এ বার ঈশ্বরের রাজ্যে বসেই ঈশ্বরের অপার রহস্যের জাল কাটবেন বিজ্ঞানীরা!
নৈনিতালের প্রায় ৬০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে, পাহাড়চুড়োয় ‘ইশ্বরের নাকের ডগা’য়, দেবস্থলে! এই অতলান্ত ব্রহ্মাণ্ডের অসীম গভীরতার কোন আঁধারে ঢাকা রয়েছে অজানা কোন ভিন গ্রহের ‘আলো’, এই প্রথম ভারতে বসেই তার হাল-হদিশ জানতে পারবেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। জানতে পারবেন কী ভাবে রাসায়নিক বিবর্তন ঘটেছিল এই ব্রহ্মাণ্ডে ‘আমাদের পাড়া’ মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতে। জানতে পারবেন আমাদের এই আকাশগঙ্গায় (মিল্কি ওয়ে) কী ভাবে তৈরি হয়েছিল সূর্যের মতো আরও লক্ষ কোটি তারা। জানার চেষ্টা করবেন আমাদের আশপাশের ‘অন্যান্য পাড়া’য় (অন্য গ্যালাক্সিগুলিতে) তারা বা নক্ষত্রদের শরীর গড়ে উঠেছিল কী ভাবে। জানতে পারবেন সেই তারারা কী ভাবে চলে বা ছোটে আমাদের আকাশগঙ্গা বা তার আশপাশের গ্যালাক্সিগুলিতে। ভারতে বসেই, এই প্রথম!
দেবস্থলে পাহাড়চুড়োয় ‘এরিজ’ চত্বরে সেই অবজারভেটরি
নৈনিতালের উত্তর-পূর্বে দেবস্থলের আড়াই হাজার মিটার (এভারেস্টের উচ্চতার এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি) বসে ‘দেবস্থল অপটিক্যাল টেলিস্কোপে’র (ডিওটি) ব্রহ্মাণ্ডে ‘নজরদারি’ শুরু হবে খুব শিগগিরই। নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে গিয়ে মার্চে যখন প্রধানমন্ত্রী সত্যি-সত্যিই উপলব্ধি করতে শুরু করবেন, জিডিপি’টা কেন প্রত্যাশামাফিক ৭.৬ শতাংশ না হয়ে ৭.১ শতাংশে আটকে থাকল, তার আগেই দেবস্থলে শিব মন্দিরের সামনে বসে মহাকাশে ‘ঈশ্বরের অপার রহস্যে’র জাল কাটতে শুরু করে দেবেন ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
এই সেই ‘দেবস্থল অপটিক্যাল টেলিস্কোপ’ (ডিওটি)
ডিওটি’র বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও তার নকশা
পুণের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ত্রোফিজিক্সের (আয়ুকা) অধ্যাপক ও ভারতের গর্বের উপগ্রহ ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর সায়েন্টিফিক অপারেশনের প্রধান জ্যোতির্বিজ্ঞানী দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এই খবর দিয়ে বলেছেন, ‘‘২০০ কোটি টাকার ওই প্রকল্পে দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বেলজিয়াম সরকার। বেলজিয়াম এই প্রকল্পে দিয়েছে ২০ লক্ষ ইউরো। গোটা এশিয়া মহাদেশে এই ‘দেবস্থল অপটিক্যাল টেলিস্কোপ’টিই হবে বৃহত্তম অপটিক্যাল টেলিস্কোপ। যার লেন্সের ব্যাস হবে ৩.৬ মিটার।
আরও পড়ুন: আতঙ্কের স্মৃতি আর ফিরে আসবে না বহু দিন পর! পথ দেখালেন বাঙালি
তার মানে, মহাকাশে বসানো ‘হাব্ল স্পেস টেলিস্কোপের লেন্সের ব্যাসের (২.৪ মিটার) চেয়েও বেশ কিছুটা বড় হবে দেবস্থলের টেলিস্কোপের লেন্স। ফলে এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রায় সূদূরতম প্রান্তে লুকিয়ে থাকা বহু মহাজাগতিক বস্তুর ক্ষীণতম ‘সিগন্যাল’ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে একেবারে সচিন তেন্ডুলকরের মতো ব্যাটসম্যান হয়ে উঠতে পারে দেবস্থলের এই টেলিস্কোপ। ওই টেলিস্কোপটি দেখভালের দায়িত্ব থাকবে নৈনিতালের ‘আর্যভট্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ অবজারভেশনাল সায়েন্সেস’ (‘এরিজ’)-এর হাতে। যেখানে ওই টেলিস্কোপটি বসানো হয়েছে, তা ‘এরিজ’-এর ক্যাম্পাসের মধ্যেই পড়ে। যার প্রোজেক্ট ম্যানেজার ‘এরিজ’-এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ব্রিজেশ কুমার।’’
এই সেই ‘দেবস্থল অপটিক্যাল টেলিস্কোপ’ (ডিওটি) ভবনের মধ্যে ‘মিরর কোটিং প্ল্যান্ট’
ভারতে এত বড় অপটিক্যাল টেলিস্কোপ ছিল না এর আগে। গত শতাব্দীর আশির দশকে কাভালুরে বসানো হয়েছিল একটি অপটিক্যাল টেলিস্কোপ। সেটাই আমাদের দেশের প্রথম কোনও অপটিক্যাল টেলিস্কোপ। তার লেন্সের ব্যাস ছিল ২ মিটার। পরে ২০০৪ সালে লে’র হানলেতে বসানো হয়েছিল আরও একটি অপটিক্যাল টেলিস্কোপ। তারও ব্যাস ছিল ২ মিটার। কিন্তু কাভালুরের টেলিস্কোপটির অসুবিধা হল, পর্যবেক্ষণের জন্য বছরে অনেকটাই কম সময় পরিষ্কার রাতের আকাশ (ক্লিয়ার নাইট স্কাই) পাওয়া যায় কাভালুরে। আর হানলের টেলিস্কোপটির অসুবিধা হল, সেটি যেখানে বসানো হয়েছে, সেখানে পর্যবেক্ষণের জন্য পরিষ্কার রাতের আকাশ পাওয়ার সুযোগ মেলে কম। তার তুলনায় সেই সুযোগ অনেক বেশি মিলবে দেবস্থলে। তা ছাড়াও হানলের টেলিস্কোপের চেয়ে আকারে প্রায় দ্বিগুণ বড় দেবস্থলের টেলিস্কোপটি।’’
হাবল স্পেস টেলিস্কোপের তোলা ছবি
কেন বৃহত্তম অপটিক্যাল টেলিস্কোপ বসানোর জন্য বাছা হয়েছে দেবস্থলকে?
জ্যোতির্বিজ্ঞানী দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, ব্রিজেশ কুমার ও ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায়
নৈনিতালের ‘আর্যভট্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ অবজারভেশনাল সায়েন্সেস’-এর জ্যোতির্বিজ্ঞানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘বর্ষাকাল ছাড়া বছরে অনেক বেশি সময় রাতের আকাশ একেবারে ঝকঝকে তকতকে পাওয়া যায় দেবস্থলে।’’
কিন্তু কেন বেলজিয়াম সরকারও উৎসাহী হল এই যৌথ প্রকল্পে ইউরো ঢালতে?
এই সেই ‘দেবস্থল অপটিক্যাল টেলিস্কোপ’ (ডিওটি)। নির্মাণ কাজের সময়
অপটিক্যাল, এক্স রে, রেডিও টেলিস্কোপ রয়েছে পৃথিবীর কোথায় কোথায়
ইন্দ্রনীল বলছেন, ‘‘পৃথিবীর অন্য অন্য অপটিক্যাল টেলিস্কোপগুলির বেশির ভাগটাই রয়েছে চিলি, হাওয়াই দ্বীপ, স্পেন বা জাপানে (এনএওএ)। কিন্তু একেবারেই অন্য একটি লঙ্গিচিউড বা দ্রাঘিমাংশে একটি শক্তিশালী অপটিক্যাল টেলিস্কোপ বসানোটা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ ও তথ্য বিশ্লেষণের জন্য খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। অনেকটা কপালের দু’পাশে থাকা দু’চোখ দিয়ে দেখলে আমরা যেমন একটা চোখে দেখার চেয়ে অনেক বেশি ভাল ভাবে দেখতে পাই, ঠিক তেমনই দেবস্থল যেখানে রয়েছে, সেই দ্রাঘিমাংশে একটি শক্তিশালী অপটিক্যাল টেলিস্কোপ বসানো খুবই জরুরি ছিল। ওই দেবস্থলেই আরও একটি টেলিস্কোপ বসানো হবে বেলজিয়াম সরকারের সঙ্গে যৌথ সহযোগিতায়। তার নাম- ‘ইন্টারন্যাশনাল লিক্যুইড মিরর টেলিস্কোপ’ (আইএলএমটি)। সেই টেলিস্কোপটিও বানাচ্ছে বেলজিয়ামেরই একটি নামজাদা সংস্থা। বেলজিয়ামের কাচের আদর-কদর তো সেই প্রায় আদ্যিকাল থেকেই!’’
কী কী কাজ করবে এশিয়ার এই বৃহত্তম অপটিক্যাল টেলিস্কোপ?
ইন্দ্রনীল বলছেন, ‘‘দেবস্থল পাহাড়চুড়োয় যেখানে বসানো হয়েছে এই ৩.৬ মিটার ব্যাসের লেন্সের অপটিক্যাল টেলিস্কোপ, তার মাত্র ২০০ মিটার নীচেই রয়েছে ১.৩ মিটার ব্যাসের লেন্সের একটি অপটিক্যাল টেলিস্কোপ। সেই টেলিস্কোপ ব্রহ্মাণ্ডের ওপর ‘নজরদারি’ চালিয়ে যে তথ্য বা ছবি তুলে আনবে, সেগুলির আলোক বর্ণালীকে অনেক অনেক বেশি সূক্ষ্ণ ভাবে বিশ্লেষণের জন্য একটি স্পেকট্রোস্কোপ থাকছে ওই ডিওটি-তে। যার নাম- ‘এরিজ দেবস্থল ফেইন্ট অবজেক্ট স্পেকট্রোগ্রাফ ক্যামেরা’ (এডিএফওএসসি বা ‘অ্যাডফস্ক’)। যে বিশেষজ্ঞ দলটি ‘অ্যাডফস্ক’ বানিয়েছে, তার নেতৃত্বে রয়েছেন অধ্যাপক অমিতেশ ওমর। টেলিস্কোপটিকে যে ‘ডোম’-এ রাখা হবে, তার নির্মাণ কাজ তদারকির নেতৃত্ব দিয়েছেন অধ্যাপক মহেশ্বর গোপীনাথন এ ছাড়াও ইনফ্রা-রেড তরঙ্গ বা কম্পাঙ্ক মাপার জন্য থাকছে একটি ইনফ্রা-রেড স্পেকট্রোস্কোপ। যেটা বানিয়েছে মুম্বইয়ের ‘টাটা ইনস্টিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’ (টিআইএফআর)। নতুন নতুন সুপারনোভার তথ্য জানাতে পারবে এই ডিওটি। এর মাধ্যমে ‘গামা রে’ বার্স্ট’ (জিআরবি) বা ‘অ্যাকটিভ গ্যালাক্টিক নিউক্লি’র (এজিএন) অনুসন্ধানের কাজও করা যাবে অনেক বেশি নিখুঁত ভাবে।’’
ছবি: আর্যভট্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব অবজারভেশনাল সায়েন্সেস, নৈনিতাল