ঠিক কিসের টানে আমাদের পূর্বপুরুষেরা বার বার ফিরে এসেছিল ডেনিসোভা গুহায়? সাইবেরিয়ার আল্টাই পর্বতের মাঝে সারা বছর স্যাঁতসেঁতে গুহা ডেনিসোভা। এখানে নিয়ান্ডারথাল, আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ ও ডেনিসোভানরা বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় নিয়েছিল। মানুষের বিবর্তন সরলরৈখিক নয়, বরং জালের মতো। বিবর্তনে অন্তত ১৫টি প্রজাতির আদিম মানুষের আগমন হয়েছিল, যারা বিভিন্ন সময়ে আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষের সঙ্গে সহাবস্থান করেছিল। আধুনিক মানুষের সঠিক পূর্বপুরুষের পরিচয় আজও ধূসর। মানব বিবর্তনের রাস্তা একটা চমকপ্রদ অধ্যায়, এখনও যার জট ছাড়ানো চলছে।
এক দশক আগে জার্মানির ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউটের গবেষণায় জানা গিয়েছিল ডেনির বংশ পরিচয়। তেরো বছরের এই একরত্তি মেয়ে প্রায় ৯০ হাজার বছর আগে গুহারই বাসিন্দা ছিল। তার আঙুলের হাড় থেকে পাওয়া ডিএনএ বলে দিল তার বাবা ডেনিসোভান আর মা নিয়ান্ডারথাল। ডেনির নিয়ান্ডারথাল মা পূর্ব ইউরোপের ক্রোয়েশিয়া থেকে এসেছিল সাইবেরিয়ায়। ডেনিসোভান ডিএনএ কিন্তু এখনও বহন করে চলেছে মাকালু আর নিউগিনি দ্বীপপুঞ্জের প্রাচীন গাঢ় ত্বকের স্বর্ণকেশী অধিবাসী মেলানেশিয়ানরা। স্বর্ণকেশী ইউরোপিয়ানরা এদের থেকে আলাদা। সম্ভবত তিব্বতিদের উচ্চতাজনিত অভিযোজনের জন্যও প্রয়োজনীয় জিন ডেনিসোভানদের অবদান। তবে কি ডেনিসোভানরা তিব্বতেও এসেছিল? ২০২০ সালের নভেম্বরে সায়েন্স পত্রিকায় বিজ্ঞানীরা প্রকাশ করলেন, সাইবেরিয়ার আল্টাই থেকে ২৮০০ কিলোমিটার দূরে, আজ থেকে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে ডেনিসোভানরা তিব্বতের বৈশিয়া ক্রাস্ট গুহাতেও বসবাস করেছিল। তীব্র শীত ও উচ্চতায় বাঁচতে শিখেছিল এরা।
কেমন দেখতে এই ডেনিসোভানরা? একটা আঙুল, তাও আবার অর্ধেক, তিনটে দাঁত, কিছুটা চোয়াল আর খানিকটা খুলি— এই সম্বল করেই কম্পিউটারে তৈরি হয়েছে প্রতিকৃতি। চওড়া বুক ও কোমর, গায়ের রং গাঢ়, চোখ ও চুল খয়েরি, ঢালু কপাল, লম্বা নাক, নীচের বড় চোয়াল সামনের দিকে বাড়ানো। আধুনিক মানুষ নয়, এদের সঙ্গে নিয়ান্ডারথালদেরই বেশি সাদৃশ্য। তবে বিবর্তনের ধারায় আধুনিক মানুষের সব আত্মীয়রাই আজ বিলুপ্ত। শিম্পাঞ্জি, গরিলা, বোনোবো, ওরাংওটাং ও মানুষ নিয়ে গঠিত পরিবারের নাম গ্রেট এপ। আমাদের সবচেয়ে কাছের আত্মীয় শিম্পাঞ্জিরাই। একটা সময় ছিল, যখন শিম্পাঞ্জি ও মানুষকে আলাদা করা যেত না। শিম্পাঞ্জি ও মানুষের আলাদা হওয়াটা মাত্র ৭০ লক্ষ বছর আগে, ইতিহাসকে জীবন্ত করে জীবাশ্ম বা ফসিল। সেই সময়ের শিম্পাঞ্জিদের কোনও জীবাশ্মীভূত হাড়গোড় পর্যন্ত নেই। বিচ্ছেদের সেই ইতিহাস তাই আজও অজানা। মানুষের বংশলতিকার কাঠামো বারেবারে পরিবর্তিত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ান্ডারথাল, ডেনিসোভানদের ফসিলের উপস্থিতি বিবর্তনের ইতিহাসকে নতুন মাত্রা ও দিশা দিয়েছে।
ইথিয়োপিয়াতে পাওয়া গিয়েছিল আরডিপিথেকাস, বয়স ৪০ লক্ষ। অর্থাৎ, মানুষ ও শিম্পাঞ্জি বিচ্ছেদের ঠিক পরেই এদের আবির্ভাব। এরা ভাল ভাবে হাঁটতেই পারত না। মনে করা হয়, কোমরের নতুন পেশির সঙ্গে পায়ের হাড়ের সামান্য পরিবর্তনে শিম্পাঞ্জিকে গাছে ফেলে রেখে মাটিতে নেমে আসে মনুষ্যমুখী বংশতালিকায় আদি পুরুষ, আরডিপিথেকাস।
ডেনিসোভা গুহায় মানব বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা আশ্রয় নিয়েছিল।
মানব বিবর্তনের ইতিহাসে নতুন সংযোজন ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইভলিউশনারি অ্যানথ্রোপলজি-র গবেষণা। ২০২০-র সেপ্টেম্বর মাসে সায়েন্স পত্রিকায় প্রকাশিত সেই গবেষণায় মিলল বিবর্তনের অমীমাংসিত জটিল ধাঁধার উত্তর। এত দিন মাইটোকনড্রিয়া এবং দেহকোষের ডিএনএ-র সাহায্যে মানব বিবর্তনের ইতিহাস লেখা হয়েছিল। এ বারে দু’টি ডেনিসোভান ও তিনটি নিয়ান্ডারথালের ‘ওয়াই’ ক্রোমোজ়োম-এর সাহায্যে দেখা গেল, প্রায় সাত লক্ষ বছর আগে মানব বিবর্তনের মূল স্রোত থেকে আলাদা হয় এবং সাড়ে তিন লক্ষ বছর আগে নিয়ান্ডারথাল আমাদের পূর্বপুরুষদের থেকে পৃথক হয়েছে। জানা গেল, নিয়ান্ডারথাল মাইটোকনড্রিয়ায় ডেনিসোভান জিনের প্রকাশ ছিল, যা সময়ের সঙ্গে মুছে গিয়েছে। আফ্রিকায় মানুষের হোমো গণের শুরুটা পঁচিশ লক্ষ বছর আগে, অস্ট্রালোপিথেকাস নামক দ্বিপদী থেকে। প্রায় কুড়ি লক্ষ বছর আগে প্রথম বার এক দল পূর্ব আফ্রিকা থেকে বাকি পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া শুরু করেছিল। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিপদসঙ্কুল অচেনা অরণ্যে লড়াইয়েই জন্ম নিয়েছিল আরও নতুন প্রজাতি। ইউরোপে নিয়ান্ডারথাল, পূর্ব এশিয়াতে হোমো ইরেক্টাস, জাভা দ্বীপপুঞ্জে হোমো সোলোয়নসিস (সোলো মানব), ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোর দ্বীপপুঞ্জে ফ্লোরেসিয়েনসিস (হবিট)। হঠাৎ করে সমুদ্রস্তর বেড়ে যাওয়াতে প্রত্যন্ত দ্বীপে আটকে পড়ে হবিট জনগোষ্ঠী। মনে করা হয় পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে এদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়েছিল। উচ্চতা ছিল মেরেকেটে এক মিটার। এরা পাথরের সামগ্রী তৈরিতে সক্ষম ছিল। আট লক্ষ বছর আগে মানব ইতিহাসে হঠাৎ আগুন আবিষ্কার। আগুনের ব্যবহার খাদ্য পরিপাক পদ্ধতিকে আমূল বদলে আমাদের পূর্বপুরুষকে বেশ খানিকটা এগিয়ে দিয়েছিল। বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে বিজ্ঞানীরা আজও সর্বসম্মত নন। সম্ভবত আড়াই লক্ষ বছর আগে পূর্বেরই কোনও প্রজাতি বিবর্তিত হয়ে হোমো সেপিয়েন্সের আগমন হর্ন অব আফ্রিকায়, যারা ৭০ হাজার বছর আগে দ্বিতীয় বার আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে আসে। আমাদের পূর্বপুরুষের সঙ্গে পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপে নিয়ান্ডারথালদের নিশ্চিত সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তারা তখন আগুন ও অস্ত্রে পারদর্শী, ঠান্ডাতে অভ্যস্ত। মানব বিবর্তনের এই সময় সংঘাত নাকি সহাবস্থান, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক। আধুনিক মানবের পূর্বপুরুষের নিরন্তর প্রয়াস ও সমন্বয়ের জোরে, নিয়ান্ডারথাল পিছু হটে আজ বিলুপ্ত। অন্য মতে, আধুনিক মানুষ নিয়ান্ডারথালের সঙ্গে প্রজনন করে, যার ছাপ ইউরোপিয়ানদের জিন মানচিত্রে আজও প্রকট।
অপর দিকে পূর্ব এশিয়ায় হোমো ইরেক্টাস প্রজাতির জিন রয়েছে চিনা ও কোরিয়ানদের শরীরে। ২০ লক্ষ বছর আগে এই হোমো ইরেক্টাসের সঙ্গে বসবাস করত পারআন্থোরোপাস রোবাস্টাস। ২০২০-এর নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার গুহায় তাদের অস্তিত্বের কথা জানা গেল।
মানব বিবর্তনের গোড়া থেকে এমনই বহু অজানা চরিত্রের আগমন ঘটেছে, যারা বদলে যাওয়া প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। আধুনিক মানুষ বিবর্তনের পথে এমন বহু আত্মীয়দের হারিয়েছে, যাদের পরিচয় অনেকাংশে অজানা হলেও গুরুত্ব অপরিসীম।
বিবর্তনের কোন পরিকল্পনায় টিকে গিয়েছে মানুষের আধুনিক প্রজাতি? জার্মানির এক গুহাতে আবিষ্কার হয়েছিল ৩২ হাজার বছরের পুরনো প্রথম মানব শিল্প, ভাস্কর্য ‘লায়নম্যান’— মানুষের দেহ ও সিংহের মুখ। অর্থাৎ, তখনই মানুষ কল্পনা করতে শিখেছিল। মানুষের গল্প বলার শুরুটা সেই থেকেই। কল্পনাশক্তিই তো টিকিয়ে রাখে আধুনিক মানুষকে।
অধ্যাপক, কেশপুর কলেজ, মেদিনীপুর