Pentagon

UFO: আছেন, ওঁরা আছেন, ভিন্‌গ্রহীদের অস্তিত্ব উড়িয়ে দিতে পারল না পেন্টাগন

দেখা গেল, কাঁকুড়গাছি যা জানত, তা এতদিন বিলেত-আমেরিকাও জানত না। আমেরিকা বলতে পারেনি।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০২১ ১৫:০৩
Share:

প্রতীকী চিত্র। গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।

কাঁকুড়গাছির বাসিন্দাদের আগেই জানা ছিল। কাঁকুড়গাছির প্রাইমারি স্কুলে ভূগোল এবং বাংলার নিরীহ স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ক্রেনিয়াস গ্রহের অ্যাং-এর। পঞ্চা ঘোষের বাঁশবাগানের মাঝবরাবর ডোবার উপর এসে নেমেছিল অজ্ঞাত উড়ন্ত চাকি (ইউএফও)। গোলাপী আভা ছড়ানো সেই কাচের ঢিবির মতো দেখতে বস্তুর দরজা খুলে নেমে এসেছিল অ্যাং। স্কুলশিক্ষক বঙ্কুবিহারী দত্তের সঙ্গে স্পষ্ট বাংলাভাষায় কথা বলে (অ্যাং জানিয়েছিল, সে ১৪ হাজার ভাষা জানে) ৮৩৩ বছরের ভিন্‌গ্রহের প্রাণী আবার মিলিয়ে গিয়েছিল মহাশূন্যে।

Advertisement

দেখা গেল, কাঁকুড়গাছি যা জানত, তা এতদিন বিলেত-আমেরিকাও জানত না। আমেরিকা বলতে পারেনি। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির নিয়ন্ত্রক উন্নত দেশগুলি পেরেছে, এমন প্রমাণও নেই। অর্থাৎ, আছেন, ভিনগ্রহীরা আছেন। তাঁরা আছেন কি নেই, সে বিষয়ে নানারকম কাল্পনিক, আধা কাল্পনিক তথ্য নিয়ে চর্চা হয়েছে। লেখা হয়েছে প্রচুর বই। হয়েছে সিনেমাও। যেমন স্পিলবার্গের ‘ক্লোজ এনকাউন্টার অব দ্য থার্ড কাইন্ড’। বিদেশের টেলিভিশনে অত্যন্ত জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘এক্স ফাইল্স’ চলেছিল দীর্ঘদিন। বাংলায় প্রায় ‘রানী রাসমণি’-র মতোই।

কিন্তু অবিশ্বাসী মন এসব উড়িয়ে দিয়ে বরাবর বলেছে, সব বুজরুকি! প্রমাণ কোথায়? কিংবদন্তি বৈজ্ঞানিক এনরিকো ফার্মি যেমন বলেছিলেন, ‘‘ব্রহ্মাণ্ডে যদি সত্যিই নানারকম প্রাণী থাকে, তা হলে এতদিন সন্ধান পেলাম না কেন! ইফ এলিয়েন্‌স আর আউ়ট দেয়ার, হোয়াই হ্যাভন্ট উই সিন দেম!’’ কিন্তু যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা পাল্টা বলেন, সৌরমন্ডলে ৪০০ কোটি নক্ষত্রমন্ডলী রয়েছে। তাদের প্রতিটির মধ্যে আরও অনেক নক্ষত্র রয়েছে। আছে কয়েক লক্ষ কোটি ছায়াপথ। অন্য ছায়াপত থেকে আলোর গতিতে পৃথিবীতে পৌঁছলেও কয়েক লক্ষ বছর লাগবে। ফলে শুধু পৃথিবীতেই প্রাণ আছে, আর কোথাও নেই— এটা ভাবাটাই চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য। তবে অঙ্কশাস্ত্র যা-ই বলুক, এমন কারও সাক্ষাৎ কেউ পাননি। বঙ্কুবাবু ছাড়া।

Advertisement

তবে বৈজ্ঞানিকরা নানারকম অনুসন্ধান চালিয়ে গিয়েছেন। যেমন চালানো হয়েছিল আমেরিকায়। আমেরিকার সরকার বিপুল অর্থ বরাদ্দ করেছিল সেই অনুসন্ধানে। তৈরি করেছিল ‘সার্চ ফর একস্ট্রা টেরেস্ট্রিয়াল ইনটেলিজেন্স (সেটি)’। কিন্তু হদিশ পাওয়া যায়নি। অনেকে বলেন, তার কারণ হতে পারে পৃথিবীর অবস্থান। আমরা সৌরমন্ডলের এমন এক প্রান্তে আছি, যার চারপাশে নানা ধরনের রেডিও শব্দ যে, কোনও তরঙ্গেরই হদিশ পাওয়া কঠিন। কিন্তু অনুসন্ধান তাতে থেমে থাকেনি। ১৯৯০ সালে আমেরিকার সরকার মহাকাশে বসিয়েছিল দূরবীন। স্পেস টেলিস্কোপ। নাম ‘হাব্‌ল’। যাতে ভিনগ্রহের জীবেরা থাকলে তাদের স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায়। তার চারপাশে বিভিন্ন রকম রেডিও সিগন্যাল মিলেছে। কিন্তু গত দু’সপ্তাহ ধরে সেই ‘হাব্‌ল’ আবার কাজ করছে না। বস্তুত, আগামী নভেম্বরে আমেরিকা মহাকাশে পাঠাতে চলেছে নতুন দূরবীন। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ।

কিন্তু সংশয় ছিল। গত দু’দশক ধরে আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তের আকাশে নৌবাহিনীর অফিসারদের নজরে পড়েছিল অন্তরীক্ষচারী কিছু ‘যান’। সেগুলি যে আদতে কী, তা নিয়েই সংশয় ছিল। সেই সংশয় নিরসনে আমেরিকার সরকারের তত্ত্বাবধানে আমেরিকার নৌবাহিনী অনুসন্ধান চালিয়েছিল ২০০৪ সাল থেকে। কিন্তু তারাও এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। বিস্তারিত অনুসন্ধানের পর রিপোর্ট জমা পড়েছে মার্কিন মুলুকের প্রতিরক্ষার সদর দফতর পেন্টাগনে। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রেক্ষিতে সরকারের কাছে রিপোর্ট দিয়েছে পেন্টাগন। আর পেন্টাগনের রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সরকারের তরফে যা বলা হয়েছে, তার মর্মার্থ— এটা দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলা যায় না যে, ভিনগ্রহীরা নেই। এটাও বলা যায় না যে তাঁদের যান পুরোপুরি ‘কল্পনাপ্রসূত’। অর্থাৎ, ভিনগ্রহীদের অস্তিত্ব একেবারে নস্যাৎ করে দেওয়া যাচ্ছে না। বলতে কী, সরকারের কাছে ওই বিষয়ে তাদের ‘অসহায়তা’-র কথা জানিয়েছে পেন্টাগনও। কী আর করা যাবে! তারা তো আর বঙ্কুবাবুর মতো ‘অ্যাং’-এর দেখা পায়নি! সেই ‘অসহায়তা’ কিছুটা ঢাকা-চাপা দিতেই সম্ভবত ভিনগ্রহীদের যানকে ‘অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তু’ (আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট বা ইউএফও) না বলে ‘আনআইডেন্টিফায়েড এরিয়াল ফেনোমেনা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাইডেন সরকার তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ভিনগ্রহীদের নিয়ে পেন্টাগন যে রিপোর্ট জমা দিয়েছে, তার কোনও ‘বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা’ আমেরিকার প্রশাসনের হাতে নেই। কিন্তু ভিনগ্রহীদের অস্তিত্ব এবং নিজেদের নৌবাহিনীর অফিসারদের নজরে-পড়া আকাশে উড়ন্ত যানগুলিকে একেবারে উড়িয়ে দিতে পারেনি বাইডেন সরকার। পেন্টাগন আলাদা টাস্ক ফোর্স গড়ে ওই সব ঘটনার তদন্ত চালিয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। তারা জানিয়েছে, ২০০৪ সাল থেকে ওই ধরনের ঘটনার মোট ১৪৩টি রিপোর্ট তাদের কাছে রয়েছে। তার মধ্যে অন্তত ২১টি রিপোর্ট রয়েছে, যেগুলি ১৮টি পর্বে দেখা গিয়েছে। কিন্তু তার পরেও পেন্টাগনও তাদের রিপোর্টে নিঃসংশয় হয়ে বলতে পারেনি যে, সব আজগুবি! ভিনগ্রহী বলে কিছু নেই। নেই ভিনগ্রহী যানও। পেন্টাগন তাদের রিপোর্টে শুধু বলেছে, কোনও ব্যাখ্যা মেলেনি। তবে পেন্টাগনের রিপোর্টে ওই সব ঘটনার চারটি ‘সম্ভাব্য কারণ’ দর্শানো হয়েছে। ‘সম্ভাব্য’। অর্থাৎ, ইহাও হয়-উহাও হয়।

