সে এক নাথবতী অনাথবৎ!
তাকে গ্রহ কূলে এক কর্ণও বলা যায়!
হয়ত কোনও কালে ছিল তার ‘নাথ’! যাকে ঘিরে হয়ত সে প্রদক্ষিণ করত এক সময়। চলত ‘সূর্য-সাক্ষী’ হয়েই। হয়ত সূর্যপ্রণাম দিয়েই শুরু হত তার দিন। যেমনটি হয় অন্য গ্রহদের ক্ষেত্রে।
এক দিন সে ব্রাত্য হয়ে পড়ে সূর্য-সংসারে! তখন থেকেই সে ব্রহ্মাণ্ডে একা। নির্বান্ধব। অনাথ। একদা ‘নাথবতী’ হয়ে পড়ে অনাথবৎ!
আমাদের এই সৌরমণ্ডলের সেই ব্রাত্য জনের নাম-‘PSO-J318.5-22’। এই সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতির চেয়ে চেহারায় আট গুণ বড় হয়েও তার কপালে জোটেনি গ্রহের মর্যাদা। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের দেওয়া খেতাব ‘Planetary Mass Object’ বা ‘পিএমও’ নিয়েই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। যদিও তা বৃহস্পতির চেয়ে ছয় গুণ ভারী।
অর্জুনের জন্য যেমন একলব্যকে আঙুল দক্ষিণা দিতে হয়েছিল বাল্য কালে তার শিক্ষাগুরুকে, তেমনই বৃহস্পতির জন্যই এই ‘PMO’-কে ছিটকে যেতে হয়েছে সৌরমণ্ডল থেকে। ব্রহ্মাণ্ডের খুব জোরালো অভিকর্ষের টানে। এই ভাবেই আমাদের সৌর-পরিবারে তাকে হতে হয়েছে অনাথ! পরিত্যাজ্য!
তার হাল হয়েছে মহাভারতের কর্ণের মতো। সূর্য ‘পিতা’ হওয়া সত্ত্বেও, আপাতত সে পিতৃ-পরিচয়হীন।
এর আবিষ্কার গত বছরে হলেও, তার অস্তিত্ব প্রমাণিত হওয়ার কথা প্রকাশিত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা সংক্রান্ত জার্নাল ‘লেটারস’-এর সাম্প্রতিক সংখ্যায়। গবেষক দলের প্রধান আমেরিকার হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোনমি’র জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিশেল লিউ তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘‘It has all the characteristics of young planets found around other stars, but it is drifting out there all alone. I had often wondered if such orphan/solitary objects exist, and presently we know, they DO!’’
কী ভাবে এই ‘অনাথ গ্রহে’র হদিশ মিলেছিল?
সহযোগী গবেষক, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান ও কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের অ্যাসোসিয়েট অধ্যাপক হিল্লোল গুপ্ত জানিয়েছেন, ‘‘হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ মাউইয়ের হালিয়াকালা পাহাড় চুড়োয় বসানো ‘প্যান-স্টার্স-ওয়ান ওয়াইড ফিল্ড সার্ভে টেলিস্কোপ’ মহাকাশে ‘ব্রাউন ডোয়ার্ফ’ বা বাদামি রঙা বামন নক্ষত্র খুঁজতে গিয়ে প্রথম এর হদিশ পেয়েছিল। এটা রয়েছে পৃথিবী থেকে ৮০ আলোক-বর্ষ দূরে (সেকেন্ডে এক লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল বেগে ছুটলে বছরে যতটা পথ অতিক্রম করে আলো, ততটা দূরত্ব)।’’
এই সদ্য আবিষ্কৃত মহাজাগতিক বস্তুটি কি কোনও অনাথ গ্রহ নাকি ব্যর্থ নক্ষত্র বা Failed Star, তা নিয়ে এত দিন দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন বিজ্ঞানীরা।
হিল্লোলবাবু জানাচ্ছেন, ‘‘এখন আমরা নিশ্চিত, এটা কোনও ব্যর্থ নক্ষত্র নয়। এটা অনাথ গ্রহই। এটি রয়েছে ক্যাপ্রিকর্ন নক্ষত্রপুঞ্জে। এই নক্ষত্রপুঞ্জেই রয়েছে এক ঝাঁক যুবা নক্ষত্র বা ‘ইয়ং স্টার্স’। ১২০০ কোটি পার্থিব বছর আগে জন্মানো ওই নক্ষত্রপুঞ্জটির নাম-‘বিটা পিকটোরিয়া মুভিং গ্রুপ’ বা বিপিএমজি। মানে, ব্রহ্মাণ্ড-সৃষ্টির দু’শো কোটি বছর পরে। এই নক্ষত্রপুঞ্জের সবচেয়ে বড় তারাটির নাম-‘বিটা পিকটোরিস’। যা আমাদের সৌরমণ্ডলের গ্যাসে ভরা বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতির চেয়ে আট- দশ গুণ বড়।’’
কেন সে অনাথ গ্রহ?
হিল্লোলবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘কোনও বড় নক্ষত্র বা তারার চারপাশে চক্কর মারে না বলেই এটা অনাথ গ্রহ। একে তাই ‘পিএমও’ বলা হচ্ছে। দূরে রয়েছে বলে শুক্র গ্রহ থেকে যে তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যের আলো পৃথিবীতে আসে, এই অনাথ গ্রহ থেকে আসা আলোর জৌলুস তার দশ হাজার কোটি ভাগের এক ভাগ মাত্র। বামন নক্ষত্রদের থেকে যে আলো বিচ্ছুরিত হয়, তা লাল রঙের হলেও অত্যন্ত ক্ষীণ। তার চেয়ে বহু গুণ বেশি লাল রঙা ইনফ্রারেড আলো এই গ্রহ থেকে আসে বলে একে বামন নক্ষত্র বলা যায় না। তাই এটা আদতে একটি গ্রহই।’’
কেন সে অনাথ হয়ে পড়ল, সেই জবাবের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে এই সৌরমণ্ডলের পরিবর্তনের ইতিহাস।
তাই বিজ্ঞানীদের কাছে আপাতত অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের এই ‘কর্ণে’র মর্যাদা!
ছবি- নাসার সৌজন্যে।