মৃত্যুর ৫০০ বছর পরেও তাঁর আঁকা ভাবাচ্ছে বিজ্ঞানীদের
Leonardo da Vinci

লিয়োনার্দোর খোঁজে

লিয়োনার্দোর ভক্ত পাস্কাল প্যারিসে নিজের স্টুডিয়োয় বসে আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের সাহায্যে একটু একটু করে জট ছাড়াচ্ছেন রেনাসাঁসের সময়কার জিনিয়াসের কর্মকাণ্ডের।

Advertisement

অর্ঘ্য মান্না

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০৪
Share:

পাস্কাল কট শখের আলোকবিজ্ঞানী। প্যারিসে তাঁর স্টুডিয়োয় গেলে দেখা যাবে একটি কোণ আলো করে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি, মোনালিসা। সামনে বসানো একাধিক কম্পিউটার আর একটি অদ্ভুতদর্শন ক্যামেরা। এই ক্যামেরার দেখা মিলবে শুধুমাত্র পাস্কালের নিজের রাজত্বেই।

Advertisement

লিয়োনার্দোর ভক্ত পাস্কাল প্যারিসে নিজের স্টুডিয়োয় বসে আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের সাহায্যে একটু একটু করে জট ছাড়াচ্ছেন রেনাসাঁসের সময়কার জিনিয়াসের কর্মকাণ্ডের। বছর ১৫ আগে পাস্কাল এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে বসেন। মোনালিসা আসলে কে ছিলেন, খুঁজে বের করতে তিনি আবিষ্কার করেন মাল্টিস্পেকট্রাল লেয়ার অ্যামপ্লিফিকেশন মেথড (এলএএম)। এই পদ্ধতিতে গোটা আলোক বর্ণালীকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে মোনালিসার ছবির উপর ফেলা হয়। ছবির বিভিন্ন স্তর থেকে প্রতিফলিত আলো ধরা পড়ে পাস্কালের তৈরি মাল্টিস্পেকট্রাল ক্যামেরায়। কম্পিউটারে জমা পড়ে হাজারও তথ্য। জানা যায়, সারা জীবন একই ক্যানভাসের উপর মোনালিসার একাধিক ছবি এঁকেছিলেন লিয়োনার্দো। ল্যুভর মিউজিয়ামে রাখা ছবিটি শুধুমাত্র জলের উপর ভেসে থাকা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে একাধিক ছবি।

পাস্কালের এই গবেষণা প্রকাশিত হতেই হইচই পড়ে যায়। সেটা ২০০৪ সাল। বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত লিয়োনার্দো-বিশেষজ্ঞ মার্টিন কেম্প বলেন, ‘‘লিয়োনার্দোকে যে পুরোটা জানা এখনও অনেকটাই বাকি, তা প্রমাণিত হল কটের গবেষণায়। বিজ্ঞানী-শিল্পী-প্রযুক্তিবিদ লিয়োনার্দো এত শতাব্দী পরেও ইন্ধন জোগাচ্ছেন নতুন প্রযুক্তি ও পদার্থবিদ্যার গবেষণায়। আর সেই গবেষণা কাজে লাগছে তাঁকেই জানতে, বুঝতে।’’

Advertisement

২০১৯ সালটা লিয়োনার্দোর ৫০০তম মৃত্যুবার্ষিকী। মনে করা হয়, ফ্রান্সের লুয়ার উপত্যকার কোথাও রয়েছে তাঁর কবর। কিন্তু এ নিয়ে রয়েছে বিস্তর ধোঁয়াশা। ইতালির তাসকান উপত্যকার পাহাড়ি গ্রামে বড় হয়ে ওঠা লিয়োনার্দো ছবি আঁকার পাশাপাশি প্রকৃতির নিয়মকানুন বুঝতে এবং সেই নিয়মকানুনকে ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তিতে পরিণত করতে নোটবইয়ে (কোডেক্স লেস্টার) একাধিক স্কেচ করেন লিয়োনার্দো। বাদামি কালিতে আঁকা সেই স্কেচ ও টীকা শিল্প তথা বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিলগুলির একটি। শিল্পী লিয়োনার্দোর তৈলচিত্র সম্পর্কে চর্চা হয়েছে বিস্তর। তবে একুশ শতকে তাঁকে ঘিরে জ্ঞানচর্চা অনেকটাই ঝুঁকেছে কোডেক্সে লিপিবদ্ধ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে বুঝতে।

লিয়োনার্দোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিচর্চা একুশ শতকের বিজ্ঞানচর্চায় প্রাসঙ্গিক দুই ভাবে— প্রথমত, তাঁর জীবন ও ছবির রহস্য বুঝে উঠতে প্রতিনিয়তই আবিষ্কৃত হচ্ছে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও প্রযুক্তি। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ পাস্কাল কটের এলএএম সংক্রান্ত গবেষণা। দ্বিতীয়ত, লিয়োনার্দোর আঁকা বিভিন্ন স্কেচ প্রকৃতির নিয়মকানুন বুঝে উঠতে নতুন করে সাহায্য করছে বর্তমানে গবেষণারত বিজ্ঞানীদের। অর্থাৎ, লিয়োনার্দোর বিজ্ঞান গবেষণাকে অনুকরণ ও অনুসরণ করেই এগিয়ে যাচ্ছে এখনকার বিজ্ঞান।

লিয়োনার্দো বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতির চেয়ে বড় শিল্পী, বড় প্রযুক্তিবিদ কেউই নয়। তাঁর সবচেয়ে বড় উদাহরণ মানবদেহ। প্রতিনিয়ত জটিল শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে মানুষের শরীরে। তার নেপথ্যে থাকা জটিল কলকব্জার ডিজ়াইনও তা হলে ততটাই সূক্ষ্ম ও নিখুঁত হবে। নিজের স্কেচবুকে তাই মানবদেহের একাধিক অঙ্গের স্কেচ করে রাখতেন লিয়োনার্দো। আর এই স্কেচগুলিই বদলে দিয়েছিল হৃদযন্ত্রের বিশেষজ্ঞ শল্যচিকিৎসক ফ্রান্সিস চার্লস ওয়েলস-এর কেরিয়ার। সত্তরের দশকে আথেরোস্কেলেরোসিস রোগটা সম্পর্কে তেমন তথ্য জানা ছিল না। এই রোগে রক্তনালিকার ভেতরের দেওয়ালে চর্বি জমতে থাকে। ফলে রক্ত সরবরাহ বাধা পায়। এর প্রভাব পড়ে হৃৎপিণ্ডের ভাল্ভ বা কপাটিকার কার্যক্ষমতায়। লিয়োনার্দো তাঁর নোটবইয়ে মানব হৃৎপিণ্ডের নিখুঁত স্কেচ তো এঁকেছিলেনই, সেই সঙ্গে হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে যুক্ত শিরা-ধমনীর ভেতরকার ব্যাস পরিবর্তনও লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ১৯৬০ সালে প্রথম জানা যায় যে, লিয়োনার্দো কাচের টিউব জুড়ে একটি কৃত্রিম রক্ত সংবহনের মডেল তৈরি করেছিলেন, যার সাহায্যে ভাল‌্‌ভের কার্যক্ষমতা ও রক্ত সংবহনের মধ্যেকার সম্পর্ক বোঝা সম্ভব হয়। ১৯৭৭ সালে লন্ডনের রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব আর্ট-এ অনুষ্ঠিত লিয়োনার্দোর স্কেচ সংক্রান্ত এক প্রদর্শনী ফ্রান্সিসের চোখ খুলে দেয়। এর পরেই আথেরোস্কেলেরোসিস সংক্রান্ত কিছু যুগান্তকারী গবেষণা করেন ফ্রান্সিস, যার নেপথ্যে ছিল লিয়োনার্দোর স্কেচ। ২০১৩ সালে ‘দ্য হার্ট অব লিয়োনার্দো’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন ফ্রান্সিস। বইয়ে লিয়োনার্দোর আঁকা হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালিকার নিখুঁত স্কেচ কী ভাবে বর্তমানে আথেরোস্কেলেরোসিস চিকিৎসাকে সাহায্য করেছে, তার বর্ণনা রয়েছে।

ফ্রান্সিসের মতোই লিয়োনার্দোর নোটবই এগিয়ে নিয়ে চলেছে ডেভিড লেন্টিঙ্ক-এর গবেষণা। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গবেষণাগারের নাম ‘বার্ড’— বায়োইন্সপায়ার্ড রিসার্চ অ্যান্ড ডিজ়াইন। পাঁচ শতাব্দী আগে আকাশে পাখির ঝাঁক দেখে লিয়োনার্দোর মনে জেগেছিল প্রশ্ন, পাখি উড়তে পারে, কিন্তু মানুষ কেন পারে না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একাধিক স্কেচ করেছিলেন তিনি। কাঠ ও ইস্পাতের সাহায্যে তৈরি করেছিলেন মানুষের কৃত্রিম ডানা। যদিও এই পরীক্ষায় তখন সফল হননি লিয়োনার্দো। তাঁর মৃত্যুর ৫০০ বছর পরে এই একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন লেন্টিঙ্ক ও তাঁর গবেষকদল। বার্ড গবেষণাগারের ওয়েবসাইটে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে তাঁদের কর্মকাণ্ডে কতটা জড়িয়ে রয়েছেন প্রথম হেলিকপ্টারের ডিজ়াইনের স্রষ্টা।

তবে লিয়োনার্দো ও আধুনিক বিজ্ঞানকে জুড়েছে যে সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক প্রকল্প, তার আঁতুড়ঘর ইতালির ফ্লোরেন্স শহরেই, যেখানে নিজের শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন লিয়োনার্দো। ২০১৬ সালে ‘হিউম্যান ইভল্যুশন’ জার্নাল তাদের সেপ্টেম্বর সংখ্যাতে ঘোষণা করে লিয়োনার্দোকে জড়িয়ে সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক প্রকল্প ‘প্রজেক্ট লিয়োনার্দো’-র কথা। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য, লিয়োনার্দো আসলে কে ছিলেন তা খুঁজে বের করা। লিয়োনার্দোকে নিয়ে লেখা হয়েছে একাধিক বই, যার সাম্প্রতিকতম সংযোজন ওয়াল্টার আইজ্যাকসন-এর লেখা জীবনী। তবে কোনও গবেষক বা জীবনীকারই লিয়োনার্দো আসলে কে ছিলেন, তাঁর পরিবারের লোকজন কারা, সে নিয়ে বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে পারেননি। তাই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লিয়োনার্দোর বংশতালিকা তৈরি করাও সম্ভব হয়নি। এমনকি মোনালিসার সৃষ্টিকর্তাকে কেমন দেখতে ছিল, সে নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। প্রজেক্ট লিয়োনার্দোয় কর্মরত বিজ্ঞানীরা ঠিক এই অজানা রহস্যগুলিরই পর্দা ফাঁস করতে চাইছেন। প্রকল্পের প্রধান ডেভিড ক্যারামেল জানিয়েছেন, এই কাজে তাঁদের হাতিয়ার আধুনিক জৈবরসায়ন ও মলিকিউলার বায়োলজি। ক্যারামেল কোনও প্রাচীন বস্তু, জীবাশ্ম থেকে ডিএনএ-র নমুনা সংগ্রহে সিদ্ধহস্ত। তিনিই প্রথম নিয়ান্ডারথাল মানুষের সম্পূর্ণ জিন সিকোয়েন্স প্রকাশ করেছিলেন। ক্যারামেলের তত্ত্বাবধানে একাধিক বিজ্ঞানী গত তিন বছর ধরে লিয়োনার্দোর সমস্ত ছবি খুঁটিয়ে দেখছেন, যদি ডিএনএ-র সামান্য নমুনা পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে ইতিহাসবিদেরা লিপিবদ্ধ করছেন লিয়োনার্দো তাঁর জীবদ্দশায় কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন। সেখানকার জিনিসপত্রও পরীক্ষা করে ডিএনএ-র সন্ধান করা হবে। ডিএনএ-র সামান্য নমুনা থেকে লিয়োনার্দোর গোটা জিনের গঠন পুনর্নির্মাণ করা হবে ক্রেগ ভেন্টর ইনস্টিটিউটে। ক্রেগ ভেন্টর নব্বইয়ের দশকে মার্কিন সরকার পরিচালিত হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টকে হারিয়ে দেওয়ার জন্য বিখ্যাত। তাঁর সংস্থা সেলেরা জিনমিক্সই প্রথম গোটা মানবদেহের সমস্ত জিনের সিকোয়েন্স প্রকাশ করেছিল। বর্তমানে লিয়োনার্দোকে জানতে সেই ভেন্টরের দিকেই তাকিয়ে বিজ্ঞান মহল। সঙ্গে রয়েছেন হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টে কাজ করা একাধিক বিশেষজ্ঞ।

১৯৮৫ সালে শুরু হওয়া মানবদেহের জিনের সম্পূর্ণ সিকোয়েন্স খোঁজার প্রকল্প হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের অফিশিয়াল লোগো ছিল লিয়োনার্দোর আঁকা ‘দ্য ভিট্রুভিয়ান ম্যান’। অদ্ভুত সমাপতন! তখনই কি জানা ছিল মানব জিনের স্বরূপ জানার সবচেয়ে বড় প্রকল্পের সঙ্গে নাম জড়িয়ে যে বিজ্ঞানীদের, তাঁরাই এক দিন উঠেপড়ে লাগবেন ‘দ্য ভিট্রুভিয়ান ম্যান’-এর স্রষ্টারই ডিএনএ সন্ধানে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement