জন হ্যারিসন ও তাঁর উদ্ভাবিত ঘড়ি
অক্টোবর ২২, ১৭০৭। জিব্রল্টার প্রণালীতে ফ্রান্সের নৌবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফিরছিল পাঁচ বিজয়ী ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম প্রান্তের মাত্র কুড়ি মাইল দূরে ছোট্ট একটি দ্বীপ স্কিলি— ঘন কুয়াশায় ঢাকা রাত্রে হঠাৎই সেখানে ধাক্কা খেল যুদ্ধজাহাজগুলি। কয়েক মিনিটে তলিয়ে গেল মোট চারটি জাহাজ, দু’হাজারেরও বেশি নৌসেনা।
ব্রিটিশ নৌসেনার ভাগ্যে এ হেন বিপর্যয়! এর কারণ অন্য ভাবে সুসজ্জিত হলেও, তাদের ছিল না ঠিক দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের উপায়। গোলাকার পৃথিবীর উপর যে কোনও বিন্দুর অবস্থান জানতে হলে দুটি স্থানাঙ্কের প্রয়োজন— অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ। অষ্টাদশ শতাব্দীরও বহু আগে থেকে নাবিকরা ধ্রুবতারা বা সূর্যের কৌণিক উচ্চতা মেপে অক্ষাংশের প্রায় নির্ভুল আন্দাজ পেতেন, কিন্তু দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের কোনও উপায় জানা ছিল না।
অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভাবা হত, ঠিক দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় এমনই একটি সমস্যা, যার সমাধান অসম্ভব। এর জন্য কত জলযান মহাসমুদ্রে দিক ভুল করে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়েছে, বা অজানা প্রস্তরখণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে। এই সমস্যা এতটাই ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত ১৭১৪ সালে বৃটিশ পার্লামেন্ট ঘোষণা করে, যে কেউ কৌণিক দূরত্ব ১/২ ডিগ্রি (বিষুবরেখার কাছাকাছি যা ৫৫ কিলোমিটারের সমান) ভুলের মাত্রার মধ্যে কোনও জায়গার দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করতে সক্ষম হবে, তাকে ২০,০০০ পাউন্ড পুরস্কার দেওয়া হবে।
মজার কথা হল, জ্যামিতিক দিক থেকে এই সমস্যার সমাধান নীতিগত ভাবে অত্যন্ত সরল। কোন রেফারেন্স রেখা (যেমন গ্রিনউইচ মেরিডিয়ান) থেকে কেউ কতখানি দ্রাঘিমাংশ দূরত্বে আছে জানতে গেলে জানা দরকার সেই রেখার উপর এই মুহূর্তে সময় ঠিক কত। সেই জায়গায় সূর্যের অবস্থান থেকে জানা যাবে স্থানীয় সময়, আর এই দুটি সময়ের ব্যবধান থেকে পাওয়া যাবে ওই স্থানের দ্রাঘিমাংশ (সময়ের দুই মিনিটের ব্যবধান = ১/২ ডিগ্রি)। সে ক্ষেত্রে অবশ্য একটি নির্ভুল ‘ঘড়ি’ সঙ্গে রাখতে হবে, যা থেকে জানা যাবে সেই রেফারেন্স জায়গার ঠিক সময়।
তখনও এমন কোনও ঘড়ি কেউ তৈরি করতে পারেনি, যা মহাসমুদ্রে উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে জাহাজের দুলুনি, ওঠা-পড়া বা তাপমাত্রার সঙ্গে তাল রেখে ঠিক সময় রাখতে পারবে। অন্য দিকে, সেই সময় জ্যোতির্বিজ্ঞান ও পদার্থর্বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হয়েছিল; তাই আইজাক নিউটন সহ অধিকাংশ বিজ্ঞানীরই ধারণা ছিল যে, সময় বা দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় সমস্যার জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক সমাধান ছাড়া অন্য সমাধান অসম্ভব।
ঠিক এ রকম সময়ে জন হ্যারিসন (১৬৯৩-১৭৭৬) নামে ইয়র্কশায়ার-বাসী এক জন স্বশিক্ষিত কাঠের কারিগর সমুদ্রে ব্যবহারের উপযোগী ঘড়ি তৈরির উদ্যোগ নেন। জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক সমাধান পদ্ধতির বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে এটুকু বলা যেতে পারে যে, এর ভিত্তি হল সূর্য এবং নক্ষত্ররাজির মধ্য দিয়ে চাঁদের গতিপথের পর্যবেক্ষণ। সুচারু মাপ ছেড়ে দিলেও এই পদ্ধতির অসুবিধেজনক। খারাপ আবহাওয়ায় জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ঠিকমতো করা যায় না।
জ্যোতির্বিদ্যার সেই অসাধারণ অগ্রগতির যুগেও জন হ্যারিসনের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে এমন একটি যথার্থ, প্রায় নির্ভুল ঘড়ি তৈরি করা সম্ভব, যাতে ঠিক দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের জন্য জটিল এবং সময়সাপেক্ষ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ, গণনা বা সময়-সারণি দেখা— কোনটারই প্রয়োজন হবে না।
১৭২০ সালের মধ্যেই হ্যারিসনের যন্ত্রকুশলতার খ্যাতি এতটা ছড়িয়ে পড়েছিল যে, বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে তিনি টাওয়ার ক্লক তৈরির আমন্ত্রণ পান। ১৭৩০ থেকে ১৭৭০ এর মধ্যে অসাধারণ নির্মাণকুশলতায় হ্যারিসন এইচ১ থেকে এইচ৫— এই পাঁচটি নির্ভুল সময় মাপার যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। ১৭৩৭ সালে তাঁর প্রথম সময়রক্ষক এইচ১ লন্ডন থেকে লিসবনে এবং এর প্রায় পঁচিশ বছর পরে ১৭৬২ সালে পকেট ঘড়ির চেয়ে সামান্য বড় দেখতে এইচ৪, লন্ডন থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জামাইকা পর্যন্ত ৮১ দিনের সামুদ্রিক অভিযানে সাফল্য অর্জন করে। দু’ক্ষেত্রেই দুই মিনিটেরও কম সময়ের অসঙ্গতি দেখা যায়, যা ছিল বোর্ড-নির্দেশিত সর্বাধিক সীমার অনেক কম।
এই দ্বিতীয় সমুদ্রযাত্রা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হ্যারিসনের পুরস্কারের সম্পূর্ণ অর্থ পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বিভিন্ন অসঙ্গত কারণ দেখিয়ে হ্যারিসনকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে বহু দিন বঞ্চিত করে রাখা হয়। শেষ পর্যন্ত ১৭৭৩ সালে রাজা তৃতীয় জর্জের হস্তক্ষেপের ফলে বৃটিশ পার্লামেন্ট হ্যারিসনকে তাঁর প্রাপ্য বাকি অর্থ ‘দান’ হিসাবে দেওয়া হয়।