বিশিষ্ট কণাপদার্থবিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ।- ফাইল চিত্র।
‘সার্ন’ থেকে একটি খবর দেওয়া হয়েছিল গত ১ এপ্রিল। খবরটি ছিল, একটি নতুন মৌলিক কণা (ফান্ডামেন্টাল পার্টিকল)-র এই প্রথম হদিশ মিলেছে জেনিভার অদূরে সার্ন’-এর ভূগর্ভস্থ গবেষণাগার ‘লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার’-এর এলএইচসি-বি ডিটেক্টরে। যে মৌল কণাটির ভর দু’টি প্রোটনের (পরমাণুর নিউক্সিয়াসে থাকা ধনাত্মক আধানের কণা) ভরের সমান।
ওই কণাটির অত্যন্ত স্বল্পায়ু ও চেহারা (ডিমের মতো) দেখে বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছিলেন ‘হাম্পটি ডাম্পটি কণা’। বিজ্ঞানীরা যে একেবারেই ‘শুষ্কং কাষ্ঠং’ নন, তা প্রমাণ করতেই ওই মৌল কণাটির অমন নামকরণ করা হয়েছিল।
লুইস ক্যারলের লেখা বই ‘থ্রু দ্য লুকিং-গ্লাস, অ্যান্ড হোয়াট অ্যালিস ফাউন্ড দেয়ার’-এর একটি অন্যতম চরিত্র এই ‘হাম্পটি ডাম্পটি’। সেই ‘হাম্পটি ডাম্পটি’ চরিত্রের মতোই এই ক্ষণস্থায়ী মৌল কণাও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই (এক সেকেন্ডের ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ) দু’টি ফোটন কণায় ভেঙে গিয়ে বিলীন হয়ে যায়।
আমার মতো যাঁরা দীর্ঘ দিন ডুবে রয়েছি কণাপদার্থ বিজ্ঞানের গবেষণায়, তাঁদের কাছে তো এটা খুবই চিত্তাকর্ষক আবিষ্কার। তাই না? কারণ, ৪০ বছর আগে ওই কণার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী বলে সেই কণার হদিশ মেলেনি এত দিন।
বিশিষ্ট কণাপদার্থ বিজ্ঞানী অধ্যাপক বিকাশ সিংহের সেই আক্ষেপ ঝরে পড়ল তাঁর হাতে লেখা চিঠিতে
এ বার ই-মেলে ‘সার্ন’ সেই কণা আবিষ্কারের ‘ঘোষণা’ করায় স্বাভাবিক ভাবেই রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। কিন্তু পরে জানলাম, বাস্তবে তা হয়নি। এটা একটা বড় মাপের ‘এপ্রিল ফুল’। মজা! সবটাই একটা ঠাট্টা! কিন্তু সেটা এমন ভাবে সাজিয়ে ‘খবর’ হিসাবে ‘সার্ন’ পরিবেশন করেছে যে, তা চট করে বোঝার উপায় নেই।
‘সার্ন’-এর গবেষণার সঙ্গে আমি দীর্ঘ দিন ধরে জড়িত। পরিচিত। কোনও দিন কোনও আবিষ্কারের খবর নিয়ে ‘সার্ন’কে ই-মেল করে এই ধরনের ঠাট্টা-মস্করা করতে আমি অন্তত দেখিনি। ‘সার্ন’ অতীতে এমন মজা-টজা করেছে বলেও শুনিনি কোনও দিন।
(যে খবরের ভিত্তিতে অধ্যাপক বিকাশ সিংহের এই লেখা, নীচের প্রথম লিঙ্কে থাকল সেই খবরটিও.. হাম্পটি ডাম্পটি! নতুন কণা আবিষ্কার...)
আরও পড়ুন- হাম্পটি ডাম্পটি! নতুন কণা আবিষ্কার সার্নের সুড়ঙ্গ-ল্যাবে
আরও পড়ুন- রেটিনা দেখেই বলা যাবে ৫ বছরের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক হবে কি না?
এত দিন ধরে নিজেদের স্বভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে চলে ‘সার্ন’ হঠাৎ এই ভাবে একটি বহুকাঙ্খিত আবিষ্কারের খবর নিয়ে এমন ঠাট্টা-মস্করা করতে গেল কেন? উদ্দেশ্য কি শুধুই কয়েক জন সাধারণ মানুষকে বোকা বানানো? তাতে কী লাভ?
‘সার্ন’-এর মতো একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণাকেন্দ্রের পক্ষে দিন-রাতের হাজারো ব্যস্ততার মধ্যে এমন ঠাট্টা-রসিকতা কি মানানসই? তাও আবার বহুকাঙ্খিত একটি আবিষ্কারের খবর নিয়ে! এতে কি নিজেকেই খেলো প্রতিপন্ন করল না ‘সার্ন’? এমন কাজ তো ‘নাসা’, ‘ইসরো’ বা ‘ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি’ (ইএসএ বা ‘এসা’)-র মতো আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিকে কখনও করতে হয়নি, সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য! তাঁরা তাঁদের কাজকর্ম দিয়েই বিশ্বে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। ঠাট্টা-মস্করা করে সস্তায় বাজিমাত করার লোভ ওই সংগঠনগুলি বরাবরই সম্বরণ করে চলেছে।
সেই তো কবে, আজ থেকে ৬ বছর আগে, ২০১২ সালে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে ‘হিগস বোসন’ (যাকে আমজনতা ‘ঈশ্বর কণা বলে জানেন) কণার আবিষ্কার হয়েছিল। তার পর তো আর ‘সার্ন’-এর গবেষণার ঝুলিতে এমন কোনও আবিষ্কার নেই, যা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য! ফলে বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি স্বাভাবিক ভাবেই হারিয়ে ফেলেছে ‘সার্ন’।
তাই কি নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে, নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করতে এই সস্তায় বাজিমাত করার চেষ্টা করল ‘সার্ন’? যদি তাই হয়, তা হলে কণাপদার্থ বিজ্ঞানের এত দিনের এক জন প্রবীণ, আন্তরিক ও নিরলস গবেষক হিসাবে আমি গভীর দুঃখবোধ করছি।
‘সার্ন’ কি এ সবের মাধ্যমে বলতে চাইছে, ‘‘কিছু একটা কর, কিছু একটা করে দেখাও’’?! যখন গত ৬ বছরে ‘সার্ন’-এর আবিষ্কারের ঝুলিতে একটাও ‘স্বর্ণপদক’ আসেনি!
গবেষণা এখন অত্যন্ত জটিল। কণাপদার্থ বিজ্ঞানের গবেষণা জটিলতমই শুধু নয়, তার জন্য কোটি কোটি ডলার, ইউরো ব্যয়ের প্রয়োজন হয়। এত ডলার, ইউরোর ব্যাপার যখন, তখন তো কিছু একটা করে দেখাতেই হবে। ‘সোনা’ জেতার মতো আবিষ্কার নাই-বা হল ‘সার্ন-এর ভূগর্ভস্থ গবেষণাগারে! আর তার জন্য কত রকমের ব্যবস্থা! কত রকমের হেঁয়ালি!
যাঁরা ঠাট্টা করছেন, তাঁরা হয়ত আমরা ‘এপ্রিল ফুল’ বনেছি বলে আড়ালে হাসছেন। কিন্তু তাঁরা এটাও মনে রাখবেন, ‘সার্ন’-এর এই ঠাট্টা-মস্করার অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে কণাপদার্থ বিজ্ঞানের সিরিয়াস গবেষকরা প্রকাশ্যেই হাসাহাসি করছেন!
আর সেই হাসাহাসিটা করছেন বেশ উচ্চ স্বরেই!
লেখক সল্টলেকের ‘ভেরিয়েব্ল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার’-এর প্রাক্তন অধিকর্তা। ‘পদ্মভূষণ’ খেতাব জয়ী বিজ্ঞানী।