মানুষের শরিকি পরিবারে বৎসরান্তে ভাইয়েরা কাছাকাছি আসে। কিন্তু একে বলা চলে সৌর-পরিবারের ভাইদের কাছাকাছি আসা। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের হিসেব বলছে, পরিবারের বড় ও মেজো সদস্য যথাক্রমে বৃহস্পতি ও শনিকে এত কাছাকাছি আসতে দেখা গিয়েছিল প্রায় ৮০০ বছর আগে। তার পরে ৪০০ বছর পরে এক বার কাছে এলেও তা পৃথিবী থেকে দেখা যায়নি। আজ, সোমবার রাতে ফের ওই দুই গ্রহকে খুব কাছাকাছি দেখতে পাবেন মানুষ। সেই পরিপেক্ষিতে এ বারের এই ‘মহা-সংযোগ’ বা গ্রেট কনজাংশন যথেষ্টই দুর্লভ। যদিও ২০৪০ সালে বৃহস্পতি আবার শনিকে অতিক্রম করবে কিন্তু রাতের আকাশে এই মিলনকে আবার প্রত্যক্ষ করতে অপেক্ষা করতে হবে ২০৮০ সাল পর্যন্ত।
নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে দিন ও রাত, নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন ঋতুর আগমন, আবার বিভিন্ন সময়ে সূর্য ও চন্দ্রের গ্রহণ, ধূমকেতুদের আবির্ভাব ইত্যাদি ঘটনা আমরা প্রায়ই প্রত্যক্ষ করি। তা হলে বৃহস্পতি ও শনির এই মহাসংযোগ এত বছর পরে হয় কেন? কারণ, সৌরজগতের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ গ্রহ বৃহস্পতি সূর্যকে প্রায় ১২ বছরে এক বার প্রদক্ষিণ করে। আর ‘মেজদা’ অর্থাৎ শনি যেহেতু সূর্য থেকে অনেক বেশি দূরে থাকে তাই তার কক্ষপথের পরিধি বৃহস্পতির কক্ষপথের পরিধির চেয়ে অনেক বেশি। আর তাই সূর্যকে এক বার প্রদক্ষিণ করতে তার লাগে প্রায় ২৯.৫ বছর। অর্থাৎ শনি যখন সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ শেষ করে, বৃহস্পতি তখন সুর্যকে দু’বার প্রদক্ষিণ করে ফেলেছে। এর ফলে প্রতি ২০ বছর অন্তর বৃহস্পতি শনিকে অতিক্রম করে এগিয়ে যায় ঠিক যেমন ১০,০০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় চক্কর দেওয়ার সময় দ্রুততম প্রতিযোগী সবচেয়ে পিছনের প্রতিযোগীকে অতিক্রম করে।
আমরা আকাশে জ্যোতিষ্কদের দূরত্ব বা গতি অনুধাবন করতে পারি না, শুধু বিভিন্ন সময়ে তাদের অবস্থান প্রত্যক্ষ করি। আর তাই পৃথিবী থেকে আমরা দেখতে পাই বৃহস্পতি শনির খুব কাছে এসে, তাকে পেরিয়ে আবার দুরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু বৃহস্পতি আর শনি কতটা কাছাকাছি আসছে তা নির্ভর করে পৃথিবীর অবস্থানের উপর। আর সেই অবস্থান অনুযায়ী এ বছর ২১ ডিসেম্বর যখন বৃহস্পতি শনিকে অতিক্রম করবে তখন পৃথিবী থেকে দুটি গ্রহের দূরত্ব হবে ন্যূনতম। সুতরাং তাদের ঔজ্জ্বল্য হবে সব থেকে বেশি। ঠিক এই ধরনের ঘটনা এর আগে ঘটেছিল ১৬২৩ সালের ১৬ জুলাই। কিন্তু তখন পৃথিবীর আকাশে দুটি গ্রহের আপাত অবস্থান ছিল সূর্যের খুব কাছে। তাই তা অনেকেই দেখতে পাননি। শনি ও বৃহস্পতির সাথে পৃথিবী যদি পুরোপুরি একই সরল রেখায় অবস্থান না করে তাহলে শনি বৃহস্পতির পেছনে পুরোপুরি ঢাকা পড়ে না। এবারেও তা হবে না। বরং, শনি ও বৃহস্পতিকে ঠিক গায়ে গায়ে লেগে থাকতে দেখা যাবে। এমনটি শেষবার মানুষ দেখেছিল ১২২৬ সালের ৫ মার্চে।
দেখা হবে দু’জনায়
•কলকাতায় আজ, সোমবার সূর্যাস্ত হবে বিকেল ৪টে ৫৮ মিনিটে। সূর্যাস্তের পরে দক্ষিণ-পশ্চিম দিগন্তে দুই গ্রহকে খুব কাছাকাছি দেখা যাবে
