সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। জেনিভায়।
বিলম্বে হলেও, ভারতের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে হয়ে গেল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। দীর্ঘ দেড় দশকের প্রতীক্ষার পর। ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অফ নিউক্লিয়ার রিসার্চ’ বা ‘সার্ন’-এর অ্যাসোসিয়েট সদস্য হতে চলেছে ভারত। ‘সার্ন’-এর ডিরেক্টর জেনারেল ফ্যাবিওলা জিওনেত্তির সঙ্গে সোমবার মুম্বইয়ে একটি ঐতিহাসিক চুক্তিতে সই করলেন ভারতের পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. শেখর বসু। এর পর কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যাপারে একটি সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে ‘সার্ন’কে তার সম্মতির কথা জানালে আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘সার্ন’-এর অ্যাসোসিয়েট সদস্য হয়ে যেতে ভারতের আর কোনও বাধা থাকবে না। ওই সদস্যপদের জন্য ‘সার্ন’কে এখন থেকে বার্ষিক ৮০ কোটি টাকা চাঁদা দেবে ভারত। এর আগে এশিয়ার একটি মাত্র দেশই আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড়, ব্যয়বহুল ও সর্বাধুনিক গবেষণাগারের পীঠস্থান ‘সার্ন’-এর অ্যাসোসিয়েট সদস্য হতে পেরেছে। পাকিস্তান।
পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. শেখর বসু
বিজ্ঞানীদের সংখ্যাটা ৮০ থেকে একলাফে দ্বিগুণ বাড়লে, তার সুফল কী হতে পারে, তা বুঝে উঠতে ১২টা বছর লেগে গেল ভারতীয় রাজনীতিকদের!
আর দেশের ‘গ্রিড কম্পিউটিং’ ব্যবস্থা দশ গুণ বেশি দ্রুত হয়ে উঠলে তা আমজনতার যাপনকে কতটা সহজতর করে তুলতে পারে, তা ঠাওর করতে তাবড় তাবড় ভারতীয় রাজনীতিকদের লেগে গেল প্রায় দেড় দশকেরও বেশি সময়!
এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নততর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে কী ভাবে লাভবান হতে পারে ভারত?
ফের্মিল্যাবে কর্মরত সুনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়
আমেরিকার ‘ফের্মিল্যাব’-এ কর্মরত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কণাবিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ বলছেন, ‘‘এই চুক্তি ভারতের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। কারণ, এই চুক্তির ফলে আগামী দিনে ভারতীয় ছাত্র, শিক্ষক, গবেষকরা ‘সার্ন’-এ গিয়ে কাজ ও গবেষণার সুযোগ তো আরও অনেক বেশি করে পাবেনই, শিল্পের উন্নতি ভারতের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনেও নেবে বৈপ্লবিক ভূমিকা।’’
আর সেই সুফলটা আমরা বুঝতে পারব কী ভাবে?
বিশিষ্ট কণাবিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ
কলকাতার ‘ভেরিয়েব্ল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার’-এর প্রাক্তন অধিকর্তা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কণাবিজ্ঞানী বিকাশ সিংহের কথায়, ‘‘এর ফলে দেশের যাবতীয় ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি আর সেই সব যন্ত্র-নির্ভর যাবতীয় কর্মকাণ্ড অনেক বেশি দ্রুততর হয়ে উঠতে পারবে। ফাস্ট ইলেকট্রনিক্স ও ফাস্ট কম্পিউটিং-এর ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বে এই মূহুর্তে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছি। ওই ঘাটতি পোষাতে এখন আমরা বহু ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি আমদানি করি জাপান, আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলি থেকে। কিন্তু এ বার যদি আমরা ‘সার্ন’-এর দৌলতে আমাদের দেশের ইলেকট্রনিক্স ও কম্পিউটিং ব্যবস্থাকে অন্তত দশ গুণ দ্রুততর করে তুলতে পারি ‘গ্রিড কম্পিউটিং’ ব্যবস্থার মাধ্যমে আর তার মাধ্যমে যদি আমরা অতিবেগুনি রশ্মি থেকে বেরিয়ে আসা কণাগুলির চলাচলের পথটাকে এক সেকেন্ডের এক কোটি ভাগেরও কম সময়ের মধ্যে দেখার প্রযুক্তি অর্জন করতে পারি, তা হলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে সিগন্যাল পাঠানোর গতি অনেক অনেক গুণ বেড়ে যাবে। যার ফলে, বিমান চলাচল দ্রুততর ও আরও বেশি নিরাপদ করা সম্ভব। আরও নিখুঁত করে তোলা যাবে উপগ্রহ-মারফত যোগাযোগব্যবস্থা। আরও কম সময়ে উপগ্রহগুলিকে পাঠানো যাবে কক্ষপথে। ফলে, উপগ্রহের জ্বালানিরও সাশ্রয় হবে। আর খনিজ পদার্থের সন্ধান, ভূস্তরের পরিবর্তন, ভূগর্ভস্থ জলস্তরের পরিমাণ ও পরিবর্তন বোঝা ও সামুদ্রিক সম্পদের অনুসন্ধান করতে বিভিন্ন কক্ষপথে পাঠানো উপগ্রহগুলির কাজকে সহজতর করবে, তাদের পাঠানো ছবি ও তথ্যের মান ও গতি অনেক গুণ বেশি হবে। সেগুলি আরও বেশি নিখুঁত হয়ে উঠতে পারবে।’’
শুধুই প্রযুক্তির উন্নতি নয়, এর ফলে ভারতীয় বিজ্ঞানী, ছাত্র, গবেষক, শিক্ষকদের ‘সার্ন’-এর আবিষ্কৃত নিত্যনতুন প্রযুক্তিগুলি জানতে আর সেগুলিকে নিজের দেশে কাজে লাগাতে অনেক বেশি দক্ষ করে তুলতে পারবে অনেক কম সময়ে। যে উপকারটা ‘সার্ন’-এর প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন পাচ্ছে ফ্রান্স, ইতালি ও জার্মানি। এখন মোট ৮০/৮৫ জন ভারতীয় বিজ্ঞানী কাজ করেন ‘সার্ন’-এ। এই চুক্তির ফলে সেই সংখ্যাটা লাফিয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। ‘এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে’-এর মাধ্যমে বিদেশি বিজ্ঞানীদের এ দেশে আনার প্রক্রিয়াটাও হয়ে যাবে সহজতর।’’