ইনসেটে, দিল্লি আইআইটি-র অধ্যাপক জয়ী ঘোষ।
আমার, আপনার আলাপচারিতার মাঝে যাতে অবা়ঞ্ছিত কেউ ঢুকে পড়তে না পারে তার জন্য এক অভিনব উপায়ে দুই যমজ ভাইয়ের জন্ম দিয়েছেন কলকাতার বাঙুর অ্যাভিনিউয়ের জয়ী ঘোষ।
জন্মের পর এই দুই যমজ ভাইকে একে অন্যের থেকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দিলেও এক ভাইয়ের কিছু আচার, আচরণ বদলালে মূহুর্তের মধ্যে একই ভাবে বদলে যায় অন্য ভাইয়েরও কিছু কিছু আচার, আচরণ। দু’জনের জীবন যেন একই সূত্রে বাঁধা। এই দুই যমজ ভাই আদতে আলোর কণা ‘ফোটন’।
যেন তারা একে অন্যকে দেখে বদলে গিয়েছে! অথবা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছে, ‘তুই যে ভাবে বদলেছিস, আমিও ঠিক সেই ভাবেই বদলে নিলাম নিজেকে। তোর থেকে অনেক দূরে থেকেও। তোকে না দেখেও।’
দুই যমজ ভাই ও জয়ী
অথচ একই ভাবে বদলে যাওয়ার জন্য দুই যমজ ভাইয়ের মধ্যে সরাসরি টেলিফোনে কথাবার্তা হয়নি। বার্তা বিনিময় হয়নি হোয়াটস্অ্যাপ বা ই-মেলেও। এক ভাইয়ের বদলে যাওয়ার কথা অনেক দূরে থাকা অন্য ভাইয়ের কানে পৌঁছে দিতে দরকার হয়নি কোনও ‘রানার’ বা বার্তাবাহকেরও। এক ভাই নিজের রং বদলালে অনেক দূরে অন্য ভাইয়েরও রং বদলে যায়। বিজ্ঞানের পরিভাষায়, এটাই ‘কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট’।
এমন দুই যমজ ভাইয়ের জন্ম দেওয়া আর তাদের মাধ্যমে কোনও বার্তাকে অবিকল, অবিকৃত ভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় একেবারে নিরাপদে পাঠিয়ে দেওয়ার একটি বিশেষ পদ্ধতির দিশা দেখিয়েছেন দিল্লির ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি দিল্লি)’-র পদার্থবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক জয়ী ঘোষ।
‘কোয়েস্ট’-এ জয়ী
যা আগামী দিনে আমাদের ব্যাঙ্কের আমানতকে অনেকটাই সুরক্ষিত করে তুলতে পারবে। হ্যাকার হানাদারির হাত থেকে বাঁচাতে পারবে। শত্রুদের নজর এড়াতে পারবে দেশের প্রতিরক্ষার অত্যন্ত গোপনীয় তথ্যাদি। গুরুত্বপূর্ণ মহাকাশ অভিযানের তথ্য বা পরিকল্পনা অন্য কোনও অবাঞ্ছিত দেশ জেনে ফেলতে পারবে না।
দিল্লি আইআইটি-তে তাঁর গবেষণাগারে অধ্যাপক জয়ী ঘোষ।
তথ্যের সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে জয়ী এই কাজটি করছেন কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের (ডিএসটি) অর্থানুকুল্যে। ‘কোয়ান্টাম এনহ্যান্সড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (কোয়েস্ট)’-প্রকল্পের অধীনে মোট ৫১টি প্রকল্পের মধ্যে যেগুলির নেতৃত্বে রয়েছেন বাঙালিরা, জয়ীর প্রকল্প তার অন্যতম।
দিনকে দিন হ্যাকার হানাদারি যে ভাবে বাড়ছে বিশ্বজুড়ে তাতে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাকে (‘টেলিকমিউনিকেশন্স’) প্রায় ১০০ শতাংশ সুরক্ষিত ও নিরাপদ করার প্রয়োজনটাই সবচেয়ে জরুরি হয়ে পড়েছে।
আর সেটা করতে জয়ী কোনও প্রথাগত যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করেননি তাঁর প্রকল্পে। যার নাম- ‘ইন্টিগ্রেটেড সোর্সেস অব ফোটনস ফর কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন অ্যান্ড ইনফর্মেশন অ্যাপ্লিকেশন’।
হ্যাকিং কেন অসম্ভব এই টেলিযোগাযোগে?
