ঠিক ১০০ বছর আগের কথা। ১৯২১ সালে প্যারিসের চেরাইট হাসপাতালে এক সুস্থ সন্তানের জন্ম দিয়েই মারা গেলেন মা। বাবা নেই। শিশুটি তাই জন্মেই অনাথ। মায়ের মৃত্যুর কারণ যক্ষ্মা। তবে কি এই শিশুকেও সেই রোগে ধরতে পারে? তা হলে তো বাঁচানোর কোনও উপায় নেই। ভাগ্য ভাল, সেই হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন বেঞ্জামিন হেল আর রেমন্ড টারপিন। ক্ষণিকের মধ্যে তাঁরা এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সদ্যোজাত শিশুটিকে টিকা দিতে হবে, যাতে ওর যক্ষ্মা না হয়। কোন টিকা? দু’বছর আগেই ক্যালমেট আর গুয়েরিন যে টিকা প্রাণীদের উপর পরীক্ষা করে জানিয়েছেন, মানুষের উপরে নিশ্চিন্তে নাকি এই টিকা ব্যবহার করা যাবে। এত দিন কোনও স্বেচ্ছাসেবক পাচ্ছিলেন না তাঁরা। এই সুযোগে সেই অনাথ শিশুর উপর তাঁরা প্রয়োগ করলেন নতুন টিকা। তবে ইঞ্জেকশন নয়। সাসপেনশন বানিয়ে খাইয়ে দেওয়া হল শিশুটিকে। তিন মাস অপেক্ষা করে দুই ডাক্তার নিশ্চিত ভাবে জানালেন, এই টিকা মানুষের উপযোগী। কোনও ক্ষতি হয় না এতে। তিন বছরের মধ্যেই ইউরোপে মোট ৬৬৪ জন সদ্যোজাত শিশুকে এই টিকা দেওয়া হল। সাত বছরের মধ্যে সংখ্যাটা বেড়ে হল ১,১৪,০০০। মানুষ যক্ষ্মাকে জয়ের অস্ত্র হাতে পেল। তবে এ সব কিছুই হত না, যদি না ১৯০০ সালে লিলির পাস্তুর ইনস্টিটিউটে একটা দুর্ঘটনা ঘটত।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে বারে বারে দুরারোগ্য ব্যাধি হিসেবে যক্ষ্মার উল্লেখ মেলে। মাত্র একটা প্রজাতির ব্যাকটিরিয়া আজ অবধি যত মানুষের প্রাণ নিয়েছে, তেমনটা আর কেউ পারেনি। ১৮৮২ সালে রবার্ট কখ এক যুগান্তকারী আবিষ্কার করেন। যক্ষ্মার জন্য দায়ী জীবাণু মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস-কে তিনি চিহ্নিত করে আলাদা করতে সক্ষম হন। কিন্তু এই জীবাণুকে কাবু করা যাবে কী ভাবে? ১৯০০ সালে পাস্তুর ইনস্টিটিউটে এই ব্যাকটিরিয়াকে জব্দ করতেই গবেষণা করছিলেন আলবার্ট ক্যালমেট আর ক্যামিলে গুয়েরিন। তাঁরা যক্ষ্মার ব্যাকটিরিয়াকে গ্লিসারিন আর আলুর রসের মিশ্রণে রেখে বৃদ্ধি পরীক্ষা করছিলেন। একটা সমস্যা হচ্ছিল। এই মাধ্যমে ব্যাকটিরিয়াগুলো নিজেদের মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। ফলে অণুবীক্ষণে তাদের আলাদা করা যাচ্ছিল না। নেহাত আন্দাজে ঢিল মারার মতোই তাঁরা এর সঙ্গে ষাঁড়ের যকৃতের রস মিশিয়ে কী হয় দেখতে চান, আর হিসেবে গন্ডগোল হওয়ায় পরিমাণের চেয়ে একটু বেশিই মিশিয়ে ফেলেন।
ফলটা প্রথম খেয়াল করেন গুয়েরিন। অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে জারের মধ্যে রাখা ব্যাকটিরিয়ার ভিতরে। আচমকা সেগুলো মারা যাচ্ছে, আর যারা বেঁচে থাকছে, তাদেরও ক্ষতি করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে অনেক গুণ। এটাই তো তাঁরা চাইছিলেন! কাজ শুরু হল যকৃত রস, গ্লিসারিন আর আলুর রস দিয়ে। গবেষণায় সাফল্যের দোরগোড়ায়, এমন সময় শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানরা ফ্রান্সের লিলি দখল করল। ক্যালমেট-গুয়েরিন ভাবলেন, এ বার তীরে এসে তরী ডুবল হয়তো। পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাবে অনিশ্চিত কালের জন্য। কিন্তু এখানেও মানবতা তার আলোকিত মুখটা দেখাল। জার্মান পশুচিকিৎসকদের স্মরণাপন্ন হলেন তাঁরা। জার্মান চিকিৎসকেরা ক্যালমেটদের লুকিয়ে সরবরাহ করতে লাগলেন আলু আর ষাঁড়ের যকৃত রস। যুদ্ধের মধ্যেও চলতে লাগল কাজ।
১৯১৯ সালে প্রায় ২৩০ রকম মাইকোব্যাকটেরিয়ামের উপরে পরীক্ষা চালিয়ে ক্যালমেট-গুয়েরিন একটি অদ্ভুত মাইকোব্যাকটিরিয়ার প্রজাতি খুঁজে পেলেন। অদ্ভুত, কারণ এটা প্রাণিদেহে প্রবেশ করলে যক্ষ্মার কোনও রকম উপসর্গ দেখায় না, বরং প্রাণিদেহে ক্ষতিকর মাইকোব্যাকটিরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে। গিনিপিগ, খরগোশ, গরু আর ঘোড়ার উপরে চলল পরীক্ষা। ফলাফল দেখে চমকে উঠলেন বিজ্ঞানীরা। আশাতীত সাফল্য। গুয়েরিন এই ব্যাকটিরিয়ার নাম দিলেন ব্যাসিলি বাইল ক্যালমেট-গুয়েরিন। পরে বাইল বাদ দিয়ে সংক্ষেপে বিসিজি।
১৯২১ সালে মানবদেহে প্রথম বার ব্যবহারের ন’বছর পরে লুবেক জেনারেল হাসপাতালে ঘটল ভয়ানক এক দুর্ঘটনা। পাস্তুর ইনস্টিটিউট থেকে আনা বিসিজি ভ্যাকসিন দেওয়া হল ২৫০ জন সদ্যোজাতকে। ৭৩ জন মারা গেল কিছু দিনের মধ্যেই। ১৩৫টি শিশুর ভয়ানক যক্ষ্মা হলেও তারা সেরে উঠল। জার্মান সরকার রীতিমতো তদন্ত কমিটি বসাল। কমিটি রিপোর্ট দিল, পাস্তুর ইনস্টিটিউটের বিসিজি থেকেই সংক্রমণ ঘটেছে। উপসর্গহীন ব্যাকটিরিয়ার বদলে শিশুদের দেহে ঢোকানো হয়েছে ক্ষতিকর ব্যাকটিরিয়ার প্রজাতি। অনেক দেশ বিসিজি-কে ত্যাগ করল চিরকালের মতো। যদিও এশিয়ায় জনপ্রিয়তা পায় বিসিজি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত ভারত-সহ একাধিক দেশ তখন ঔপনিবেশিক পরীক্ষাগার। অবশ্য স্বাধীনতার পরে ভারত সরকার নিজেই এই টিকা তৈরি করতে শুরু করে। প্রস্তুতকারক ইউনিট তৈরি হয় মাদ্রাজের (বর্তমান চেন্নাই) কিং ইনস্টিটিউটে।
কিন্তু আজকের দিনে বিসিজি নিয়ে এই আলোচনা কেন? গত এক বছর ধরে গোটা পৃথিবী কাঁপছে করোনা জ্বরে। সবাই গৃহবন্দি। দিন গুনছি কবে আসবে আমাদের বহু প্রতীক্ষিত সেই টিকা। মজার ব্যাপার, কিছু দিন আগেই রাশিয়ার বিজ্ঞানীদের গবেষণায় জানা গিয়েছে, যে সব দেশের বেশির ভাগ জনগণই শিশু অবস্থায় বিসিজি ভ্যাকসিন নিয়েছে, সেই সব দেশে করোনার প্রকোপ কম। এখনও অবধি এর কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যেটা পাওয়া গিয়েছে, সেটা নিতান্তই পারিপার্শ্বিক প্রমাণ। রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা ভারতের নাম উল্লেখ করে জানাচ্ছেন, “সদ্যোজাতদের দেহে বিসিজি টিকা তাদের ইমিউন সিস্টেম এমন ভাবে পরিবর্তন করে দেয়, যাতে করোনাভাইরাস সহজে আক্রমণ করতে পারে না, বা পারলেও তার ক্ষতি করার ক্ষমতা কমে যায়।” ভারতে সেই অর্থে কম সংক্রমণ বা মৃত্যুর কারণও নাকি এই বিসিজি টিকা। পৃথিবীর নানা দেশে গত এক বছরে কোভিড সংক্রমণের তালিকার বিচার করে বিখ্যাত জার্নাল জুভেনিস সাইন্টিয়া-তে তাঁরা এই গবেষণা ছেপেছেন। ভারত, চিন, জাপান ও ফিনল্যান্ডে করোনার কম প্রকোপের কারণই নাকি এই সব দেশে জাতীয় কার্যক্রমের মধ্যে শিশুদের বিসিজি টিকাকরণকে রাখা। আমেরিকা, ইটালি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম বা পূর্বতন পশ্চিম জার্মানিতে এই রোগের প্রকোপ প্রবল। তার কারণ নাকি এ সব দেশে হয় কোনও দিন বিসিজি দেওয়া হয়নি, নয়তো অন্তত কুড়ি বছর আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জার্মানির যে অংশ পূর্ব জার্মানিতে ছিল, সেখানে এক কালে বিসিজি দেওয়া হত, তাই সেখানে করোনার প্রকোপ কম।
ঠিক ১০০ বছর আগের এক টিকা তাই আবার খবরে। হয়তো যক্ষ্মার মতোই করোনাকেও নেপথ্যে থেকে রুখে দিয়েছে বিসিজি।
বিজ্ঞানী, ধান্য গবেষণাকেন্দ্র, চুঁচুড়া