কুঁ মায়ু হিমালয়ের মেয়ে নন্দা যাবেন বরের কাছে। রাগ করে বর পাগলা মহেশ্বর বসে আছেন নন্দাদেবী পর্বতে, তাঁর রাগ ভাঙিয়ে তাকে মৃণালভুজে জড়িয়ে ধরতে নন্দাকেও যে যেতে হবে সেখানে। কিন্তু কে পৌঁছে দেবে তাঁকে, ঘরে তো খালি বুড়ো বাপ। শেষে নন্দা ভাই পাতালেন কনৌজের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে লাটুকে। লাটু তার পাতানো দিদিকে পৌঁছে দেবে। এর মধ্যে হল কী, সহজ-সরল লাটুকে কেউ ভুলিয়েভালিয়ে মদ খাইয়ে দিল। লাটু তো মদের নেশায় যাচ্ছেতাই সব কাণ্ড করে বেড়াতে লাগল। সবার সামনে দিদির লজ্জায় মাথা কাটা যায়। শেষে নন্দা লাটুকে ঘরে তালা বন্ধ করে রাখলেন, আর আদেশ দিলেন, কেউ যেন খুলে না দেয়। নেশা কাটলে লাটু দিদির কাছে খুব কান্নাকাটি করল। দিদির মন একটু ভিজলে, তিনি বছরে শুধু এক বার, বৈশাখ মাসে, লাটুর দরজা খোলার অনুমতি দিলেন। যদিও দিদির বরে লাটু দেবত্ব লাভ করেন, কিন্তু ওয়ান গ্রামে তিনি সেই থেকে বন্দি। আর সেই থেকে লাটু দেবতা আমাদের ওয়ান গ্রামের কুলদেবতা।’—রঘুবীর সিংহ বিস্ত গানে আর গল্পে নন্দাদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করছিল, আর আমরা গোল হয়ে বসে শুনছিলাম লাটপোখরির জঙ্গলে আগুন পোহাতে পোহাতে।
উত্তরাখণ্ডের এক ছোট্ট গ্রাম ওয়ান। হৃষিকেশ থেকে দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ, দেবল, সব ছাড়িয়ে লোহাজং। সেই যেখানে লোহাসুরের সঙ্গে দেবী দুর্গার জং বা যুদ্ধ হয়েছিল, সেই লোহাজং ছাড়িয়ে আরও ১৫ কিমি দূরে ওয়ান। ওয়ানেই লাটু দেবতার বাস, এখানকার তিনিই কুলদেবতা আর ওয়ানবাসীই তাঁর স্বজন। আজও বারো বছর অন্তর নন্দাদেবী কর্ণপ্রয়াগের নৌটা থেকে পতিগৃহে যাত্রা করেন। এই যাত্রার নাম নন্দাদেবী রাজ-রাজেশ্বরী যাত্রা বা ‘নন্দাযাত’। বারো বছর অন্তর দুর্গম পথের এই দীর্ঘ ও দুরূহ যাত্রায় শামিল হন উত্তরাখণ্ডের হাজার-হাজার পাহাড়ি মানুষ। লাটু দেবতা আর নন্দাদেবীর পালকি বা ডোলি ওয়ানের লোকেরাই বয়ে নিয়ে যান হোমকুণ্ড পর্যন্ত। চিরকাল চলে এসেছে এই নিয়ম, অন্তত ২০০২ পর্যন্ত। গোল বাধল ২০১৪-তে এসে। ওয়ানের লোক তো মহানন্দে ডোলি নিয়ে চলেছে। যেই পাথরনাচনিতে ডোলি পৌঁছেছে, সুতোল বলে অন্য একটি গ্রামের লোক দাবি করতে লাগল, এখান থেকে সুতোল গ্রাম-পঞ্চায়েত শুরু, তাই এখান থেকে সুতোলের লোকই হোমকুণ্ড পর্যন্ত ডোলি বইবে। ওয়ানের লোকই বা এত দিনের বাপ-পিতেমোর করা নিয়ম ভাঙবে কেন, তাই প্রথমে বচসা, তা থেকে শেষে মারামারি। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে কোনও রকমে পুরনো নিয়মই বহাল থাকে। কিন্তু সুতোলের লোকেদের সেই থেকে ওয়ানের লোকেদের ওপর খুব রাগ, সুতোলের ধারে-কাছে ওয়ানের কাউকে দেখলেই আজকাল ওরা মারধর করে।
নন্দাযাত শেষ হবার ঠিক এক মাস পর আমরা ওই পথেই রূপকুণ্ড, হোমকুণ্ড হয়ে লাটপোখরির জঙ্গলে নেমে এসেছি। এ পথে রহস্যময় রূপকুণ্ড, ত্রিশূল-নন্দাঘুণ্টি শৃঙ্গ, পৌরাণিক-লৌকিক দেবতার নানা গল্পের আকর্ষণ তো ছিলই, তা ছাড়া আরও দুটো আকর্ষণ ছিল। এক, হিমালয়ের নীল ভেড়া বা ভাড়াল। দুই, নন্দাযাতের সময় নন্দাদেবীর উদ্দেশে একটি চারশিঙা ভেড়া উৎসর্গ করে হোমকুণ্ডে ছেড়ে আসা হয়, সেটিকে নাকি আর পরে কোনও দিন দেখা যায় না। এমনকী তার হাড়গোড়েরও চিহ্ন পাওয়া যায় না কখনও। সেই ভেড়াটার দেখা পাওয়ারও ইচ্ছে ছিল। নীল ভেড়া ও চারশিঙা ভেড়া দুয়েরই দেখা মিলেছে পথে। নীল ভেড়ারা শুকনো লালচে ঘাসে কী যেন খুঁজে খুঁজে খেয়ে চলেছে আর চারশিঙা ভেড়াটি আরও তিনটি উৎসর্গীকৃত ভেড়ার সর্দার হয়ে একটু নুনের খোঁজে হন্যে হয়ে পাথর চেটে বেড়াচ্ছে। অলৌকিক এই ভেড়াটি ক’দিনে ভীষণই জৈবিক হয়ে উঠেছে।
কাল সুতোল পৌঁছব। সুতোল এখান থেকে ৬ কিমি দূরে। গাইড-পোর্টার হিসেবে সঙ্গে আছে ওয়ান গ্রামের দেব সিংহ, রঘুবীর সিংহ, ত্রিলোক সিংহ আর হীরা সিংহ। আর আছে তিন জন নেপালের মানুষ— কালী, পদম আর মন্নত বাহাদুর। এখন সমস্যা হল, ওয়ানের লোকেরা সুতোলে ঢুকলে ওদের ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবে, বলেছে সুতোলের দাদারা। তাই ওরা আমাদের কিছুটা পথ এগিয়ে দিয়ে অন্য পথে চলে যাবে ওয়ানে, আর নেপালিরা আমাদের সুতোল নিয়ে যাবে। কিন্তু নেপালিরা তাই শুনে এক আনা গঢ়বালি, এক আনা হিন্দি আর চোদ্দ আনা নেপালিতে উত্তেজিত হয়ে যা বলল, তার বাংলা মানে দাঁড়ায়— ওরা রাস্তা চেনে না। তাই রাস্তা চেনে এ রকম এক জনকে সঙ্গে থাকতেই হবে। আবার চার ওয়ানি এক কোনায় জড়ো হয়ে গঢ়বালিতে মিটিং করল কিছু ক্ষণ। বোধহয় নিঃশেষে প্রাণ কে করিবে দান, ঠিক করতে। শেষে স্থির হল, কপালের নাম গোপাল ধরে সবাই এক সঙ্গেই যাবে। মার খাওয়ার উপক্রম হলে, ‘য পলায়তি, স জীবতি!’
ওয়ান আর সুতোল বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ গ্রাম। ওয়ানের অনেকেরই দিদির বাড়ি, পিসির বাড়ি, মামার বাড়ি, মাসির বাড়ি সুতোল। সেই তাদের মধ্যে শুধু এক দেবীর পালকি তোলা নিয়ে এত ঝগড়া, ব্যাপারটা আমার ‘হাইলি সাসপিশাস’ মনে হল। মার্ক্স সাহেবের ফর্মুলা অনুযায়ী তাই গাদা খানেক ছাই উড়িয়ে অর্থনীতির পরশপাথরটি খোঁজার চেষ্টা করলাম। রঘুকে বললাম, দেবীর নিজের তৈরি করা নিয়ম ভাঙতে সুতোল এত সাহস পায় কীসে?