কোয়ান্টাম ফিজিক্স দ্বারা সুরক্ষিত বার্তা-চালাচালিকে হ্যাক করতে পারবে না কোনও কোয়ান্টাম কম্পিউটারও।
সেটা করতে গেলেই দুই যমজ ফোটনের অন্য জন সেটা বুঝে ফেলবে। তখন দূরে থাকা তার যমজ ভাইয়ের আচার, আচরণ বদলে যাওয়ার বার্তাটা সে আর নেবেই না।
হ্যাকিংয়ের বিরুদ্ধে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের এই হাতিয়ার ধরার উপায় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্রগুলির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে। তারই ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফির বিভিন্ন পদ্ধতি।
দিল্লি আইআইটি-তে গবেষকদলের সঙ্গে অধ্যাপক জয়ী ঘোষ।
কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্টের উপর ভিত্তি করেই একটি কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফির পরিকল্পনা জয়ীর। যার মাধ্যমে সবচেয়ে সুরক্ষিত টেলিযোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে।
প্রকল্পের আরও একটি লক্ষ্য, দুই যমজ ভাই ও এনট্যাঙ্গল্ড ফোটনদের বহুমুখী করে তোলা। যাতে তাদের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগব্যবস্থার ক্ষমতা ও গতি আরও বাড়ানো যায়।
কলকাতা থেকে কোয়ান্টামের পথে ...
কলকাতার বাঙুরের জয়ীর স্কুল ক্যালকাটা গার্লস। কলেজ লেডি ব্রেবোর্ন। তার পর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স এবং পিএইচডি। প্রথম পোস্ট ডক্টরাল স্পেনে। দ্বিতীয় পোস্ট ডক্টরাল জার্মানিতে। আর তৃতীয় পোস্ট ডক্টরাল আমেরিকায়। পড়াশোনা সেরে অধ্যাপনা শুরু দিল্লির আইআইটি-তে। জয়ী জাতীয় কোয়ান্টাম মিশনের অন্যতম সদস্য। তিনি সদস্য কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন্স ওয়ার্কিং গ্রুপেরও।
টেলিযোগাযোগের আদর্শ ব্যান্ডেও জয়ী
কোনও প্রথাগত টেলিযোগাযোগব্যবস্থাই পুরোপুরি সুরক্ষিত ও নিরাপদ হতে পারে না। তাই জয়ীর হাতিয়ার হয়েছে ‘কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন্স’। যা তাত্ত্বিক ভাবে ১০০ শতাংশ সুরক্ষিত। আর সেটা জয়ী করে দেখাতে পারছেন টেলিকমিউনিকেশনের আদর্শতম ব্যান্ডে। ১ হাজার ৫৫০ ন্যানো মিটারে।
কেলাস আর লেজার রশ্মির খেল
এই কোয়ান্টাম কমিউনিকেশনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত টেলিযোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য জয়ীকে দুই যমজ ভাইয়ের জন্ম দিতে হয়েছে। যে জন্মের প্রক্রিয়াটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই দুই যমজ ফোটনের অবস্থাকে বলা হয়- ‘এনট্যাঙ্গল্ড স্টেট’। যা কোয়ান্টাম যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য খুবই জরুরি।
আলোর কণার মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ।
স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সেই দুই যমজ ভাইয়ের জন্মানোর জন্য জয়ী ব্যবহার করেছেন লিথিয়াম নাওবেটের কেলাস। আর তার উপর ফেলেছেন লেজার রশ্মি।
যে কোনও আলোকরশ্মিই যেহেতু আদতে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ, তাই তার মধ্যে থাকে দু’ধরনের আধান। ধনাত্মক ও ঋণাত্মক। তার ফলে তার একটা নিজস্ব বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র থাকে। আবার কেলাসের মধ্যেও থাকে বহু অণু , পরমাণু। কেলাসের উপর আলো এসে পড়লে সেই আলোর বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের প্রভাবে কেলাসের সেই পরমাণুগুলির ভিতরের ইলেকট্রন ও প্রোটনের সজ্জা, বিন্যাস বদলে যায়। তার ফলে সেখানেও তৈরি হয় বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র। যার জন্য অরৈখিক মেরুকরণ তৈরি হয় কেলাসে।
কী ভাবে জন্মায় দুই আশ্চর্য যমজ ভাই?
কোনও ঘড়ির পেন্ডুলামকে ধীরে নাড়া দিলে তা এ দিক ও দিকে সমান ভাবে দুলতে শুরু করে। এটাকে বলে ‘সিম্পল হারমোনিক মোশন’ বা ‘লিনিয়ার মোশন।’ সেই ধাক্কা একটু বাড়ালেও পেন্ডুলাম দু’দিকে সমান ভাবেই দুলতে শুরু করে, তবে গতিটা একটু বাড়ে।
আর হঠাৎই পেন্ডুলামকে খুব জোরে ধাক্কা দিলে তার দোলন অস্বাভাবিক, অনিয়মিত হয়ে পড়ে। কোনও দিকে তা বেশি দোলে, কোনও দিকে কম। এটাই ‘নন-লিনিয়ার মোশন’।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, আলো ফেলা হলে কেলাসের মধ্যে থাকা পরমাণুগুলির অবস্থা যদি আচমকা খুব জোরে ধাক্কা খাওয়া পেন্ডুলামের মতো হয়, একমাত্র তা হলেই দুই যমজ ভাইয়ের জন্ম হওয়া সম্ভব।
এও দেখেছেন, কেলাসের উপর যে লেজার রশ্মি ফেলা হচ্ছে তার শক্তি (‘ইনটেনসিটি’) একটু একটু করে বাড়ানো হলে, কেলাসের পরমাণুগুলির ভিতরের বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের শক্তিও বাড়ে সমানুপাতিক ভাবে।
আর লেজার রশ্মির শক্তি যদি আচমকাই বাড়িয়ে বর্গ (‘স্কোয়্যার’) বা ঘন (‘কিউব’) করে দেওয়া হয়, একমাত্র তা হলেই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে জন্মায় অমন দুই যমজ ফোটন। দুই যমজ ভাই। দূরে নিয়ে গেলেও কোনও যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও যাদের এক জনের আচার, আচরণ বদলালে একই ভাবে বদলে যায় অন্য জনের আচার, আচরণও। যাদের প্রত্যেকেরই শক্তি কেলাসের উপর ফেলা লেজার রশ্মির শক্তির ঠিক অর্ধেক।
আলোর অআকখ
আলোকতরঙ্গের বর্ণালীতে থাকে নানা ধরনের আলো। তার একটা দৃশ্যমান আলো। যার মধ্যে আছে সাতটি রং। সবচেয়ে বেশি কম্পাঙ্ক (‘ফ্রিকোয়েন্সি’) ও শক্তি বেগুনি রংয়ের। সবচেয়ে কম লাল রংয়ের। আলোক-বর্ণালীর অন্যতম অতিবেগুনি রশ্মি বা আলট্রাভায়োলেট রে। যার কম্পাঙ্ক ও শক্তি দু’টিই অনেক বেশি। ফলে, তরঙ্গদৈর্ঘ্য (‘ওয়েভলেংথ’) খুব কম। এদের মধ্যেও নানা রং আছে। যাদের আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। আলোক-বর্ণালীতে থাকে ইনফ্রারেড রে বা অবলোহিত রশ্মিও। যার কম্পাঙ্ক ও শক্তি দু’টিই অনেক কম। ফলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক বেশি। নানা রং আছে এদের মধ্যেও। এদেরও খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, কেলাসের উপর বেগুনি রংয়ের আলোর কণা ফোটন ফেললে তা ভেঙে গিয়ে দু’টি লাল রঙের কণার জন্ম হয়। আর তারাই দু’টি যমজ ফোটনের জন্মের স্বাক্ষর বহন করে।
আলোর গাইড এবং মাল্টি-ইউজার কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন
কোনও মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে যেতে গেলেই আলোর পথ ছড়িয়ে যায়। পরিভাষায় যার নাম ‘ডিফ্র্যাকশন’। কেলাসের মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে লেজার রশ্মিরও তাই হয়।
সেটা হলে তো খুব মুশকিল। কেলাসের মধ্যে আলোর পথ ছড়িয়ে গেলে আলোর শক্তিক্ষয় হবে। তাই কেলাসের মধ্যে সেই আলোকে একমুখী করে তোলার প্রয়োজন হয়। অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রেও ফোটনদের একমুখী করা হয়।
কেলাসের মধ্যে সেই কাজটা একটি অভিনব উপায়ে করেছেন জয়ীরা। আলোর তরঙ্গকে (‘ওয়েভ’) একমুখী করে তুলতে তাকে ‘গাইড’ করেছেন। পদ্ধতিটির নাম তাই ‘ওয়েভগাইড’।
মেট্রোর টানেল রয়েছে যে ভাবে সেই ভাবেই যেমন এগিয়ে যায় ট্রেন, ট্র্যাক আর টানেলের বাইরে বেরতে পারে না, ঠিক তেমনই।
কেলাসের মধ্যে ওয়েভগাইড পদ্ধতিতে জন্মানো দুই যমজ ফোটনকে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বিতরণ করা যায়। আর সেটা করা গেলে তাদের কাজও বহুমুখী হয়ে যেতে পারে। তাদের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগের ক্ষমতা ও গতি বেড়ে যেতে পারে। এটাই মাল্টি-ইউজার কোয়ান্টাম কমিউনিকেশনের লক্ষ্য।
আলোর কণার মাধ্যমে টেলিযোগাযোগে ওয়েভগাইডের ভূমিকা।
আমাদের দেশে টেলিযোগাযোগব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত করে তোলার যুদ্ধে তাঁর প্রকল্পটি হবে লম্বা দৌড়ের ঘোড়া, এমনটাই বিশ্বাস জয়ীর।
জয়ীর আলোর জাদুতেই এক দিন হারিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে টেলিযোগাযোগব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শত্রু হ্যাকারদের!
ছবি ও গ্রাফিক-তথ্য সৌজন্যে: অধ্যাপক জয়ী ঘোষ।
ভিডিয়ো সৌজন্যে: ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলে।