রেকুন ডগ। ছবি: সংগৃহীত।
‘আবার আসিব ফিরে’— এমন আশঙ্কার কথা এখনই শোনা যাচ্ছে না বটে, তবে ‘সে আসিয়াছিল কোন পথ ধরিয়া’ সে ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছেন মার্কিন এবং ফরাসি জীব বিজ্ঞানীদের একাংশ। রেকুন ডগ!
চার বছর আগের, পুরনো ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ পড়লে, অধিকাংশেরই স্মৃতিতে যে স্বজন হারানো আতঙ্কের দিন ঝলসে ওঠে, সেই করোনা ভাইরাসের মূল বাহক হিসেবে এই সারমেয় গোত্রের প্রাণীটির দিকেই সম্প্রতি আঙুল তুলছেন বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীর তামাম ভাইরাস বা জীবাণু গবেষকদের অনেকেই তাকে সন্দেহের চোখে দেখছিলেন বেশ কিছু দিন যাবৎ। সম্প্রতি তাঁদের অধিকাংশই স্পষ্ট করে দিয়েছেন, বাদুড়, ভাম (পাম সিভেট) কিংবা শুয়োর নয়, কোভিড-১৯’এর জীবাণুকে সংক্রামিত করার প্রশ্নে পয়লা নম্বরে রয়েছে এই পাঁশুটে রঙের লোমশ এবং অতি আদুরে দেখতে প্রাণীটি।
একে ত্যাজ্য করতে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দিন কয়েক আগেই আমেরিকা ও ফ্রান্স তো বটেই, পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের আরও সাতটি দেশ জানিয়ে দিয়েছে, রেকুন ডগকে পোষ্য করা যাবে না। এ বার এ দেশের পরিবেশ ও বন মন্ত্রকও সে পথেই হাঁটল। রেকুন ডগকে পোষ্য হিসেবে ঘরে রাখা কিংবা তার বিকিকিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। ভারতে অবশ্য রেকুন ডগ বিশেষ মেলে না। তবে পরিবেশ মন্ত্রকের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘নতুন করে ফের বিপদ ডেকে আনতে কে চায়! এ দেশে ওই সারমেয়র প্রবেশ নিষেধ।’’
গবেষকদের অনুমান, চিনের হুনান প্রদেশের ইউনান শহরের এক সামুদ্রিক মাছের বাজার থেকেই রেকুন ডগের মধ্যে করোনার জীবাণু প্রথম ছড়িয়েছিল। কারণ, ইউনানের ওই বাজারে মাছের সঙ্গেই পশু-পাখির বিকিকিনির চল রয়েছে দেদার। আমেরিকার সিয়াটল-এ ফ্রেড হাচিসন ক্যানসার রিসার্চ সেন্টারের গবেষক জেস ব্লুম তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণায় বিষয়টি প্রথম নজরে আনেন। গবেষণাপত্রে ব্লুম জানিয়েছেন— রেকুন ডগই যে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের অন্যতম বড় হাতিয়ার ছিল তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু ওই সামুদ্রিক বাজারে করোনার জীবাণু কী করে এল, তা নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
ওই গবেষণাগারেই সহকারী হিসেবে রয়েছেন আদতে কেরলের বাসিন্দা গবেষক জোসেফ বিজয়ন। তিনি বলেন, ‘‘সার্স সংক্রমণের সময় থেকেই রেকুন ডগ ছিল সন্দেহের তালিকায়। ইউনানের ওই মাছের বাজার থেকে বিভিন্ন তথ্য এবং নমুনা সংগ্রহ করেই আমাদের গবেষণার কাজ চলছিল। ফ্রান্সের একটি দলও ওই বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা শুরু করে। দু’দেশের গবেষণাগারে সাড়ে তিন বছর ধরে বিভিন্ন পরীক্ষার পরে করোনা সংক্রমণের সম্ভাব্য মূল বাহক হিসেবে আমরা রেকুন ডগের দিকেই আঙুল তুলছি। তবে, বিজ্ঞানে চূড়ান্ত করে কিছু বলা যায় না। তাই ‘সম্ভাব্য শব্দটি ব্যবহার করতে হল।’’
আমেরিকা কিংবা পশ্চিম ইউরোপ ও জাপানে আকছার ঘুরে বেড়ানো রেকুন (যার বৈজ্ঞানিক নাম প্রকিওন লোটোর) নয়, চৈনিক বংশোদ্ভুত রেকুন ডগ (নিসটেরেউটেস প্রোসিওনোডেস) আদতে রেকুন সদৃশ্য লোমশ এক ধরনের কুকুর। সারা গায়ে পাঁশুটে আর কালো রঙের প্রলেপ। পায়ের গড়ন ক্ষুদে। খাড়া কান, ছুঁচলো মুখ আর ছোট্ট নাক। সাকুল্যে দেড় থেকে দু’ফুট দৈর্ঘ্য আর উচ্চতায় মেরে কেটে ফুট আড়াই। মূলত চিন-জাপানের বাসিন্দা রেকুন ডগকে পোষ্য করার নজির বিশেষ নেই। দেদার শিকারও করা হয় প্রাণীটিকে। তার পশমের তৈরি কোট, মাফলারের চাহিদা রয়েছে চিনা বাজারে। আর রয়েছে রেকুন ডগের মাংস খাওয়ার প্রবণতা।
বিপদটা ঘনিয়েছিল এখান থেকেই। আমেরিকান গোয়েন্দাদের দাবি, চিনের হুনান প্রদেশে বিভিন্ন বাজারে প্রকাশ্যেই রেকুন ডগ-এর পশম, মাংস বিক্রি হয়। কোভিড পর্বের পরে তাতে রাশ টানা হলেও এখনও চোরাগোপ্তা সে কারবার চালু রয়েছে বলেই ওই গোয়েন্দাদের দাবি। তা হলে উপায়? বিজয়ন বলছেন, ‘‘এর কোনও নিশ্চিত উত্তর নেই। তবে, সারমেয়প্রেমীদের বলি, আপাতত ওই আদুরে প্রাণীটি থেকে মুখ ফিরিয়েই থাকুন!’’