নেপচুনে অরোরা।
তুমি না থাকলে আমাদের বেঁচে থাকাই হত না!
তুমি না থাকলে এই পৃথিবীতে কোনও প্রাণই টিঁকে থাকতে পারত না।
প্রাণের জন্ম হলেও, তা এক লহমায় নিঃশেষ হয়ে যেত দামাল সৌরঝড়ের ঝাপটায়।
অরোরা, তুমি না থাকলে...!!!
এমনটাই জানাচ্ছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তাঁদের বক্তব্য, পৃথিবীর দুই প্রান্তে থাকা ‘বরফের দেশ’- সুমেরু (উত্তর মেরু) আর কুমেরু (দক্ষিণ মেরু)-তে যদি না দেখা যেত অরোরা- ‘অরোরা বোরিয়ালিস’ আর ‘অরোরা অস্ট্রালিস’, তা হলে আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব হত না। পৃথিবীতে প্রাণের জন্ম হওয়ার এক লহমার মধ্যেই সৌর ঝড় আর মহাজাগতিক বিকিরণের ‘করাল গ্রাসে’ নিঃশেষ হয়ে যেত প্রাণ। আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহকে তখন মঙ্গলের মতোই মরুভূমি হয়ে যেতে হত! হয়তো বাতাসে ভাসত সেই অনুরণন-‘অবনী, বাড়ি আছ?’
বাড়ি তো দূর অস্ত্ই, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, প্রাণের বিবর্তনই হত না এই বাসযোগ্য গ্রহে। জল থাকলেও শুকিয়ে যেত সব সাগর-মহাসাগর। যেন সেই জল কেউ শুষে নিয়েছে! এই আমাদের বাসযোগ্য গ্রহের বায়ুমণ্ডলে এত যে অক্সিজেন অণুর ছড়াছড়ি, যার জন্য পৃথিবীতে প্রাণের জন্ম সম্ভব হয়েছিল কোনও কালে, সেই অক্সিজেনও উধাও হয়ে যেত, চটজলদি। প্রাণের জন্মের জন্য আর যা জরুরি, সেই জৈব অণুও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেত। যাকে বলে, প্রাণের দফা-রফা।
দেখুন গ্যালারি-ভিন গ্রহের অরোরার অপরূপ দৃশ্য
বেঙ্গালুরুর রামন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক, জ্যোতির্পদার্থবিদ বিমান নাথ জানাচ্ছেন, ‘‘এই পৃথিবীতে এমন কিছু ভয়ঙ্কর ও ভয়ঙ্কর সুন্দর প্রাকৃতিক নিয়ম রয়েছে, যেগুলি না থাকলে প্রাণের জন্ম হলেও তার বিকাশ হত না। বিবর্তনও হত না। সেই প্রাণ ধ্বংস হয়ে যেত। সেই নিয়মগুলির মধ্যে যেমন রয়েছে ভয়ঙ্কর সুন্দর ‘অরোরা বোরিয়ালিস’ আর ‘অরোরা অস্ট্রালিস’, তেমনই রয়েছে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প আর অগ্ন্যুৎপাতও। তবে এটাও ঠিক, গ্রহগুলির চৌম্বক ক্ষেত্র না থাকলে অরোরারও জন্ম হত না। আর এই সৌরমণ্ডলে মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন ও প্লুটোর মতো গ্রহগুলির চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর মতো অতটা শক্তিশালী নয়। ফলে, এই সৌরমণ্ডলের ভিন গ্রহগুলিতে অরোরা দেখা গেলেও, সেগুলি পার্থিব অরোরার মতো অতটা মনোরম নয়। তাই অরোরার সৌন্দর্যের নিরিখে এগিয়ে রয়েছে আমাদের বাসযোগ্য গ্রহই।’’
ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, তুমি না থাকলে...?
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এই বাসযোগ্য গ্রহে প্রাণের বিকাশ বা বিবর্তন- কোনওটাই সম্ভব হত না। প্রাণ ‘স্থবির’ হয়ে পড়ত! জীবন যে বড়ই জঙ্গম! এগিয়ে যেতে চায়। থমকে থাকতে চায় না।
ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, তুমি না থাকলে...?
বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী সুজন সেনগুপ্ত জানাচ্ছেন, ‘‘ওই দু’টি না থাকলে, প্রাণের বিকাশ বা বিবর্তন সম্ভবই হত না আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহে। তা আর বাসযোগ্যও থাকত না। কারণ, ভূমিকম্প আর অগ্ন্যুৎপাতই পৃথিবীতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণকে নির্দিষ্ট মাত্রায় বেঁধে রাখে। যা কমে গেলে পৃথিবী জমাট বাঁধা বরফের গ্রহ হয়ে যেত। কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃষ্টির জলে ধুয়ে গিয়ে কার্বনিক অ্যাসিড হয়ে যায়। তা মাটির সিলিকেটের সঙ্গে মিলে-মিশে যায়। এটাকে বলে ‘কার্বন-সিলিকন চক্র’। এর ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা কমে যেত। পৃথিবী অসম্ভব ঠাণ্ডা হয়ে গিয়ে আর বাসযোগ্য থাকত না। ভূমিকম্প আর অগ্ন্যুৎপাত হলে সেই কার্বন ডাই-অক্সাইড বেরিয়ে এসে সেই মাত্রাটাকে আবার ধরে রাখে। ভূমিকম্প বা অগ্ন্যুৎপাতের প্রমাণ এখনও পর্যন্ত মেলেনি বলেই, আমরা এখন একটা বিষয়ে নিশ্চিত, মঙ্গল গ্রহে যদি কোনও কালে ‘প্রাণে’র জন্ম হয়েও থাকে, তা হলেও তার বিকাশ হয়নি। সেই ‘প্রাণ’ কোনও দিনই বিবর্তনের সুযোগ পায়নি মঙ্গলে। আসলে ভূমিকম্প আর অগ্ন্যুৎপাত হলে গ্রহের ভূ-স্তরের গঠনের পরিবর্তন হয়, শক্তির পুনর্বিন্যাস ও পুনর্বণ্টন হয়। যা প্রাণের বিবর্তনকে দারুণ ভাবে সাহায্য করে।’’
আর অরোরা, তুমি না থাকলে...?
সুজনবাবুর কথায়, ‘‘সূর্য থেকে সৌরঝড়ের মাধ্যমে এক সেকেন্ডের কয়েক লক্ষ কোটি ভাগের মধ্যে যে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি অসম্ভব শক্তিশালী, তেজস্ক্রিয় কণা আমাদের পৃথিবী ও সৌরমণ্ডলের অন্য গ্রহগুলির ওপর এসে পড়ছে, চৌম্বক ক্ষেত্র না থাকলে তা প্রাণকে নিঃশেষ করে দিত এক লহমায়। কিন্তু, চৌম্বক ক্ষেত্র ওই কণাগুলিকে টেনে নিচ্ছে আর তার ফলেই জন্ম হচ্ছে রোমাঞ্চকর ওই আলোর বর্ণালী- ‘অরোরা বোরিয়ালিস’ আর ‘অরোরা অস্ট্রালিস’। যে গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্র যত শক্তিশালী আর যে গ্রহ সূর্যের যত বেশি কাছাকাছি, তার অরোরার উজ্জ্বলতা তত বেশি। কারণ, সূর্যের থেকে বেশি দূরে থাকলে, সেই গ্রহকে সৌরঝড়ের ঝাপটা কম সামলাতে হয়। সৌর-কণা কম আসে সেই ভিন গ্রহে। ফলে তাদের অরোরার উজ্জ্বলতা কমে যায়।’’
ফলে, অরোরা তুমি না থাকলে... আমাদের পক্ষে টিঁকে থাকাটাই হত না!