যা হারিয়ে যায়, তা খোঁজার উপায়

ব্লুটুথ টেকনোলজির উদ্ভব ১৯৯৪ সালে। এই প্রযুক্তিতে ২.৪ গিগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সিতে বেতার তরঙ্গ পাঠিয়ে ছোট ছোট নেটওয়ার্কের মধ্যে তথ্যের আদানপ্রদান ঘটে।

Advertisement

প্রসূন চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৯ ০৯:৫৫
Share:

আপনি কি ঘন ঘন জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলেন? গাড়ির চাবি, মানিব্যাগ, জুতো, ছাতা, আইডি কার্ড বা টিভির রিমোট কোথায় রেখেছেন মনে করতে পারেন না? আকছার হারানো জিনিস খুঁজতে হয়রান হয়ে যান? আপনার মতো আপনভোলা মানুষের জন্য এসেছে ব্লুটুথ ট্র্যাকার বা ট্র্যাকিং ডিভাইস। ব্লুটুথ তারবিহীন এক প্ৰযুক্তি, যা কোনও স্থির যন্ত্রের সঙ্গে চলমান আর এক যন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ বজায় রাখে।

Advertisement

বাজারচলতি ব্লুটুথ ট্র্যাকার ছোট্ট চ্যাপ্টা প্লাস্টিকের চাকতির মতো। আয়তাকার বা বর্গাকৃতিরও হতে পারে। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে সাধারণত পাঁচ ইঞ্চির বেশি হয় না। অনায়াসে এটিকে চাবির রিং বা মানিব্যাগ ইত্যাদিতে আটকে দেওয়া যায়। যন্ত্রটির মধ্যে থাকে ছোট্ট একটা ব্যাটারি, ক্ষুদ্র কিছু কলকব্জা ও একটি বিপার বা অ্যালার্ম। এ বার আপনার স্মার্টফোন, ল্যাপটপ বা ট্যাবলেট কম্পিউটারে একটি নির্দিষ্ট অ্যাপ (আই ও এস বা অ্যান্ড্রয়েড) ডাউনলোড করে সেটির সঙ্গে ট্র্যাকারের যোগসূত্র স্থাপন করে ফেলুন। এর পর জিনিসপত্র যত খুশি হারিয়ে ফেলুন। স্মার্টফোনের অ্যাপ খুলে টোকা দিলেই পেয়ে যাবেন যা হারিয়েছিলেন— বিপার বেজে উঠবে। ট্র্যাকারের আলোও জ্বলে উঠবে।

ট্র্যাকারগুলির দাম ৭০০-৩৫০০ টাকা। আমাজন, ফ্লিপকার্ট বা অন্য কোনও অনলাইন শপে সহজলভ্য। বিদেশে জনপ্রিয় টাইল, চিপোলো ও অ্যাডেরো ট্র্যাকার। ভারতে তৈরি ট্র্যাকারগুলির মধ্যে অন্যতম ‘ফাইন্ড’। ফাইন্ড ট্র্যাকিং ডিভাইসের উদ্ভাবক বছর বত্রিশের যুবক অভিষেক লাদ। ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটনের মেকাট্রিনক্স-এর কৃতি ছাত্র। বিদেশে কোনও নামী কোম্পানিতে চাকরি না করে অভিষেক ফিরে আসেন তাঁর জন্মস্থান উত্তর কর্নাটকের বেলগম শহরে। ২০১৩ সালে তিনি কলেজের সহপাঠী অপূর্ব শেট্টির সঙ্গে গোড়াপত্তন করেন সেন্সগিজ় নামের একটি স্টার্টআপ।

Advertisement

ইতিমধ্যে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ফাইন্ড বিক্রি হয়েছে ৫০টি দেশে। ‘‘সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় জাপানে। তার পর যুক্তরাষ্ট্রে ও সিঙ্গাপুরে,’’ জানালেন অভিষেক।

জাপানে এটির জনপ্রিয়তা অভিষেককে অবাক করেছে। বাড়িতে ও বৃদ্ধাশ্রমে স্মৃতিভ্রষ্ট বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ওপর নজর রাখার জন্য ও কিন্ডারগার্টেন স্কুলের বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য কাজে লাগছে তাঁর ডিভাইস। অভিষেক জানালেন, ‘‘অ্যালঝাইমার ও ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত বৃদ্ধ মানুষজনের পকেটে অথবা গলার চেনের লকেটে বেঁধে রাখলে তাঁদের চোখে-চোখে রাখা সহজ। দুরন্ত শিশু বা পোষা কুকুর ও বেড়ালের ওপরও নজর রাখা যায়।’’

ব্লুটুথ টেকনোলজির উদ্ভব ১৯৯৪ সালে। এই প্রযুক্তিতে ২.৪ গিগাহার্জ ফ্রিকোয়েন্সিতে বেতার তরঙ্গ পাঠিয়ে ছোট ছোট নেটওয়ার্কের মধ্যে তথ্যের আদানপ্রদান ঘটে। গোটা আটেক ডিভাইস-এর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। অর্থাৎ, আপনি একসঙ্গে সাতটি জিনিসে ট্র্যাকার ডিভাইস ব্যবহার করতে পারেন।

ব্লুটুথ প্রযুক্তির নাম ডেনমার্কের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্রাট হ্যারাল্ড ব্লুটুথ-এর স্মরণে। দশম শতাব্দীর এই রাজা স্ক্যান্ডিনেভিয়ার যুযুধান ছোট ছোট রাজ্যগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। প্রাচীন এই সম্রাটের মতো ব্লুটুথ প্রযুক্তিও বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিকে বেতারের মাধ্যমে সঙ্ঘবদ্ধ করে।

ইদানীং কালে ব্লুটুথ স্পিকার স্মার্টফোনকে মিউজ়িক সিস্টেমে পরিণত করেছে। এই প্রযুক্তির প্রধান সীমাবদ্ধতা এই যে, এটি বেশি তথ্য আদানপ্রদান করতে পারে না। আর এটি ২০০-৩০০ মিটার পরিসীমার মধ্যেই আবদ্ধ থাকে। সেই কারণে দীর্ঘতর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় জিপিএস বা গ্লোবাল পজ়িশনিং সিস্টেম-ভিত্তিক ট্র্যাকিং সিস্টেম।

জিপিএস ট্র্যাকিং যন্ত্রগুলো কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে তথ্য আদানপ্রদান করে। অর্থাৎ কৃত্রিম উপগ্রহ ট্র্যাকারটির অবস্থান ও নড়াচড়ার জানান দেয়। জিপিএসের গোটা তিরিশ কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে লুকিয়ে থাকা বস্তুকে খুঁজে দিতে পারে। চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারি করতে পারে। উপগ্রহগুলি ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০,০০০ কিমি দূরত্বে বিচরণ করে। পৃথিবীর যেখানেই যাবেন, অন্তত চারটি উপগ্রহ আপনার উপর নজর রাখতে পারে।

জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইসের বহুল ব্যবহার হচ্ছে মোটরগাড়ি শিল্পে। এই যন্ত্র গাড়িতে থাকলে কখনওই পথ হারাবে না। গাড়ি চুরি গেলে বা ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অন্য পথে গেলেও স্মার্টফোনের পর্দায় তার গতিবিধির উপর নজর রাখা যাবে। এটি ব্যবহার করেন পর্বতারোহীরাও। স্মৃতিভ্রষ্ট বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বাউন্ডুলে মানুষজন ও অপরাধীদের ওপর নজর রাখার জন্যেও ব্যবহার হচ্ছে জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইস।

অন্য দিকে জিপিএস ট্র্যাকারের প্রয়োগ নিয়ে হচ্ছে নানান তর্ক-বিতর্ক ও কঠোর সমালোচনা। বয়ঃসন্ধির সন্তান যাতে বিপথে না যায়, সেই জন্য বাবা-মায়েরা এই যন্ত্রের দ্বারস্থ হচ্ছেন। সন্দেহপ্রবণ স্বামী বা স্ত্রী একে ওপরের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে ও কর্মক্ষেত্রে কর্মচারীর ওপর নজরদারির জন্যও এই প্রযুক্তির অপব্যবহার হচ্ছে। প্রাইভেট ডিটেকটিভ ও গুপ্তচরদের জন্য আদর্শ এই যন্ত্র।

তার চেয়েও ভয়ঙ্কর, সাধারণ নাগরিকের ওপর নজর রাখার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের জিপিএস ট্র্যাকারের অপপ্রয়োগ। এর সাহায্যে নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবনের উপর আঘাত নেমে আসছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে। মানবাধিকার সংগঠনগুলি জিপিএস ট্র্যাকারের অনৈতিক প্রয়োগের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠেছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement