ছানা আর ডালের মিছে ডিমের ডালনার স্বাদ ভোলার নয়। ছবি: সায়ন্তনী মহাপাত্র।
মানুষের মনের মধ্যেও কত যে খুপরি থাকে! সেই কুঠরিতে ছোট ছোট দুঃখ, কান্না, হাসির সঙ্গে ছবির মতো ঘুমিয়ে থাকে হরেক স্মৃতি। সেও কোনও এক সময়ের কথা। জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লপক্ষ শুরু হলেই তখন তোড়জোড় শুরু হত জামাইষষ্ঠীর। সে কাজের পুরোভাগে থাকতেন খয়েরে রাঙানো হাসিমুখের একদল মহিলা। জামাইকে রেঁধেবেড়ে খাওয়ানো আর আপ্যায়নে যেমন তাঁদের ছিল না কোনও খামতি, তেমনই ছিল না জামাইঠকানো রান্না করাতেও। সেই রকমেরই মানুষ আমাদের ঊষারানি দেবী। দিনের আলো না ফুটতেই তাঁর কাজ শুরু হত। চাষের সময় রাজ্যের ধান সিদ্ধ, যৌথ পরিবারের হরেক জনের আবদার আর ঊনকোটি কাজ মিটিয়েও জামাইষষ্ঠীর সময় জামাই ঠকাতে বানিয়ে ফেলতেন মোচার বড়া দিয়ে নকল পাবদার ঝাল, ছানা আর ডালের মিছে ডিমের ডালনা, কাঁঠালের মাছ আরও কত কী!
শুধু কি তাই? জামাই ঠকাতে শ্যালিকা কুলকে তিনি হাতে ধরে শেখাতেন কাঁঠালের বীজ কেটে ছাঁচের সন্দেশ, বিচুলি ভেজানো জলের মিছরির পান্না আর পিপুল পাতার পান বানানোর হরেক কিসিম। সেই খেয়ে অধোবদন জামাইয়ের লাজেরাঙা মুখ, ভারী তাঁর রগড়! চেয়ারে বসে সে দৃশ্য দেখে আর হাসি থামত না স্বভাবে গম্ভীর জ্যাঠা-কাকাদেরও। সরল আনন্দের সেই হাসিতে যোগ দিতে, রান্নার ফাঁকে হেঁশেল থেকে উঁকি দিয়ে যেতেন সাহায্যকারী মানদা দিদিও।
কিন্তু কাঁসার রেকাবে পিটুলি গোলা দুধের উপরে সাজানো ঘন সর দেখে ভারী চোখ জ্বালা করত দিদির! স্মৃতি কি আর শুধুই সুখের!
ঘরছাড়ার দুঃসহ সেই রাতে, কোলে কাঁধে দুধের শিশুদের নিয়ে রাতারাতি বর্ডার পেরোনোর স্মৃতি কেন জানি ফিরে ফিরে আসত ওই নকল দুধ দেখে। উদ্বাস্তু শিবিরে খিদের জ্বালায় কাঁদা শিশুর পেট ভর্তি করতে ভরসা ছিল ওই পিটুলি গোলা জল। ওপারের ভাতের গন্ধফোটা মাটির উঠানে বাঁধা ধবলী গাইয়ের মুখ মনে করে চোখের জলে বুক ভেসে যেত রাতের পর রাত। তবুও বেড়া পেরিয়ে নিজের ভিটাতে ফিরতে পারল না দিদি। দিদির মনে পড়ে যায়, দিনের পর দিন রেশনের মোটা চালের ভাতের পাশে চাকা করে ভাজা বেগুনকেই সন্তানদের মাছ বলে ভুলিয়ে খাওয়ানোর কথা! সে দুঃখ যে মায়ের প্রাণে বড় কঠিন সুরে বাজে।
সময়ের অভিঘাতে হারিয়ে গেছেন ঊষারানির মতো রন্ধনশিল্পীরা, হারিয়ে গিয়েছে জামাইষষ্ঠী ঘিরে ঘরে ঘরে সেই জাঁকজমক, মিছে খাবারের রগড়। তবু শহরের আনাচে কানাচে রয়ে গিয়েছে শত শত মানদা দিদি। সময়ের কোনও হিসেব, দেশের কোনো গণ্ডি এখনও তাঁদের বের করে আনতে পারে না এই মানুষ ভুলোনো মিছে রান্নার ইতিবৃত্ত থেকে।
জামাইয়ের সঙ্গে একটু রসিকতা না হয় হলই, ষষ্ঠীর ভোজে পরিবেশন করুন মিছে ডিমের ডালনা।
উপকরণ:
ছানা: ২ কাপ
ছোলার ডাল: ৩/৪ কাপ (চার ঘণ্টা জলে ভেজানো)
আলু: ৩ টি মাঝারি মাপের
আদা বাটা: ২ টেবিল চামচ
পেঁয়াজ: ১ কাপ কুচোনো
রসুন বাটা: ১ চা চামচ
টম্যাটো: ১ টি মাঝারি
জিরে গুঁড়ো: ২ চা চামচ
ধনে গুঁড়ো: ২ চা চামচ
লাল লঙ্কার গুঁড়ো: স্বাদমতো
হলুদ গুঁড়ো: ১ চা চামচ
নুন: স্বাদমতো
সর্ষের তেল: আধ লিটার
তেজপাতা: ১ টি
ছোট এলাচ: ১ টি
লবঙ্গ: ৩ টি
দারচিনি: ১/২ ইঞ্চি টুকরো
গরম মশলা গুঁড়ো: ১/৩ চা চামচ
চিনি: সামান্য
ময়দা: ১/৩ কাপ
জামাইষষ্ঠীর ভোজে থাকুক মিছে ডিমের ডালনা। ছবি: সায়ন্তনী মহাপাত্র।
প্রণালী:
ভেজানো ছোলার ডাল খুব সামান্য জল দিয়ে শুকনো করে সেদ্ধ করে নিতে হবে। এমন ভাবে মাখতে হবে যাতে বেশ সুন্দর মণ্ড তৈরি করা যায়। একটি পাত্রে ছানাটাকেও ভাল করে এক চামচ ময়দা দিয়ে মেখে একটা মণ্ড তৈরি করতে হবে।
এর পর করে এক চামচ তেল গরম করে তাতে ১ চামচ করে আদা, জিরে ও ধনে গুঁড়ো, সামান্য হলুদ দিয়ে নরম আঁচে কষিয়ে নিতে হবে। সুগন্ধ বেরোলে এর অর্ধেক ছানাতে আর অর্ধেক ডাল সেদ্ধতে দিতে হবে। পরিমাণ মতো নুন দিয়ে এগুলিকে আলাদা আলাদা করে মেখে নিতে হবে।
ছানা এবং ডাল এর মিশ্রণটিকে ছয়টি ভাগে ভাগ করতে হবে। ডালের মিশ্রণটিকে ভাল করে চেপে একদম ডিমের কুসুমের মতো গোলাকার আকার দিতে হবে। এ বারে এক ভাগ ছানার মধ্যে ওটিকে দিয়ে চেপে চেপে বেশ ডিমের আকার দিতে হবে। এই বার নকল ডিমগুলিকে ময়দায় ভাল করে গড়িয়ে এক ঘণ্টা ফ্রিজে রাখতে হবে।
আলুর খোসা ছাড়িয়ে অর্ধেক করে কেটে নিতে হবে। তেল গরম করে নকল ডিম এবং আলু লাল করে ভেজে তুলে রাখতে হবে।
এ বারে কড়ায় ৩ চামচ তেল গরম করে প্রথমে গোটা গরম মশলা ফোড়ন দিয়ে সুগন্ধ বেরোলে পেঁয়াজ, আদা-রসুন, ধনে, জিরে একে একে দিয়ে ভাল করে কষিয়ে নিতে হবে। তার পর প্রয়োজন মতো নুন, চিনি, হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো, টম্যাটো দিতে হবে। মশলা ভাল করে কষিয়ে নিয়ে দেড় কাপ জল দিতে হবে।
জল ফুটে উঠলে আলু দিয়ে ঢাকা দিতে হবে। আলু সেদ্ধ হয়ে গেলে ছানার ডিমগুলি ঝোল এ দিয়ে একটু নেড়ে গ্যাস বন্ধ করে দিতে হবে। উপর থেকে গরমমশলা ছড়িয়ে কিছু ক্ষণ ঢেকে রাখলেই তৈরি নিরামিষ ডিমের ডালনা।