আজ থেকে ঠিক ২০১৪ বছর আগের দিনটা জেন-ওয়াইয়ের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওই দিন বেথলেহেমে জন্ম নিয়েছিলেন জেন-ওয়াইয়ের এক প্রতিনিধি— এমনটা বলা খুব একটা ভুল নয় বোধহয়!
জেন-ওয়াই যেমন সব কিছুকে নস্যাৎ করে ওড়াতে চায় তারুণ্যের বিজয়পতাকা, যিশু নামের সেই যুবকও তেমনটাই করেছিলেন। তাঁর মতামত এবং লাইফস্টাইল ছিল সেই সময়কার চলতি হাওয়ার পরিপন্থী। এ সবের সঙ্গে যদি ধর্মমতকে জুড়ে দেওয়া যায়, তবে সেই বিচারেও তিনি জেন-ওয়াই!
তার পর দু’হাজার বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু, জেন-ওয়াই স্বভাবে খুব একটা বদলায়নি। তারা রয়ে গিয়েছে সেই বাঁধনছেঁড়া অভ্যেসে, নিজেদের যাত্রাপথের আনন্দগান নিয়ে। তা সেই জেন-ওয়াই ক্রিসমাস নিয়ে কী ভাবছে? তারা ক্রিসমাস সেলিব্রেট করে, না কি বড়দিন পালন করে? দু’টির মধ্যে আদৌ কি কিছু তফাত আছে?
হুল্লোড়ের ধরন বলছে, একটা স্পষ্ট বর্ডার লাইন আছে এই দুই ঘরানার মধ্যে। বড়দিন যেন কিছুটা সাবেকি! আর ক্রিসমাস হেপ! ২৪ ডিসেম্বরের রাতে গির্জায় ক্যারল শুনতে যাওয়া, ২৫-এর সকালে আর এক প্রস্থ গির্জা ঘুরে, কেক কেটে, পরিবারের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো— এই হল বড়দিনের কিসসা।
আর ক্রিসমাস? সেখানে নিয়ন আলোর ঘূর্ণি, পা থেকে মাথা পর্যন্ত রঙের বন্যা, মন যা চাইছে তেমন ভাবে সেজে ওঠা আর শরীরী দোলাচলের উন্মাদনা! জেন-ওয়াই আজ ২৫ ডিসেম্বরে দুই ঘরানাতেই তাল ঠুকছে। তারা ধর্মেও আছে, আবার হুল্লোড়েও।
ক্রিসমাসের দিন দুয়েক আগে সন্ধেবেলা পার্ক স্ট্রিট ঘুরতে এসে সে কথাই বলছিল হিন্দু স্কুলের সায়ন ভট্টাচার্য। দশম শ্রেণির এই ছেলেটির কাছে ২৫ ডিসেম্বর মানেই বড়দিন। তবে ক্রিসমাস ইভে সে বিলক্ষণ হেপ! মাথায় আলো জ্বলা সান্টা টুপিতে সে যেন পার্ক স্ট্রিটের রাজা! “আজ তো পার্ক স্ট্রিটে এসেছি! যত ক্ষণ পা ব্যথা না করে, ঘুরব। তবে, বেশি ক্ষণ থাকা যাবে না। রাত ন’টার মধ্যে বাড়ি না ফিরলে চাপ হয়ে যাবে।” বলল সায়ন। যাহ্! মাত্র এইটুকুতেই উন্মাদনা খতম? “কে বলেছে! কালকের সারাটা দিন আছে কী করতে! কাল ‘পি কে’ দেখতে যাব ঠিক করেছি। আর বাইরে খাব।” বলেই ভিড়ের মধ্যে ‘হ্যাপি ক্রিসমাস ইভ’ আওয়াজ তুলে দলবল বেরিয়ে গেল সায়ন!
সায়নের মতো জেন-ওয়াইয়ের অনেকেই ক্রিসমাস উদযাপন করতে ঠেক হিসেবে পার্ক স্ট্রিটকেই বেছে নিচ্ছে। কেননা, এখানে চার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু নাইটক্লাব। রয়েছে অগুনতি মধুশালাও! রক্ষণশীলরা জোর আপত্তি তুলতে পারেন! তাঁরা বলতে পারেন, “জেন-ওয়াইয়ের মদ খাওয়াকে সমর্থন করার জন্য নরকবাসই প্রাপ্য।” ক্রিসমাস মদ ছাড়া, আর একটু স্পষ্ট করে বললে ওয়াইন ছাড়া হয় নাকি আবার! খোদ যিশুই তো তাঁর শিষ্যদের শেষ ভোজনে মদ আর রুটি খাইয়েছিলেন! খ্রিস্টান মতে ওয়াইন তাঁর রক্তধারা!
“পঁচিশে ডিসেম্বর আমি সবার আগে যাই বো ব্যারাক।” সামপ্লেস এলস্-এ ঢোকার মুখে কথাটা জানিয়ে গেল অর্ক মজুমদার। অর্ক সবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ঢুকেছে। হিসেব মতো সে জেন-ওয়াই, তাই মদ্যপানে তার কোনও আইনি বাধা নেই। “ক্রিসমাসে বো ব্যারাক খুব সুন্দর করে সাজায়। গানবাজনা হয়। তবে ওখানকার সবচেয়ে বড় টান হোম মেড জিঞ্জার ওয়াইন!” হেসে ফেলল অর্ক। তার পরেই সোজা সে ঠেক জপাবে সামপ্লেস এলস্-এ। অন্যান্য দিন পিচার বিয়ারে তেষ্টা মিটলেও ক্রিসমাসের জন্য তার রয়েছে অন্য ফান্ডা। বলল, “ক্রিসমাসে টি ফর টার্কি নো মোর, জাস্ট টি ফর টাকিলা।”
তবে অর্ক ক্রিসমাস সেলিব্রেশনে জমাটি ভিড়ের মধ্যে থাকতে পছন্দ করলেও জেন-ওয়াই এখন প্রাইভেট পার্টিই বেশি পছন্দ করছে। “আমাদের ৪ বন্ধুর একটা গ্রুপ আছে। প্রত্যেকেই মেয়ে। সো, বুঝতেই পারছো, বেশি ক্ষণ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ক্রিসমাস সেলিব্রেট করবার অনুমতি আমরা পাই না।” একটু কি দুঃখ ঝরে পড়ল রানি বিড়লার সাক্ষী মেহতার গলায়? “একেবারেই না। ভিড় ঠেলার চেয়ে আমরা নিকিতার বাড়িতে বসে আড্ডা দেব। নিজেদের কিটি ক্রিসমাস পার্টি। কোনও ছেলে থাকবে না। শুধু ওদের নিয়ে হাসিঠাট্টা হবে। আর নিজেদের মধ্যে একটু-আধটু লেগ পুলিং। একটা রেড ওয়াইন তুলেছি, সেটাই খাব। টার্কি না হলেও চলবে। পিৎজ্জা তো আছে!” মিষ্টি হাসি লেগে রয়েছে সাক্ষীর মুখে।
সবাই অবশ্য এত ছিমছাম প্রাইভেট পার্টিতে বিশ্বাসী নয়। প্রেসিডেন্সি কলেজের অর্চিষ্মান মিত্র যেমন। “আরে, আজকের দিনটা আলাদা! সেটা ফিল করার জন্যই তো এই পার্টি। তা ছাড়া, প্রচুর বিয়ার আর ওয়াইন স্টক করা হয়েছে। একটু বন-ফায়ার করতে পারলেও বেশ হত, কিন্তু ছাদটা পাওয়া যাবে না। তবে টার্কি দিয়ে পুষিয়ে দেব।” হেসে বললেন অর্চিষ্মান। সঙ্গে জুড়লেন, “ক্রিসমাসে বাবা-মা বাড়িতে থাকছে না। ফ্ল্যাটটা ফাঁকাই পাচ্ছি। চুটিয়ে সেটার সুযোগ নেব। ঠিক করেছি, প্রপ্স পার্টি করব। টিপিক্যাল ক্রিসমাস থিমে সাজতে হবে সবাইকে। লাল টুপি, ডেভিলস হর্ন অথবা হরিণের শিং না পরলেই নয়। লাল রং পরতেই হবে!”
কিন্তু কেন লাল রং?
ফ্যাশন ডিজাইনার অভিষেক দত্ত বলছেন, “পার্টি-অনুষ্ঠান মানেই প্রাথমিক পর্যায়ের নির্বাচনে আসবে পোশাক। আপনি কী পরবেন, আর কেন পরবেন, এই থিয়োরি পরিষ্কার থাকলেই আপনার সেলিব্রেশন প্ল্যানিং-এর অর্ধেক আকাশ দখল হয়ে গেল। অফিসের সরু কাজল-গ্রে প্যান্ট-ব্লেজারের চেনা খোলসটা ছেড়ে এক্কেবারে ঘুমভাঙা নতুন ভোরের মতো তাক লাগানো রং মানেই গাঢ় লাল। জবুথবু ঠান্ডায় মির্চি লালের আপাদমস্তক কম্বিনেশন ঘামঝরানো পার্টি উপহার দেবে আপনাকে।”
উষ্ণ আহ্বানে আপনার লাল উপস্থিতিই হোক এ বারের ক্রিসমাস ফ্যাশন, হুইস্কির চুমুকে দূর ছাই করতে আপনার রেড ওয়াইন ঠোঁট হাল্কা খুলুক। দেখুন কেমন আগুন গরমে কেঁপে উঠবে আপনার চার পাশ। সান্তাবুড়োর লাল টুপির ছেলেবেলা আর হাইচিনে লালের হাল্কা আভার ছোঁয়া কুর্নিশ করবে এ বারের লাল ফ্যাশনকে। বসন্ত নেই, তবু ক্রিসমাস ট্রি-র লাল চেরি, কামনা হয়ে ফলে আছে যে!
অবশ্য লাল রঙ নিয়ে ছেলেদের খানিক খুঁতখুঁতানি থাকে, বলছেন অভিষেক। তাই একেবারে লালবাবু না হলেও চলবে। কালো বা ডিপ অ্যাশ ব্লেজারের নীচে লাল স্কিভি চোখ টানবে। একটু ঝিংকু হতে চাইলে থ্রি-কোয়ার্টারের হিম-সমস্যা মাথায় রেখে ড্রাগন ছাপ লাল হুডার গলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। হাতে লাল-কমলা বিডসের গয়না মাস্ট। অফিশিয়াল পার্টিতে ঘন লাল টাই বা স্যুটের পকেটে লাল গোলাপ একদম হটকে। তবে, শেষ কথা বলবে আপনার ব্যক্তিত্বের টাচআপ। ক্রিসমাস রাত কাঁপাতে একদম তৈরিই যখন, তখন খানিক দুষ্টু-মিষ্টি হতে ক্ষতি কি? মাথায় থাকুক না একটা লাল সান্তাটুপি!
সময়টা থিমের। যে দিকে চোখ রাখবেন, কোনও না কোনও থিমের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। আশ্বিনের পুজোর মতো এ পুজোরও তো হুজুগ কম নয়। সান্তা, চেরি ট্রি সব কিছুর পরেও এ বারের ক্রিসমাসের নিজস্ব থিম হোক লাল। সারা বছর যারা পার্টি-সার্টি পান না, বছরে এই একটা দিনই সুযোগ! অথচ শীতের চোটে সাজতে পারছেন না বলে ক্ষেপে আছেন। তাঁদের জন্য বলা যাক, সাজ পোশাক নির্ভর নয়, হোক রং এবং শেড নির্ভর। আর সেই শেডের রং কিন্তু লাল।
ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পল বলছেন, “হাঁটু অবধি লম্বা স্কিন রঙের স্টকিং পরলে পায়ে ঠান্ডার ভয় খতম। ব্যস, নি-লেনথ ড্রেস বা গাউন পরতে আর বাধা নেই। একটা মেটে বা তামা লাল নি-লেনথ ড্রেস পরলে আর কিছু দরকার পড়বে না। পায়ের জন্য যে হাই-হিল গোল্ডেন স্টিলেটোটা বেছেছেন, তাতে লালের একটা টিন্ট পার্টির সব রং কেড়ে নেবে।” কাজল ছাড়া অন্য মেকআপে অনিচ্ছুক থাকলে ঠোঁট ন্যুডই থাকুক। খোলা চুলে টেম্পোরারি লালের একটা পোচ স্ট্রিক করে লাগিয়ে ছেড়ে দিন। স্প্রিং-ও করে নিতে পারেন।
এ বছরের ক্রিসমাস তা হলে বড়দিনেরও!আমিরেরও যেমন, তেমন যিশুরও। আবার টাকিলারও। লালের লহমার এই মুহূর্তকে তরল পানীয় আর বেকারির কম্বোতে জেন-ওয়াই তাকে নিজেদের ছাঁচে ফেলে উল্লাসে মাতোয়ারা!
চিয়ার্স, যিশু!