ধাক্কা খেলেন আইনস্টাইন, বিচ্ছেদের পরেও প্রেমে মজে থাকে কণারা!

বিচ্ছেদের পরে, যে যতই দূরে থাক বা দূরে যাক, একই ভাবে একে অন্যের কথা ভাবে এই ব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা, কণিকারাও? বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কার জানাচ্ছে, দূরে থেকেও তারা একই সময়ে একে অন্যের কথা মনে করে! ভাবে! একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে থাকে মনে মনে, বহু দূরে থেকেও! যেন টেলিপ্যাথি!

Advertisement

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৬ ১২:৩০
Share:

কুড়ি কুড়ি বছরের পর সে দিন হঠাৎ দেখা হয়ে গেল বনলতার সঙ্গে, ট্রেনে।

Advertisement

দু’-চার কথার পরেই বনলতা দুম করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘এ বারের জন্মদিনেএ কি গীতার একাদশ অধ্যায়টা পড়লে? ওই দিন এটাই মনে পড়ছিল, জান?’’ শুনে থ’ হয়ে গেলাম। বনলতার সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে বছর কুড়ি আগে। আমার এই ‘বদভ্যাস’টা জেনে প্রতিটা জন্মদিনেই আমার হাতে গীতাটা এগিয়ে দিত বনলতা! দিন তিনেক আগে, জন্মদিনের সকালে আমারও হঠাৎ দুম করে মনে পড়ে গিয়েছিল বনলতার কথা। হাতে গীতাটা তুলে দিয়েই বলত, ‘‘এটাও কি পূর্ব নির্ধারিত ছিল?’’ যেমন বলা রয়েছে গীতার একাদশ অধ্যায়ে, সব কিছুই নির্ধারিত হয়ে রয়েছে। কেউ বা কারা সে সব করিয়ে নিচ্ছে আমাদের দিয়ে! ভাবছিলাম, তা হলে কি অদৃশ্য কোনও সুতোয় বাঁধা পড়ে রয়েছি, আমি আর বনলতা- এখনও?

আরও পড়ুন
১০০ বছর পর প্রমাণিত আইনস্টাইনের তত্ত্ব ১০০ ভাগ সঠিক

Advertisement

পৃথিবী থেকে ২৩ কোটি কিমি দূরে বছর কাটিয়ে ফিরলেন স্কট কেলিরা

জানেন কি, বিচ্ছেদের পরে, যে যতই দূরে থাক বা দূরে যাক, একই ভাবে একে অন্যের কথা ভাবে এই ব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা, কণিকারাও? বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কার জানাচ্ছে, দূরে থেকেও তারা একই সময়ে একে অন্যের কথা মনে করে! ভাবে! একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে থাকে মনে মনে, বহু দূরে থেকেও!

যেন টেলিপ্যাথি!

মনে করুন, যখন টাইটানিক জাহাজটা ডুবে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছেন তার চিফ ক্যাপ্টেন, যখন বহু বহু দূরে থেকে, কিছু না জেনেও ঘুম ভেঙে ধরমড় করে বিছানায় উঠে বসেছিলেন তাঁর স্ত্রী। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ঘড়ির পেন্ডুলামের দোলন। টেলিপ্যাথি? গল্প হলেও সত্যি!

বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কার কী বলছে জানেন?

ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা, কণিকারাও, একই ভাবে একে অন্যের গভীর প্রেমে মজে থাকে, বহু বহু দূরে থেকেও। কণা-কণিকাদের জগতে ভীষণ ভাবেই চালু রয়েছে টেলিপ্যাথি! পদার্থবিদ্যার পোশাকি ভাষায়, যাকে বলে- ‘এনট্যাঙ্গেলমেন্ট’।

এমনটা যে হতে পারে, ১৯৬০ সালে তাঁর হাইপোথিসিসে সেটা প্রথম গাণিতিক ভাবে তুলে ধরেছিলেন বিশিষ্ট পদার্থবিদ জন বেল। যাকে ‘বেল থিওরেম’ও বলা হয়। কিন্তু এত দিন কিছুতেই তা হাতে-কলমে প্রমাণ করা যাচ্ছিল না। কিন্তু গত বছরের একেবারে শেষের দিকে বিজ্ঞান জার্নাল ‘ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার্স’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র জানিয়েছে, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা, কণিকাদের জগতেও ওই অবিশ্বাস্য ঘটনার হাতে-কলমে প্রমাণ মিলেছে। ‘স্ট্রং লুপহোল-ফ্রি টেস্ট অফ লোকাল রিয়্যালিজম’ শীর্ষক ওই গবেষণাপত্রে প্রধান দুই গবেষক কলোরাডোর ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেকনোলজি’র পদার্থবিদ ক্রিস্টার শ্যালম ও পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী ফ্রান্সেসকো মার্সিলি জানিয়েছেন, ‘‘সরাসরি মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ মেলায় যেমন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ ‘অগ্নিপরীক্ষা’য় পাশ করে গেল ১০০ বছর পর, তেমনই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রমাণিত হওয়া ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা-রাজ্যের এই এনট্যাঙ্গেলমেন্ট এটাও দেখিয়ে দিল, এই ব্রহ্মাণ্ডে এমন ঘটনাও ঘটে, যা আইনস্টাইনের পক্ষে কোনও দিন মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি।’’

দেখুন- সহজে বোঝার ভিডিও।

দু’টি ফোটন কণাকে ৬০৭ ফুট বা ১৮৫ মিটার দূরে রাখলেও তাদের মধ্যে যে বনিবনা নষ্ট হয় না একটুও, সেটাই প্রমাণিত হয়েছে শ্যালম ও মার্শিলির পরীক্ষায়।

কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সেসের থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের সিনিয়র প্রফেসর ও অ্যাকাডেমিক ডিন পদার্থবিদ সৌমিত্র সেনগুপ্তের ব্যাখ্যায়, ‘‘মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ যেমন আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকে পাশ করিয়ে দিয়েছে, ঠিক তেমনি ভাবে এই এনট্যাঙ্গলমেন্ট হাতে-কলমে প্রমাণিত হওয়ায় আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের (এসটিআর) ‘প্রিন্সিপ্‌ল অফ কজালিটি’কে বড়সড় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসল। আইনস্টাইনের বক্তব্য ছিল, এই মহাবিশ্বে কোনও কিছুই আলোর চেয়ে বেশি গতিতে ছুটতে পারে না। ফলে, এই মহাবিশ্বে দূরে থাকা দু’টি ঘটনা বা কণা, কণিকাও একই সময়ে বা নির্দিষ্ট সময় অন্তর কখনওই বাঁধা পড়ে থাকতে পারে না একই কার্যকারণ সম্পর্কে। তার মানে, খুব দূরে থাকলে কোনও দু’টি ঘটনার মধ্যে কোনও যোগসূত্র থাকা সম্ভবই নয়। সদ্য-আবিষ্কৃত মহাকর্ষীয় তরঙ্গও আলোর গতিবেগেই ছোটে। তাই এর সাহায্যেও, কণাদের ‘টেলিপ্যাথি’কে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তাই আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ, যা আলোর গতিবেগের কথা বলে আর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ, যা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের গতিবেগের কথা বলে, এর কোনওটির সাহায্যেই এই টেলিপ্যাথির ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়।’’

ফলে, কণা, কণিকাদের ‘গভীর প্রেম’ বড় রকমের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল বিশ্বপ্রেমিক আইনস্টাইনের দিকে! আপেক্ষিকতাবাদের একশো বছর পর, তাঁর ‘বিজয়ের বছরে’ও!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement