প্রতীকী ছবি
দু’বছরের অতিমারি পর্বে নিজেকে বেশ কিছুটা গুটিয়ে রাখার পর আবার দাপটে ফিরতে চলেছে ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু ভাইরাস। সেই সময়ও খুব দূরে নেই। সেপ্টেম্বরের শেষের দিক থেকে শুরু করে ফ্লু ভাইরাসের দাপট চলবে শীতকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত। ওই সময়টা আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠবে ‘ফ্লু মরসুম’। শুরু হবে আরও একটি নতুন পর্বের। যার নাম ‘টুইনডেমিক’। একই সঙ্গে করোনাভাইরাস ও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মহামারী।
একক ভাবে আমেরিকার পিট্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পিট্সবার্গের যৌথ ভাবে করা দু’টি গবেষণা এই উদ্বেগজনক খবর দিয়েছে।
একটি গবেষণায় অশনি সঙ্কেত— অতিমারির আগে বিশ্বে ফি বছর গড়ে যে সংখ্যায় ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হত, আসন্ন ফ্লু মরসুমে (২০২১-’২২) সেই সংখ্যা কম করে এক লক্ষ থেকে চার লক্ষ বাড়তে চলেছে। দু’টি গবেষণাপত্রই ‘পিয়ার রিভিউ’ পর্যায় পেরিয়ে একটি আন্তর্জাতিক চিকিৎসা গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত হতে চলেছে। এখন সেই গবেষণাপত্রগুলি পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনে।
তবে শুধুই উদ্বেগের ছবি আঁকেনি ওই দু’টি গবেষণা। আসন্ন বিপদ থেকে বেরিয়ে আসারও পথ দেখিয়েছে। জানিয়েছে, এখন যে হারে গোটা বিশ্বে ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা দেওয়া হচ্ছে, তা আরও ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়াতে হবে। সেটা সম্ভব হলে আসন্ন বিপদ হয়তো কিছুটা সামাল দেওয়া যাবে। পিট্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেল্থ ডায়নামিক্স ল্যাবরেটরির অধিকর্তা মার্ক রবার্টস বলেছেন, “আরও বেশি টিকা। আরও আরও বেশি টিকাকরণই আসন্ন ফ্লু মরসুমের বিপদ সামলে ওঠার একমাত্র উপায় হয়ে উঠতে পারে। মনে রাখতে হবে, কোভিড টিকা দেওয়া নিয়ে এখন আমরা ব্যস্ত থাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা দেওয়াতে পারছি না।” রবার্টস এ-ও জানিয়েছেন, এর জন্য শুধু সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা দায়ী নয়। দায় রয়েছে টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিরও। দ্রুত আরও বেশি পরিমাণে কোভিড টিকা উৎপাদন করতে গিয়ে হয় তাদের ফ্লু-সহ অন্যান্য জরুরি টিকার উৎপাদন সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখতে হয়েছে। অথবা উৎপাদনের পরিমাণ কমাতে হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (‘হু’)-র পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, অতিমারি শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অন্তত ৯ শতাংশ মানুষ ফি বছর আক্রান্ত হতেন ইনফ্লুয়েঞ্জায়। সংখ্যার নিরিখে কম করে ১০০ কোটি। তাঁদের মধ্য ৩০ থেকে ৫০ কোটি রোগীর ক্ষেত্রে ফ্লু ভয়াবহ হয়ে উঠত। ফ্লু-এ মৃতের সংখ্যা গড়ে থাকত ৩ কোটি থেকে ৫ কোটি। ছবিটা আরও ভয়াবহ ছিল ভারতের ক্ষেত্রে। ২০১৮ সালে ভারতে ইনফ্লুয়েঞ্জায় প্রায় দু’কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ওই বছর বিশ্বে ফ্লু-এ আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ভারতেই।
তবে গবেষণাপত্রদু’টি জানিয়েছে, অতিমারি পর্বের গত দু’বছরে ফ্লু ভাইরাসের দাপট অনেকটাই কমে গিয়েছিল আমেরিকা-সহ গোটা বিশ্বে। কারণ, ওই সময় সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ববিধি মেনে চলা হচ্ছিল কঠোর ভাবে। স্কুলগুলি একনাগাড়ে মাসের পর মাস বন্ধ ছিল। মাস্ক খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। লকডাউন ও অন্যান্য কারণে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মানুষের ভ্রমণও উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গিয়েছিল। ফলে, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। তাই ১৯১৮ সালে ফ্লু-এর প্রথম অতিমারি হওয়ার পর গত মরসুমেই বিশ্বে ফ্লু-এ আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে কম। ফ্লু-এর গত মরসুমে (২০২০-’২১) আমেরিকায় ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃত্যুর হার কমে গিয়েছিল ৯৫ শতাংশ। গত মরসুমে আমেরিকায় প্রতি ১ লক্ষ মানুষের মধ্যে ফ্লু-এ আক্রান্ত হওয়ায় মাত্র চার জনকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল। যে সংখ্যাটি তার আগের মরসুমেও (২০১৯-’২০) ছিল ৭০।
গবেষণাপত্রদু’টির বক্তব্য, এই অতিমারির সময় ফ্লু ভাইরাসের সংক্রমণ কমে যাওয়ায় মানবশরীরের অ্যান্টিবডিগুলি ফ্লু অ্যান্টিজেনকে চেনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ফ্লু-এ ঘনঘন সংক্রমিত হওয়া আর ফ্লু-এর টিকাকরণের জেরে মানবশরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডিগুলি ফ্লু ভাইরাসকে রোখার ব্যাপারে যতটা দক্ষ হয়ে উঠেছিল অতিমারি শুরুর আগে, গত দু’বছরে অ্যান্টিবডিগুলির সেই দক্ষতা স্বাভাবিক ভাবেই কমে গিয়েছে। এটাই আসন্ন ফ্লু মরসুমে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসকে আরও ভয়ঙ্কর, আরও বিধ্বংসী করে তুলেছে বলে অশনি সঙ্কেত দেওয়া হয়েছে দু’টি গবেষণাপত্রে।