আরও বিস্ময়ের যে, এতদিন ধরে এত বিশাল তদন্তের পরেও পেন্টাগন ওই সব ঘটনার যে চারটি সম্ভাব্য কারণ দেখিয়েছে, তার মধ্যে একটিতে বলা হয়েছে, সেগুলি ‘অন্য কোনও গোত্রে’রও হতে পারে। সেই ‘অন্য কোনও গোত্র’ বলতে পেন্টাগন কি আসলে কাঁকুড়গাছিতে বঙ্কুবাবুর দেখা অ্যাং-এর কথা বলতে চেয়েছে? বাইডেন সরকারের বিবৃতি পড়ে তো তেমনই মনে হতে পারে। কারণ, সেখানে বলা হয়েছে, পেন্টাগনের রিপোর্টে ‘ভিনগ্রহীদের যান’ বা তাদের প্রযুক্তির কথা বোঝানো হয়েছে। বলা হয়েছে, বিজ্ঞানীরাও নাকি নিশ্চিত নন সেগুলি ভিনগ্রহীদের যান কি না তা নিয়ে। উল্লেখ্য, নাসার দেশের বিজ্ঞানীরা ভিনগ্রহী আর ভিনগ্রহীদের যান নিয়ে অতীতে তদন্তের খবর পেয়ে সেগুলি নস্যাৎ করে দিলেও পেন্টাগন বা বাইডেন প্রশাসনের তরফে কিন্তু তা এক বারও বলা হয়নি। তেমন কিছু ঘটলে তারও উল্লেখ থাকার কথা পেন্টাগনের ৯ পাতার রিপোর্ট এবং সরকারি বিবৃতিতে। বিষয়টাকে একেবারেই ‘অবৈজ্ঞানিক এবং কাল্পনিক’ বলে দিলে বরং দায় কমত সরকার এবং পেন্টাগনের। তা তো হয়ইনি। বরং দিনকয়েক আগে নাসার নতুন প্রধান বিল নেলসন তাঁর অধীনস্থ বিজ্ঞানীদের বিষয়টির পুরোদস্তুর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে নামার নির্দেশ দিয়েছেন। বাইডেন সরকারের তরফেও বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে আরও তদন্ত প্রয়োজন। তার জন্য অর্থবরাদ্দ, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও কর্মী নিয়োগের কথাও ভাবা হচ্ছে। একই কথা জানিয়েছে পেন্টাগনও। তা হলে যা দাঁড়াচ্ছে, ‘অ্যাং’-দের খোঁজে অনুসন্ধান চলবে।

পেন্টাগনের রিপোর্টে আরও তিনটি ‘সম্ভাব্য’ কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, বলা হয়েছে ওই ঘটনাগুলি (আকাশে উড়ন্ত চাকি) রাশিয়া বা চিনের মতো প্রতিপক্ষ দেশগুলির উন্নত প্রযুক্তির অত্যন্ত গোপন পরীক্ষানিরীক্ষার পরিণতি হতে পারে। দ্বিতীয়ত, সেগুলি আমেরিকার হাতে-থাকা নিজস্ব প্রযুক্তির ফসলও হতে পারে। যা কোনও কারণে সঠিক ভাবে নজরে পড়েনি বা ক্যামেরায় সে সব ছবি কোনও কারণে ঠিকঠাক তোলা সম্ভব হয়নি। তৃতীয়ত, ওই অজ্ঞাত উড়ন্ত চাকি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের জন্য আকাশে ওড়ানো বেলুনও হতে পারে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘একটি ক্ষেত্রে বেলুন দেখা গিয়েছে’।

কিন্তু সত্যজিতের বঙ্কুবাবু দেখতে পেয়েছিলেন। সন্ধান পেয়েছিলেন ভিনগ্রহীর। মার্কিনরা ঠিকঠাক না বলতে পারেন। কিন্তু বঙ্গবাসীর মনে অন্তত কোনও সন্দেহ নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement