২২ জুলাই, ২০১৯ সকালে শ্রীহরিকোটার সতীশ ধওয়ন স্পেস রিসার্চ সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ হয়েছিল চন্দ্রযান-২। সব ঠিক থাকলে আজ, শুক্রবার রাত ১টা থেকে অবতরণ শুরু হবে চন্দ্রযানের। দেড়টা থেকে আড়াইটের মধ্যে ‘টাচ ডাউন’ আর শনিবার সকাল ৬টা নাগাদ ল্যান্ডার বিক্রমের ভিতর থেকে বেরোনোর কথা রোভার প্রজ্ঞানের। চাঁদে পৌঁছে চন্দ্রযান-২ এর প্রথম কাজ কী হবে?
চাঁদের মাটিতে আদৌ জল আছে? চাঁদ ভবিষ্যতে বিপুল খনিজের উৎস হতে পারবে? এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই চাঁদে গিয়েছে চন্দ্রযান-২। এই প্রথম চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নামবে কোনও যান। এখনও পর্যন্ত কোনও দেশই চাঁদের এই অংশে পা রাখেনি। ভারত সেটাই করতে চলেছে। অর্থাৎ দক্ষিণ মেরুতে ভারতই প্রথম কোনও চন্দ্রযান পাঠাচ্ছে। তাও সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে।
চন্দ্রযানের তিনটি ভাগ। অরবিটার অর্থাৎ স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ, যা চাঁদের কক্ষপথে ঘুরবে। ল্যান্ডার অর্থাৎ যা চন্দ্রযানকে চাঁদের মাটিতে নামাবে এবং নামবে। এবং রোভার, অর্থাৎ মূল অনুসন্ধানকারী যান, যা চাঁদের মাটিতে জল ও অন্যান্য খনিজ পদার্থের সন্ধান চালাবে।
এই তিনটি অংশের প্রায় পুরোটাই ভারতে তৈরি। সেই কারণে খরচ হয়েছে খুবই কম। এই তিনটি অংশ এবং মূল মহাকাশযানের মিলিত ওজন প্রায় ৩৮৫০ কেজি। চন্দ্রযান-২ তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ৯৭৮ কোটি টাকা। যা সবচেয়ে কম খরচে হওয়া চন্দ্রাভিযানগুলির মধ্যে অন্যতম।
এই অভিযানে ইসরোর যে রোভারটি থাকছে, তার কাজ হবে চাঁদের মাটিতে কী কী খনিজ পদার্থ রয়েছে, প্রথমেই তার সন্ধান করা। ওই রোভার কৃত্রিম মেধা চালিত। সে ল্যান্ডার বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে এবং তার মাধ্যমে ছবি ও তথ্য পৃথিবীতে পাঠাবে।
রোভার প্রজ্ঞানের আবার দু’টি যন্ত্র। ‘আলফা পার্টিকল এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার’ অবতরণস্থলের কাছে চন্দ্রপৃষ্ঠে কী কী উপাদান রয়েছে তা দেখবে। এই যন্ত্রে কিউরিয়াম নামে তেজস্ক্রিয় মৌল থেকে এক্স-রে ও আলফা পার্টিকল নির্গত হবে এবং তার মাধ্যমে চন্দ্রপৃষ্ঠের ছবি তুলবে। লোহা, ম্যাগনেশিয়াম, সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম, টাইটেনিয়ামের মতো খনিজের সন্ধানও করবে।
দ্বিতীয় যন্ত্রটির নাম ‘লেসার ইনডিউসড ব্রেকডাউন স্পেকট্রোস্কোপ’। এর কাজ হল অবতরণস্থলের আশপাশে চাঁদের মাটিতে কী উপাদান কত পরিমাণে রয়েছে তা খুঁজে বার করা। এর থেকে মহাকাশবিজ্ঞানের অনেক অজানা তথ্য বেরতে পারে বলে আশাবাদী বিজ্ঞানীরা।
কাজ শেষ হওয়ার পরই অবশ্য রোভারটা নষ্ট হয়ে যাবে। তবে কৃত্রিম উপগ্রহ তার পরও কাজ চালিয়ে যাবে। চাঁদের মাটি থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে ঘুরতে থাকা স্যাটেলাইট ক্রমাগত চাঁদের পৃষ্ঠের ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠাবে।
ইসরো সূত্রে জানা গিয়েছে, কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে আলাদা হয়ে পাখির পালকের মতো চাঁদে অবতরণ করবে চন্দ্রযান-২। তার জন্য উৎক্ষেপণের আগে কৃত্রিম চাঁদের মাটি তৈরি করে বারবার পরীক্ষামূলক অবতরণও করা হয়েছে এই যানের।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, তামিলনাড়ুর নামাক্কলের মাটি দিয়ে এই কৃত্রিম চন্দ্রপৃষ্ঠ তৈরি করা হয়েছিল। কারণ, এই মাটিতে এনোর্থোসাইট নামে এক ধরনের আগ্নেয় শিলা রয়েছে, যার সঙ্গে চন্দ্রপৃষ্ঠের অনেকটাই মিল।
এখনও পর্যন্ত এটাই ইসরোর সবচেয়ে বড় মিশন। জিওসাইক্রোনাস স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিক্যাল অর্থাৎ জিএসএলভি এমকে-৩ থেকে চন্দ্রযান-২ এর উৎক্ষেপণ হয়। যা ইসরোর সবচেয়ে বড় এবং অত্যাধুনিক লঞ্চ প্যাড। অভিযান যদি সফল হয়, তা হলে আমেরিকা, রাশিয়া এবং চিনের পর ভারত বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ দেশ হিসাবে চাঁদে পা রাখবে।
উৎক্ষেপণের পর থেকে এর সব কিছুই স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিতে কাজ করছে। উৎক্ষেপণের পর গতি বাড়িয়ে পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করতে সময় লেগেছে পাঁচ দিন। পেরতে হয়েছে প্রায় ৩.৮৪ লক্ষ কিলোমিটার পথ। এ বার চাঁদে নামার পালা। স্যাটেলাইট থেকে আলাদা হওয়া থেকে চাঁদে অবতরণ, এই সময়টা বিজ্ঞানীদের কাছে ‘ভয়ঙ্কর ১৫ মিনিট’।
এক আগে চন্দ্রযান-১ অভিযান করেছিল ইসরো। সেই অভিযানের মেয়াদ ছিল ৪ মাস। চন্দ্রযান-২ এর অভিযানের মেয়াদ পুরো ১ বছর। চন্দ্রযান-১ দক্ষিণ মেরুতে যেতে গিয়েই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তবে তার আগে জলের কণার উপস্থিতির ছবি পাঠিয়ে দিয়েছিল পৃথিবীতে।