ফাইল ছবি।
বিজ্ঞান ও বাণিজ্য। ‘চন্দ্রযান-২’-এর সফল উৎক্ষেপণ করে একই ঢিলে দু’টি পাখি মারতে চলেছে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো। দেখাতে চলেছে, বিশ্বের বড় বড় মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলির মতো আমরাও মেলাতে পারি বিজ্ঞান ও বাণিজ্যকে। একে অন্যের ভালর জন্য। একে অন্যের এগিয়ে যাওয়ার জন্য।
ইসরো প্রমাণ করতে চলেছে, জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায় দূরের বেশ জটিল কক্ষপথে অনেক বেশি ওজনের উপগ্রহ পাঠানোর ক্ষমতা তার রয়েছে। সেই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, প্রকৌশল ইসরোর আয়ত্ত্বে রয়েছে। এটাও প্রমাণ করতে চলেছে নাসা, ইসা (ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি বা ইএসএ), জাক্সা (জাপান স্পেস এজেন্সি)-র মতো বিশ্বের বড় মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলির চেয়ে ইসরো সেটা অনেক কম খরচেই করতে পারে। যা হয়ে উঠতে চলেছে একটি দৃষ্টান্ত। একটি নজির।
কম চিনিতেও মিষ্টি লাগে, শরীরও থাকে সুস্থ!
যত চিনি, ততই মিষ্টি! কিন্তু মাত্র ১ হাজার কোটি টাকার ‘চন্দ্রযান-২’ প্রমাণ করতে চলেছে, কম চিনিতেও মিষ্টত্বের স্বাদ অনুভব করা যায়, শরীর-স্বাস্থ্য অনেক বেশি সুস্থ রেখে! ইসরো এটাই দেখাতে চলেছে। যা নাসা, ইসা, জাক্সা-র প্রয়োজন হয়নি, অর্থের অভাব নেই বলে। ‘মেপে চলতে হবে, বুঝে চলতে হবে’, এই বোধই মহাকাশ গবেষণার জন্য কম খরচে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, প্রকৌশল আয়ত্ব করার মন্ত্র শিখিয়েছে ইসরোকে। চন্দ্রযান-২-এর উৎক্ষেপণের মাধ্যমে যা ইসরোকে বিশ্বে নজির গড়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
চাঁদে সভ্যতার উপনিবেশের নকশা। নাসার শিল্পীর কল্পনায়
ফলে, অর্থনীতির মানদণ্ডে ততটা শক্তপোক্ত না হয়েও যে ছোট ছোট দেশগুলি বিশ্ব পরিস্থিতির ধারাবাহিকতা ও প্রয়োজনে মহাকাশ গবেষণার দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে, তারাও এ বার হয়তো রকেট, উপগ্রহ পাঠানোর জন্য নাসা, ইসা, জাক্সার দ্বারস্থ না হয়ে শরণাপন্ন হবে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থারই।
এ বার ছোট দেশগুলি নাসার কাছে না গিয়ে হবে ইসরোর দ্বারস্থ
তাতে ইসরো ও ভারতের মহাকাশ বিজ্ঞানের গবেষণা দুই’ই উপকৃত হবে। কারণ, সুলভে চোখ টানার মতো নতুন নতুন প্রযুক্তি প্রকৌশলে আগ্রহী হয়ে ছোট ছোট দেশগুলি যত বেশি করে ইসরোর দিকে ঝুঁকবে, ততই সরকারের উপর নির্ভরতা কমবে ইসরোর। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থাকে তা আরও বেশি করে স্বনির্ভর হয়ে ওঠার দিশা দেখাবে। স্বনির্ভর করে তুলবে।
আরও পড়ুন- চার বছরের মধ্যেই চাঁদের পাড়ায় ‘বাড়ি’ বানাচ্ছে নাসা!
আরও পড়ুন- সাড়ে ৫৬ মিনিট আগের সিদ্ধান্তেই বাজিমাত! বিশ্বে নজির গড়ল ইসরো
আরও একটা লাভ হবে। সরকারি নির্ভরতা কমলে সরকারি বাধ্যবাধকতার ফাঁসটাও কিছুটা আলগা হয়ে যাবে। সরকারি অর্থের ভরসায় চলতে হয়, তাই চটজলদি চটকদার কিছু সরকারি প্রকল্প, চিন্তাভাবনা বাস্তবায়িত করার যে চাপটা এত দিন ছিল, এখনও যথেষ্টই রয়েছে ইসরোর কাঁধে, তা কমবে। সেটাই স্বাভাবিক। অনিবার্য। বহুকাঙ্খিতও।
ফলে, ইসরোকে আর শুধুই আবহাওয়ার উপর নজরদারি, খনিজ সম্পদের সন্ধান বা অন্য দেশ বা সন্ত্রাসবাদীদের গোপন ঘাঁটির উপর নজরদারির জন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, প্রকৌশল আয়ত্ত্ব করার সাধনায় মগ্ন হয়ে থাকতে হবে না।
‘এ দেশেও হয়’, বুঝতে পারবে নতুন প্রজন্ম
জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণাতেও ইসরো মন বসাতে পারবে। যা শুধুই যে মৌলিক গবেষণার স্বার্থেই জরুরি তা নয়; এ দেশের নতুন ও পরবর্তী প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ, বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণার ইচ্ছাকে একলাফে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেবে। চন্দ্রযান-২-এর সফল উৎক্ষেপণ নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এই ধারণা গড়ে উঠতে সাহায্য করবে যে, আমরাও পারি। আর সেটা এই দেশে বসেই পারি। তার জন্য নাসা বা ইসায় যেতে হবে না। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এমবিএ পড়ে ম্যানেজারি করার ঝোঁকটা কমবে। ভাল ভাল ইঞ্জিনিয়াররা তখন ইসরোয় চাকরি পাওয়ার দৌড়ে সামিল হবেন।
চাঁদে সভ্যতার উপনিবেশের নকশা। নাসার শিল্পীর কল্পনায়
চন্দ্রযান-২-এর মতো জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায় ইসরো আরও বেশি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে সেই ইঞ্জিনিয়াররা তখন ইসরোর চাকরিতেই থেকে যাবেন। এলন মাস্কের অনেক অর্থের চাকরির টোপ গিলবেন না! আর বিজ্ঞান গবেষণার মেধাগুলিও ‘এ দেশে কিছু নেই’ বলে আর অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, হার্ভার্ডে চলে যাবেন না। তাঁরাও হয় সামিল হবেন ইসরোয় না হলে ইসরোর নানা বিজ্ঞান গবেষণামূলক প্রকল্পে। সেই মেধা যে দেশকে শুধুই মেধাসম্পদ দেবে তা নয়; তাঁদের উদ্ভাবন দেশকে অর্থ উপার্জনেরও দিশা দেখাতে পারে।
কী ভাবে চাঁদে নামছে ভারত? দেখুন ভিডিয়ো
‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’ দিয়ে শুরু...
ভারত এটা করে দেখাচ্ছে, ইসরো এই সব করতে পারছে বুঝলে, ছোট ছোট দেশগুলি আর নাসা, ইসা, জাক্সার কাছে আগের মতো ছোটাছুটি না করে ইসরোর কাছেই ছুটে আসবে। তাতে ইসরোর বাণিজ্য হবে। সেই লভ্যাংশ ইসরো আরও বেশি করে খরচ করতে পারবে মহাকাশ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণায়। যা ১৯৯৬ সালে ইসরো প্রথম শুরু করেছিল ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’ প্রকল্পের চিন্তাভাবনা শুরুর মাধ্যমে। আলট্রাভায়োলেট ও এক্স-রে তরঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য মহাকাশে এত ভাল অবজারভেটরি আর পাঠাতে পারেনি কোনও দেশই।
আরও পড়ুন- চাঁদে এখন না নামলে পরে খুবই পস্তাতে হত ভারতকে!
আরও পড়ুন- চাঁদই হতে চলেছে আগামী দিনের সেরা ল্যাবরেটরি!
তার পর একে একে গেল চন্দ্রযান-১। ২০০৮-এ। পরের বছরেই চাঁদে পেল হাইড্রক্সিল আয়ন। তরল জলের অস্তিত্বের প্রমাণ। গেল মঙ্গলযান, ২০১৪-য়। তার পরের বছরেই গেল অ্যাস্ট্রোস্যাট। তার আগে তো ‘আর্যভট্ট’ আর ‘ভাস্কর’ ছাড়া মহাকাশ বিজ্ঞানের গবেষণায় ইসরোর তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল না।
চাঁদে সভ্যতার উপনিবেশের নকশা। নাসার শিল্পীর কল্পনায়
আদিত্য-এল-ওয়ান, দ্বিতীয় মঙ্গলযান, ‘দক্ষ’, ‘সিএমবি-ভারত’...
এখন দ্বিতীয় মঙ্গলযান পাঠানোর তোড়জোড়, প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। আগামী বছরের শেষাশেষি রওনা হবে ‘সূর্যমুখী’ আদিত্য-এল-ওয়ান। যার অত্যন্ত শক্তিশালী আলট্রাভায়োলেট ক্যামেরাটি বানিয়েছেন ‘আয়ুকার’ই অধ্যাপক। তার পর রয়েছে ‘দক্ষ’, ‘সিএমবি-ভারত’।
আয়ুকার বানানো ‘স্যুট আলট্রাভায়োলেট ক্যামেরা’।
প্রমাণ হচ্ছে, বহু দিন পর ইসরো বেশি করে ঝুঁকে পড়তে চাইছে, ঝুঁকে পড়ছে মৌলবিজ্ঞান গবেষণার দিকে। আর তার জন্যই প্রযুক্তি, প্রকৌশল উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে ইসরোর পারদর্শীতা আরও বাড়াতে হবে। বাণিজ্যের প্রয়োজনেও। অন্য দেশগুলিকে তার দিকে নজর দেওয়ানোর জন্যেও।
লেখক পুণের ‘ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আয়ুকা)’-এর অধিকর্তা
টেলিফোন সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখন: সুজয় চক্রবর্তী
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: ইসরো ও আয়ুকা