দ্বিমুখী: শহরের পথে খাবারের খোঁজে এক মার্জার (বাঁ দিকে)। পেট ভরাতে এখনও মানুষের মুখাপেক্ষী পথকুকুরেরা। নিজস্ব চিত্র
মানুষের উপরেই নির্ভরশীল এক শ্রেণি। রাস্তায় থাকলেও মানুষের দেওয়া খাবারের ভরসাতেই তাদের বেঁচে থাকা। অন্যদের আবার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও, কেমন একটা ছাড়া ছাড়া ভাব! স্বাধীনচেতা, শিকারও করে তারা অনায়াসে। স্বভাবগত এই পার্থক্যই লকডাউনের সমাজে কুকুর থেকে বেড়ালকে এগিয়ে রাখছে কি না, তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ায় তাদের আচরণে কি কোনও বদল হচ্ছে? গবেষণা চলছে সেই নিয়েও।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ কলকাতা (আইআইএসইআর) সূত্রের খবর, গত কয়েক দিন ধরে তাদের ডগ-ল্যাব একটি সমীক্ষা শুরু করেছে। প্রথমে তারা পথকুকুরের ব্যবহারের পরিবর্তন চোখে পড়লেই ভিডিয়ো করে পাঠানোর জন্য বলেছে। পরে তার সঙ্গেই যুক্ত করা হয়েছে সমীক্ষার প্রশ্ন। সেখানকার অধ্যাপক-বিজ্ঞানী অনিন্দিতা ভদ্রের কথায়, ‘‘শুধু কুকুর নয়, বেড়ালেরও আচরণে বদল দেখলে আমাদের জানাতে বলছি। ওই প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে আমরা গবেষণা চালাব। আদতে সমাজবদ্ধ মানুষের বিবর্তনের সঙ্গেই বিবর্তিত হয়েছে সমাজবদ্ধ পশুর আচরণ। মানুষ হঠাৎ করেই গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে। হঠাৎ করেই মানুষের সাহচর্য ছাড়া কুকুর এবং বেড়ালের আচরণে বদল হচ্ছে কি না, সেটাই আমরা দেখতে চাই।’’
গবেষক থেকে পশু-চিকিৎসকদের বড় অংশই অবশ্য জানাচ্ছেন, এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে মানুষের আচরণের মতোই বদল আসতে পারে কুকুর-বেড়ালের স্বভাবে। এই মুহূর্তে সেই পরিবর্তন হলে, তা হবে খাবারের তাড়নায়। পশু চিকিৎসক শশাঙ্কমণি ত্রিপাঠী বলেন, ‘‘এক সময়ে নেকড়ে প্রজাতির সদস্য কুকুর, মানুষের সংস্পর্শে থেকে হাজার হাজার বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে। তার ফলে শিকার করে খাওয়া সে প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। সরাসরি মানুষের দেওয়া খাবার, আঁস্তাকুড়, বাজার বা রাস্তায় ফেলা খাবার খেয়ে বাঁচে সে। সেগুলিও এক অর্থে যায় মানুষের হাত ঘুরেই। এখন সেই মানুষের মুখ দেখা রাতারাতি বন্ধ হয়ে গেলে কুকুরের আচরণে সাময়িক বদল আসতে পারে। কারণ, এত দ্রুত আচরণ বদলায় বলে মনে হয় না। তবে লাগাতার লকডাউনে কী হবে বলা শক্ত।’’
আরও পড়ুন: সংক্রমণের পাঁচ মাস পরে করোনা নিয়ে কী কী জানলাম আমরা
যদিও বেড়ালের ক্ষেত্রে লকডাউনের এই পরিস্থিতি ততটা ভয়াবহ না-ও হতে পারে বলে মত অনেকের। পশু চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, পথকুকুরেরা শিকার করা ছেড়ে দিলেও বেড়াল কিন্তু মোটেও শিকার করা ছাড়েনি। সেই প্রবণতা থেকেই বেড়াল গৃহস্থের বাড়ির খাবার চুরি করে খায়। প্রয়োজন মতো শিকারও করে। পশুপ্রেমী সুলগ্না দত্তবণিক আবার বললেন, ‘‘আসলে কুকুরের মতো বেড়াল কখনওই পুরোপুরি গৃহপালিত নয়। যাঁরা বেড়াল রাখেন তাঁরা জানেন, সে নিজের ইচ্ছে মতো বাড়িতে আসে আবার বেরিয়েও যায়।’’
আরও পড়ুন: একরত্তি ‘প্যাকেজিংয়ে’ দিশাহারা বিশ্ব
পশুপ্রেমী ঋদ্ধিমান চট্টোপাধ্যায়ের যদিও দাবি, এই মুহূর্তে খাবারের সমস্যা সমস্ত সমাজবদ্ধ জীবেরই। রাস্তার বেড়ালদের বড় অংশ বাজার এলাকায় থাকে। সাধারণ সময়ে বাজারে যতটা উচ্ছিষ্ট জড়ো হয়, এখন তা হচ্ছে না। লোকের বাড়িতেও এখন ফেলে-ছড়িয়ে খাওয়ার প্রবণতা কমেছে। বাড়িতে লোক বেশি থাকায় গৃহস্থের খাবারে মুখ দেওয়াও বেড়ালের পক্ষে সহজ হচ্ছে না। তাঁর কথায়, ‘‘সব থেকে বড় সমস্যা কুকুরের মতো বেড়ালকে এক জায়গায় জড়ো করে খাওয়ানো যায় না। সেই সময়ে ওরা হয়তো কার্নিসের উপরে, নয়তো কোনও ঘুপচির মধ্যে ঘুরে বেড়ায়।’’
তবু কি শিকারের স্বভাবগুণেই কিছুটা এগিয়ে বেড়াল? পুরুলিয়ার ঝালদা ব্লক হাসপাতালের পশু চিকিৎসক কৌস্তুভ বসু বলছেন, ‘‘গত কয়েক দিনে কিছু জায়গায় কুকুরের আগ্রাসী হওয়ার কথা সামনে এলেও তা সম্পূর্ণ ভাবেই খাবারের জন্য। যে ভাবে কোথাও ত্রাণ এলে অভুক্তেরা ছুটে যান, কুকুরের ছুটে যাওয়াও তা-ই। খাবারের জন্যই নিজের স্বভাব বদলে নিজস্ব এলাকা ছেড়ে বেরোতে গিয়ে অনেক কুকুর অন্য কুকুরের কামড়ে আহতও হচ্ছে। বেড়ালের ক্ষেত্রে তেমন উদাহরণ নেই, হয়তো ওই শিকার করা ছেড়ে না দেওয়ার জন্যই।’’