•আকাশে খুব কাছাকাছি থাকলেও দুই গ্রহের দূরত্ব ৭৩ কোটি কিলোমিটার
•কলকাতায় আজ সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৬.৪৫ পর্যন্ত দু’টি গ্রহকে মোটামুটি স্পষ্ট দেখার সম্ভাবনা রয়েছে
•টেলিস্কোপে বৃহস্পতির দু’একটি উপগ্রহও দেখা যেতে পারে
•সন্ধ্যা ৭টা ১২ মিনিটে দু’টি গ্রহই অস্ত যাবে
•২০৪০ সালের নভেম্বর এবং ২০৬০ সালের এপ্রিলেও দুই গ্রহ কাছাকাছি আসবে
•ফের এত কাছাকাছি আসবে ২০৮০ সালের ১৫ মার্চ
তথ্যসূত্র: সঞ্জীব সেন, অধিকর্তা, পজিশন্যাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টার
আরও পড়ুন: টিকার প্রথম ডোজে অ্যালার্জি হলে দ্বিতীয় টিকা না নেওয়ার পরামর্শ আমেরিকায়
সৌরজগতে পৃথিবী, বৃহস্পতি ও শনির নির্দিষ্ট অবস্থানের জন্যই যখন এই দুর্লভ মহাজাগতিক ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করব তখন এই অবস্থানের কিছু মাহাত্ম্য উল্লেখ করা যাক। সূর্য থেকে পৃথিবীর যা দূরত্ব, বৃহস্পতি সূর্য থেকে তার ৫.২ গুণ দুরে আছে। সাম্প্রতিক গবেষণার ফল থেকে মনে করা হয়, জন্মলগ্নে বৃহস্পতি সূর্যের আরও কাছে ছিল এবং ঘন গ্যাসের মধ্যে চক্রাকারে ভ্রমণ করে সে আজ যেখানে মঙ্গল গ্রহ আছে সেখানে চলে এসেছিল। সেই সময় অবশ্য মঙ্গল বা পৃথিবীর মত পাথুরে গ্রহগুলির জন্ম হয়নি। তাদের জন্ম হয় আরও কিছু সময় পরে। কিন্তু সেই সময় জন্ম হয় মেজ ভাই শনির আর তার অভিকর্ষের টানে বৃহস্পতি পেছনে ফিরে যায়। তাই যদি শনির জন্ম না- হত তা হলে সূর্যের খুব কাছে পৃথিবীর চেয়ে প্রায় তিনশো গুণ ভারী এবং দশ গুণ বড় আকারের ‘বড়দা’ পৃথিবীতে প্রাণের অন্তরায় হয়ে উঠত। তা হয়নি উল্টে বড়দা ও মেজদার উপস্থিতি এবং অবস্থান অবশ্য পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব রক্ষা করেছে চলেছে।
আরও পড়ুন: মডার্নার প্রতিষেধককেও ছাড়পত্র দিল আমেরিকা
এই সৌরমণ্ডলের প্রায় শেষ প্রান্তে, নেপচুনের পরেই রয়েছে পাথর, বরফ আর গ্যাসের ‘রাজ্য’ তথা ধূমকেতু আর গ্রহাণুদের আঁতুড়ঘর, যার নাম- ‘ক্যুইপারবলয়’। ‘হ্যালির ধূমকেতু’র মতো যে ধূমকেতুগুলোকে মোটামুটি অল্প সময়ের ব্যবধানে দেখা যায়, তারা আসে এই ক্যুইপার বলয় থেকে। পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা এই ধূমকেতু বা গ্রহাণুগুলোকে বৃহস্পতি আর শনি তাদের জোরালো অভিকর্ষ বলের সাহায্যে নিজেদের দিকে টেনে নেয়। তাই কোটি কোটি বছর ধরে শনি ও বৃহস্পতির ওপর আছড়ে পড়েছে বহু ধূমকেতু, গ্রহাণু বা উল্কা। যদি শনি ও বৃহস্পতির এই আশীর্বাদ না থাকত তাহলে সজোরে পৃথিবীর গায়ে ঘনঘন তাদের ধাক্কা লাগত অথবা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে তারা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেত। সেই টুকরোগুলো ধুলো বালির যে পুরু চাদরের জন্ম দিত, তা আমাদের বায়ুমণ্ডলকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলত। তার ফলে, সূর্যের আলো আর পৃথিবীতে পৌঁছতে পারত না। ফলে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব হত না।
অধ্যাপক, বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজ়িক্স