প্রতীকী চিত্র
সভ্যতার ইতিহাসকে বিভিন্ন যুগে ভাগ করা হয়। ইতিহাসবিদরা এই সময়গুলোর নানা নিদর্শন খুঁজে বার করেন। পদার্থবিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও অনেকটা একই রকম কাজ করেন। তবে তাঁরা পৃথিবীর ইতিহাসে সীমাবদ্ধ নন। পৃথিবী, সূর্য, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি-র জন্মের বহু আগের ইতিহাস সন্ধান করছেন তাঁরা। এখনও পর্যন্ত মহাবিশ্বের খুব অল্প জায়গায় অনুসন্ধান চালানো গিয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা তাঁদের তত্ত্ব দিয়ে মহাবিশ্বের একটা কাঠামো হাজির করেছেন আমাদের সামনে। সম্প্রতি ভারতীয় বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের ইতিহাসের এমন এক সময়কালের খোঁজ পেয়েছেন, যার সন্ধান আগে পাওয়া যায়নি। জন্মলগ্ন থেকেই মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। ফলে ব্রহ্মাণ্ডে যে সমস্ত আলোক উৎস ছড়িয়ে আছে, তাদের সঙ্গে আমাদের দূরত্বের পরিবর্তন হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। এখানে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটা ব্যাপার কাজে লাগান। সেটার নাম হল ‘রেড শিফট’। বর্তমানে মহাকাশের বহু আলোক উৎস রেড শিফটে রয়েছে।
ধরা যাক, দূর থেকে একটা অ্যাম্বুল্যান্স আসছে। অ্যাম্বুল্যান্স যখন দূরে, তখন তার আওয়াজ আমরা আস্তে শুনি, আর অ্যাম্বুল্যান্স যখন কাছে চলে আসে, তখন আমরা তার আওয়াজ অনেক জোরে শুনতে পাই। অর্থাৎ মনে হয় যে, শব্দের কম্পাঙ্ক পরিবর্তিত হচ্ছে। আলোর ক্ষেত্রেও অনেকটা একই রকম ব্যাপার ঘটে। আলোক উৎস দূরে সরে গেলে আমাদের সাপেক্ষে সেই আলোর কম্পাঙ্ক কমে। লাল আলোর কম্পাঙ্ক সবচেয়ে কম, তাই বলা হয় সেই আলোক উৎস লালের দিকে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ, রেড শিফট হচ্ছে।
রেড শিফট ঘটনাটি প্রথমে লক্ষ করেছিলেন ক্রিশ্চিয়ান ডপলার, ১৮৪২ সালে। পরে উইলিয়াম হাগিন-সহ একাধিক বিজ্ঞানী নক্ষত্রের আলো পর্যবেক্ষণ করে রেড শিফট তত্ত্বের পক্ষে মত দেন। ওয়াল্টার অ্যাডামস তাঁর ‘প্রিলিমিনারি ক্যাটালগ অব লাইনস অ্যাফেক্টেড ইন সান স্পট’ শীর্ষক প্রবন্ধে প্রথম রেড শিফট কথাটি ব্যবহার করেছিলেন। মহাবিশ্ব যে প্রসারিত হচ্ছে, তার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। রেড শিফট তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে তা ব্যাখ্যা করেন এডউইন হাবল।
মহাবিশ্ব যে গতিতে আজ প্রসারিত হচ্ছে, তা থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন, আজ থেকে প্রায় ১৩৭৭ কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল। রেড শিফট একটি এককবিহীন সংখ্যা— জ়েড। এর মান নির্ভর করে আলোক উৎস থেকে নির্গত তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও পর্যবেক্ষকের কাছে আলোক উৎসের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পার্থক্যের উপর। বিভিন্ন নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে আগত আলোর রেড শিফটের পরিমাণ নির্ণয় করার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা তা সম্বন্ধে নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অনুসন্ধান করেন।
বিগ ব্যাং-এর ঠিক পরে মহাবিশ্বের অবস্থা আজকের মতো ছিল না। এই সময় তাপমাত্রা এত বেশি ছিল যে, এই অবস্থায় পরমাণু সৃষ্টি সম্ভব ছিল না। পরমাণু গঠনকারী বিভিন্ন কণিকা এবং ফোটন বা আলোককণা মুক্ত অবস্থায় থাকত। অন্য কণাগুলির সঙ্গে ফোটনের ক্রমাগত সংঘর্ষ হওয়ার ফলে ফোটন বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারত না। এই পর্যায়ের অবস্থাকে বলা হয় ফোটন ব্যারিয়ন ফ্লুইড। একটা ক্যারম বোর্ডে অনেকগুলো ঘুঁটি থাকলে স্ট্রাইকারকে এ পার থেকে ও পারে পাঠানোর সময় অন্য ঘুঁটিগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়ার ফলে স্ট্রাইকারটি বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে না। স্ট্রাইকারটির মতোই অন্য কণার সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে ফোটনও বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে ব্যর্থ হত।
মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হতে থাকায় ফোটন অন্য কণাগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষ না করে বাইরে বেরনোর জায়গা পায়। এই আলো মহাবিশ্বের একদম প্রথম পর্যায়ের আলো। ১৯৪১ সালে মহাবিশ্বের এই প্রথম অবস্থার তথ্য কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের মাধ্যমে জানান অ্যান্ড্রু ম্যাকলার। ১৯৬৫ সালে ম্যাকলারের তত্ত্ব প্রমাণ করেন দুই মার্কিন বিজ্ঞানী, আর্নো পেনজ়িয়াস ও রবার্ট উইলসন।
আরও পড়ুন: হারাচ্ছে হাজারো পরিযায়ী
মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে থাকায় উষ্ণতা অনেক কমে যায় ও পরমাণু সৃষ্টির অনুকূল অবস্থা তৈরি হয়। এই পর্যায়ে কেবলমাত্র হাইড্রোজেন ও কিছু হিলিয়াম পরমাণুরই অস্তিত্ব ছিল। এই অবস্থায় কোনও আলোক উৎস না থাকায় মহাবিশ্ব পুরো অন্ধকারে ডুবে ছিল। এই পর্যায়কে বলা হয় কসমিক ডার্ক এজ। অনেকটা যেন আলো ফোটার আগে মধ্য রাত্রির অবস্থা। মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বলের প্রভাবে সেই পরমাণুগুলো এক জায়গায় জড়ো হয়ে মেঘ তৈরি করে। ধীরে ধীরে জন্ম হয় প্রথম নক্ষত্রের। এই পর্যায়কে অনেকে কসমিক ডন বলে থাকেন। অর্থাৎ, মহাবিশ্বের ভোরের আলো ফুটতে আর দেরি নেই। প্রথম পর্যায়ের নক্ষত্রগুলি কেবল হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দ্বারা গঠিত ছিল, এদের মূল ফুয়েল ছিল পারমাণবিক বিভাজন বিক্রিয়া। এই নক্ষত্রগুলি ছিল আকারে বিশাল ও খুব বেশি উষ্ণ। নক্ষত্রগুলি অতিবেগুনি রশ্মি নিঃসরণ করত। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, এদের প্রভাবে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামগুলি পুনরায় আয়নায়িত হয় ও মহাবিশ্ব রি-আয়োনাইজ়েশন পর্যায়ে প্রবেশ করে। যদিও এ নিয়ে বিজ্ঞানীমহলে দ্বিমত রয়েছে। কারণ, এই পর্যায়ের এখনও অনেক তথ্যই আমাদের জানা বাকি। সাম্প্রতিক গবেষণার ফলে এই পর্যায়ের আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যাবে বলেই বিজ্ঞানমহলের ধারণা।
আরও পড়ুন: সূর্যের থেকেও দূরের গ্রহাণুকে ছোঁবে সভ্যতা, তুলে আনবে তার ‘মাংস’
পুণের ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজ়িক্স বা আইইউকা-তে কনক সাহার নেতৃত্বাধীন বৈজ্ঞানিকদের একটি আন্তর্জাতিক দল এই সময়কালেরই তথ্য অনুসন্ধান করেছেন। তাঁরা যে নক্ষত্রপুঞ্জের সন্ধান পেয়েছেন, এর কাছাকাছি সময়ের অন্য তথ্য এর আগে সে ভাবে জানা যায়নি। ২৪ অগস্ট নেচার অ্যাস্ট্রোনমি পত্রিকায় তাঁদের গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে।
তাঁরা যে নক্ষত্রপুঞ্জের সন্ধান পেয়েছেন, সেটি থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি বড়ই ক্ষীণ। ভারতের অ্যাস্ট্রোস্যাট স্পেস টেলিস্কোপ এই তরঙ্গের সন্ধান পেয়েছে। এই স্পেস টেলিস্কোপটি ২০১৫ সালে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর তরফে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। অ্যাস্ট্রোস্যাটে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের এক্স রশ্মি, অতিবেগুনি রশ্মি ও দৃশ্যমান রশ্মি ধরা পড়ে। নক্ষত্রপুঞ্জটি থেকে আগত আলো অতিবেগুনি রশ্মি হওয়ায় তা অ্যাস্ট্রোস্যাটে ধরা পড়েছে।
আরও পড়ুন: পৃথিবী থেকে এক হাজার গুণ বেশি বিকিরণের ঝাপ্টা চাঁদে, জানাল চিনা ল্যান্ডার
বর্তমানে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এমন সূত্রের সন্ধান করছেন, যা প্রাথমিক ভাবে মহাবিশ্বকে পুনরায় আয়নায়িত করার বিষয়টিতে আলোকপাত করবে। তবে এই প্রারম্ভিক আলোক উৎসগুলি থেকে আয়নাইজ়িং রেডিয়েশন পর্যবেক্ষণ করা প্রায় অসম্ভব। অতিবেগুনি রশ্মির ফোটনের একটি অংশের নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে বেরিয়ে আসা এবং পৃথিবীতে ধরা পড়ার সম্ভাবনাটি কার্যত শূন্য। কারণ এই ফোটনগুলি গ্যালাক্সির গ্যাস বা ছায়াপথের চার পাশের গ্যাস অথবা গ্যালাক্সির মধ্যে থাকা পদার্থ দ্বারা শোষিত হতে পারে। তবে কিছু ফোটন কী ভাবে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে পৃথিবীতে পৌঁছে যায়, তা রহস্য। বিজ্ঞানীমহলের আশা, কনক সাহা ও তাঁর গবেষক দলের সাম্প্রতিক গবেষণা সেই রহস্যের পর্দা উন্মোচনে অনেকটাই সাহায্য করবে। রি-আয়োনাইজ়েশন পর্যায় সম্পর্কে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যাবে।