হ্যালো 80’s

মেয়েদের টয়লেটের কথা বলতে পারব না, কিন্তু যে কোনও অফিসে পুরুষদের ওই জায়গাটি প্রয়োজনীয় কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে অনুপস্থিত ব্যক্তির সমালোচনা, আদ্যশ্রাদ্ধ ইত্যাদি ব্যাপক ভাবে করার জন্যে নির্দিষ্ট। আবার সেখানে ভাজা মাছ উলটে খেতে অপারগ, এমন মুখ নিয়ে গুপ্তচরও দাঁড়িয়ে থাকে— সেগুলো ঠিক কানে তোলার জন্যে।

Advertisement

বিকাশ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

আশির দশকের কম্পিউটার।অ্যাদ্দিনকার কলম-পেষা আপিসবাবুরা যার সঙ্গে মানিয়ে নিতে কিঞ্চিৎ খাবি খাচ্ছিলেন

মেয়েদের টয়লেটের কথা বলতে পারব না, কিন্তু যে কোনও অফিসে পুরুষদের ওই জায়গাটি প্রয়োজনীয় কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে অনুপস্থিত ব্যক্তির সমালোচনা, আদ্যশ্রাদ্ধ ইত্যাদি ব্যাপক ভাবে করার জন্যে নির্দিষ্ট। আবার সেখানে ভাজা মাছ উলটে খেতে অপারগ, এমন মুখ নিয়ে গুপ্তচরও দাঁড়িয়ে থাকে— সেগুলো ঠিক কানে তোলার জন্যে।

Advertisement

সেই চরের মুখেই খবর এল, ‘দাদার কাছে ওই খোচড় দুজন জানতে চাইছিল, তোমাদের শ্রেণিশত্রু বলা হবে কি না।’ দাদা হল ইউনিয়নের বড় নেতা, আর খোচড়: দাদার চর ও চামচা।

‘দাদা কী বললেন? কোনও রেফারেন্স? লেনিন কিংবা ট্রটস্কি?’ দাদার অভ্যাসের কথা ভেবে জিজ্ঞেস করি। ‘না না। উনি বললেন, এ ভাবে ব্র্যান্ডেড করা যাবে না। শোধনবাদী ভাবসাব। দেখি ওদের সঙ্গে কথা বলে’, চর জানায়।

Advertisement

‘ওদের’ বলতে আমি আর আমার সহকর্মী বন্ধু দীপক। পরে আমরা শোধনবাদী হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিলাম। কেন হয়েছিলাম, তার পুরো বৃত্তান্ত বলার আগে দুটো পটভূমিকার কথা বলে নিতে হবে।

সেটা আশির দশক। ব্যাংক, বিমা সহ অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় তখন ‘শ্রমিক’ শ্রেণির নিরবচ্ছিন্ন রাজত্ব। আর আমরা ছিলাম পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইউনিয়নে। আমরা তখন ব্যাংকের পাঁড় কেরানি, অফিসার হওয়ার তেমন চেষ্টা করি না, কেননা আমাদের মতে সেটা কর্তাভজার কাজ।

১৯৮৫ সালের গোড়ায় হঠাৎ শোনা গেল, হংকং সাংহাই ব্যাংকে (এখনকার এইচএসবিসি) কম্পিউটার ঢোকানো হবে। তাতে নাকি প্রচুুর ছাঁটাই হবে। কম্পিউটার খায় না মাথায় দেয়, তখন প্রায় কেউই জানত না। কিন্তু ইউনিয়ন নেতারা ইস্যু পেয়ে গেলেন। তাঁরা নানান ব্রাঞ্চে ব্রাঞ্চে ঘুরে এর বিরুদ্ধে বলতে লাগলেন। বিকেলে মিটিং-র্যালি, দুপুরে টিফিন টাইমে ম্যানেজারের চেম্বারের সামনে ‘আমাদের আন্দোলন চলছে চলবে’...

জানা গেল, এ সবই আমেরিকার ছক। ভারতে কোটি কোটি নতুন বেকার তৈরি করতে সিআইএ’কে দায়িত্ব দিয়েছে। বিল গেট্স নাকি রোনাল্ড রেগানকে দিয়ে কলকাঠি নাড়িয়েছে। রেগান আর রাজীব গাঁধী হলায়-গলায়। অতএব, ফরসা আমেরিকানদের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। অন্যান্য সময় গলার শির ফুলিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান আমরাও জানাতাম। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিরোধী হলাম। কেননা লেনিন মার্কস তেমন না পড়লেও, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বইয়ের দোকানে পয়সা দিয়ে কিছু উলটো-পালটা ফোটোওয়ালা ইংরেজি ম্যাগাজিনের সঙ্গে আমরা ‘টাইম’ ম্যাগাজিনটাও পড়তাম। সেখানেই দেখেছিলাম, কম্পিউটার নতুন দিগন্ত খুলে দেবে, নতুন নতুন চাকরি হবে।

আর এ দিকে তখন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের নেতাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ব্যাংক থেকে ‘ভলেনটিয়ার’ দেওয়ার জন্য। হংকং সাংহাই ব্যাংকের সামনে চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দিতে হবে, বার বার লোক বদল করতে হবে, তাই প্রচুর লোকের দরকার। সামনাসামনি আমাদের কেউ কিছু না বললেও, চরের মুখে খবর পেলাম, আমরা যদি পাহারা দিতে না যাই, আন্দোলন মিটে যাওয়ার পর আমাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চর নিজে ওই দিন দলে ভিড়ে গেল। আমরা কিন্তু মিনমিন করে হলেও কম্পিউটারের সুফল সম্পর্কে যতটুকু জানা ছিল, ‘বিশেষ জরুরি সভা’র পর সেখানে দাঁড়িয়েই দু’চার জনকে বললাম। মিটিংয়ে কোনও কারণে আমাদের মতামত চাওয়া হয়নি। ওই বলার জন্যেই স্থায়ী শোধনবাদী তকমা পেয়ে গেলাম। দাদার বশংবদ এক জন বললেন, ‘শোধনবাদ অগো খাইয়া ফ্যালাইসে।’

খুব অসুখী মন আর থমথমে মুখ নিয়ে অফিসে আসতাম। অফিস থেকে বেরিয়ে দুজনে কার্জন পার্কে বসে আলোচনা করতাম, আমরা ঠিক করেছি কি না। অপেক্ষাকৃত ছোট ইউনিয়ন থেকে যোগ দেওয়ার ডাক থাকলেও আমরা কিন্তু ইউনিয়ন ছাড়িনি। তাড়ালে চলে যাব, এই মনোভাব নিয়ে বসেছিলাম। অবশ্য তাড়ানো হয়নি।

শুরু হয়ে গেল পাহারা দেওয়া। দূর থেকে খবর পাচ্ছি। কেউ কেউ গায়ে পড়ে শুনিয়েও যাচ্ছে। দিনরাত ব্যারিকেড, শিফ্টে শিফ্টে কমরেড বদল। এলাহি ব্যাপার। অনেক ব্যাংকের শাখায় আবার চলতে থাকল ‘ওয়াইল্ড ক্যাট স্ট্রাইক’। হঠাৎ হঠাৎ এক দিন ব্রাঞ্চ খোলার আগে ইউনিয়নের মাঝারি মাপের নেতারা এসে বলতেন, আজ ব্রাঞ্চে কোনও কাজকর্ম হবে না। গ্রাহকদের হয়রানি তো হতই, আর সমস্ত কর্মচারীরা যে সমর্থন করতেন এমনও নয়, কারণ মাইনে কাটা যেত। কিন্তু ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারতেন না।

১৯৮৫-র ৩০ মে থেকে অক্টোবরের ১৯ তারিখ অবধি লাগাতার ‘কম্পিউটার ঢুকতে দিচ্ছি না, দেব না’ চলল। তখন এক দূরদর্শী মানুষ ট্রেড ইউনিয়নের বেড়াজাল এড়িয়ে ব্যাপারটায় হস্তক্ষেপ করলেন। তিনি হলেন জ্যোতি বসু। আন্দোলন উঠে গেল। কিন্তু রেশ কাটল না। সারা ভারতের বড় বড় শহরে কম্পিউটার চালু হতে থাকলেও, আমরা পিছিয়ে গেলাম।

অথচ পরে পড়াশোনা করে দেখেছি, আশির দশকের গোড়া থেকে পৃথিবী কেমন প্রযুক্তিতে ভর করে এগিয়ে যাচ্ছিল। ’৮০-র জানুয়ারিতে হিউলেট প্যাকার্ড বাজারে ছেড়েছিল পার্সোনাল কম্পিউটার এইচ পি ৮৫। আইবিএম পল অ্যালান ও বিল গেট্সকে নতুন পি সি তৈরির জন্যে ভাড়া করেছিল। ’৮৩-র শেষাশেষি মাইক্রোসফ্ট উইন্ডোজ এসে গিয়েছিল, আর তার ক’দিন পর টাইম ম্যাগাজিন ‘পি সি’কে ‘মেশিন অব দি ইয়ার’ তকমা দিয়েছিল। এ-ও জানিয়েছিল, এই প্রথম কোনও যন্ত্রকে এই সম্মান দেওয়া হল। শুধু এগোনো নয়, দুদ্দাড়িয়ে এগোনো, অথচ আমরা পিছন ফিরে রইলাম। যা হোক, ওই সময় থেকেই আমাদের দুজনের ‘ঝাঁক’ থেকে আলাদা হওয়ার শুরু। পরের দু’তিন বছরে আমরা অফিসার হয়ে গেলাম।

দশ বছর পরের কথা। আমাদের এখানে তখন একটু একটু করে কম্পিউটার ঢুকছে। এক দিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক নামী নেতা আমাকে ডেকে বললেন, ‘হেড অফিসের স্টাফ ট্রেনিং কলেজে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য ম্যানেজমেন্ট কলকাতা থেকে ক’জনকে বম্বে পাঠাচ্ছে। তার প্রথম ব্যাচের তিন জনের তুমি এক জন। কী হে শোধনবাদী, খুশি তো?’

mallikabikash@yahoo.co.in

আশির দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?

লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 80s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement