াল টিম্বার্স অব ইন্ডিয়া’ নামের মূল্যবান বইটি ১৯৩২-এ প্রকাশিত হল। এই গ্রন্থে তিনি তুলে ধরলেন ৩২০টি বিভিন্ন প্রজাতির কাণ্ডের অন্তর্গঠন, শনাক্তকরণ, সংরক্ষণ পদ্ধতি, ব্যবহারের উপযোগী প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি। ভারত পেয়ে গেল ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনীয় কাঠের সঠিক ব্যবহার।
তখন ভারতীয় রেলের লাইনে ও কামরায় কাঠের বহুল ব্যবহার ছিল। সেনাবাহিনীতেও প্রচুর কাঠের চাহিদা। প্রথমে রেল ও পরে সামরিক বিভাগ থেকে কফিলের কাছে এই বিষয়ে পুস্তিকা তৈরির আহ্বান এল। ১৯৩২-এ রেল বিভাগকে তিনি উপহার দিলেন ‘দি আইডেন্টিফিকেশন অব ইম্পর্ট্যান্ট ইন্ডিয়ান স্লিপার টিম্বার্স’ বইটি। নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে, রেলের স্লিপার কোচে ব্যবহৃত কাঠের চরিত্র নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণ রয়েছে এখানে, এবং এই ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রজাতির বৃক্ষগুলির অবস্থানও তিনি চিহ্নিত করেছিলেন। বইটি বেরনোর পর সামরিক বাহিনী থেকে প্রস্তাব এসেছিল তাদের ব্যবহারের উপযোগী কাঠের বিশদ বিশ্লেষণ তুলে ধরতে। এই দুটি ক্ষেত্রেই তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। আজও তাঁর গবেষণা সামনে রেখেই কাঠ নির্বাচন করা হয়।
কোন কাঠ নিজে থেকেই মজবুত, কোন কাঠে ছত্রাক প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে, কোন কাঠে এই প্রতিরোধ কৃ্ত্রিম ভাবে না করলে তা ব্যব্যহারযোগ্য হবে না, কোন কাঠ কতখানি ঘাতসহ নির্দিষ্ট চাপ সহ্য করতে পারবে, কাঠের বয়স গণনা, কাঠ নমনীয় করার উদ্ভাবন প্রক্রিয়া, কাঠকে সিজ়ন করার পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে কফিল আহমেদের গবেষণা পৃথিবীকে ঋদ্ধ করেছে।
তাঁর আবিষ্কৃত কাঠ চেনার সহজ উপায় আজও অনুসরণ করা হয়। যে পদ্ধতি অবলম্বন করে শুধু একটা লেন্সের মাধ্যমেই পৃথক করা যায় আসল ও নকল চন্দন কাঠ। শুধু তাই নয়, দেশলাই শিল্পে ব্যবহৃত কাঠ বা মাটির ঘর বানাতে দেওয়াল তৈরির জন্য কাঠের কী গুণ থাকতে হবে, কবরের কাঠ বা প্যাকিং বাক্সের কাঠের বৈশিষ্ট্য কী হওয়া দরকার, সব বিষয়েই তাঁর বিশ্লেষণ আজও প্রাসঙ্গিক। ভারতে যে সব প্রাচীন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে, তার নমুনা পরীক্ষা করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, সে কালে মানুষ তাদের প্রয়োজনবিশেষে কাঠের ব্যবহারে সক্ষম ছিল। এ বিষয়ে হরপ্পার নমুনা নিয়ে তাঁর গবেষণা উল্লেখযোগ্য। যেমন, হস্তিনাপুরের প্রাচীন বাড়ির দেওয়াল মজবুত ছিল কী উপায়ে, তা পরীক্ষা করেছেন তিনি। কাঠের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন কোনও বিষয় নেই যা নিয়ে তিনি গবেষণা করেননি। সমকালকে তিনি কাঠ চেনালেন, কাঠের যথার্থ প্রয়োগ ভাবনায় তিনিই প্রথম ভারতীয় উড টেকনোলজিস্ট, যিনি আধুনিক সাস্টেনেবেল ম্যানেজমেন্টের বীজ বপন করেছিলেন।
১৯০২ থেকে ১৯৭৮, এই তাঁর জীবনকাল। এই সময়কালে ভারতের এক সফল উড টেকনোলজিস্ট, বৃক্ষ-বিশারদ ও সুদক্ষ উদ্ভিদবিদ হিসাবে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অজস্র সম্মান লাভ করেছেন। আমরা কতটুকুই বা মনে রেখেছি তাঁর অবদান?