ত্রিলোক সিংহ এত ক্ষণ বসে বসে বিড়ি টানছিল, বিড়িটা ফেলে বলল, হবে না? পয়সা, পয়সা! খুব পয়সা হয়েছে তো ওদের, তাই ওরা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে।
ভগ্নীপতি বললে শত, সম্বন্ধী বলবে হাজার গুণ। ত্রিলোকের শালা দেবু আরও উত্তেজিত, বলল, সুতোলের যে কোনও লোকের বাড়িতে যাও, কমসে কম কোটি টাকা পাওয়া যাবে (যদিও দেবু কোটি হতে ক’টা শূন্য লাগে জানে না বলেই আমার ধারণা)। কাল তো সুতোল যাবে, দেখবে মনে হবে দিল্লি-মুম্বইয়ে চলে এসেছ (কলকাতা কী দোষ করল কে জানে)! কীড়া-জড়ি বেচে বেচে ওরা একেবারে লাল হয়ে গেছে।
আছে, আছে! আমার মার্ক্সীয় টেলিপ্যাথির জোর আছে! কীড়া-জড়ি ও তার অর্থনীতিই জড়িয়ে আছে এই দুই গ্রামের বিবাদে। দেবীর পালকি নিয়ে বিবাদ তার একটা উপসর্গ মাত্র। গুটিপোকার (কীড়া) মৃতদেহে গজিয়ে ওঠা এক বিশেষ ধরনের ছত্রাক (জড়ি) গত কয়েক বছর ধরে উত্তরাখণ্ডের সীমানাবর্তী পাহাড়ি গ্রামগুলির অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। এর চিনা নাম ‘দং চেঙে জিয়া কাও’, যার অর্থ ‘শীতে পোকা, গ্রীষ্মে ঘাস’। যে সব গুটিপোকা মাটির একটু নীচে বসে গাছের শিকড় খায় কুটুর-কুটুর করে, তাদেরকে এই ছত্রাক আক্রমণ করে। পোকার শরীর থেকে রস শুষে শুষে তাকে মমি বানিয়ে ফেলে। বসন্তে সেই মমি হয়ে যাওয়া মৃত পোকার মাথা ফুঁড়ে মাটির ওপর বেরিয়ে আসে সেই ছত্রাক বা কীড়া-জড়ি।
কীড়া-জড়ি মানে খালি ছত্রাকটাই নয়, সঙ্গে মরা পোকাটাও। তিব্বত, চিন ও নেপালের কয়েকটি জায়গায় ও ভারতের উত্তরাখণ্ডে হিমালয়ের দশ-বারো হাজার ফুট উচ্চতা থেকে পাওয়া যায় এই ছত্রাক। যেখানে গাছপালা নেই, যাতে ছোট্ট ছোট্ট ঘাস ছাড়া আর কিছু হয় না, সে সব মারাত্মক খাড়াই নেড়া-নেড়া পাহাড়ে মে-জুন এই দেড়-দু’মাস কীড়া-জড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছে উত্তরাখণ্ডের হাজার হাজার মানুষ, গত কয়েক বছর ধরে। এদের সঙ্গে না থাকে পাহাড়ে চড়ার সাজ-সরঞ্জাম, না থাকে তাঁবু। খালি সামান্য রসদ আর পাহাড়ে চড়ার জন্মগত দক্ষতা সম্বল করে অসহ্য কষ্ট করে পাগলের মতো তারা খুঁজে চলে এই ‘নরম সোনা’। কারণ? কীড়া-জড়ির আন্তর্জাতিক বাজার-দর ছিল কেজি প্রতি লাখ কুড়ি, সেই ২০০৬ সালেই।
কীড়া-জড়ির পুরো বাজারই চিনের দখলে। সাতশো বছর ধরে চিনে ওষুধ হিসেবে কীড়া-জড়ির ব্যবহার। এর গুণ বর্ণন করতে গেলে মুখে ফেনা উঠে যাবে। প্রথমত এর আর এক নাম হিমালয়ান ভায়াগ্রা। এ ছাড়া সুগার কমায়, প্রেশার কমায়, হার্টের রোগ, লিভারে দোষ, কিডনিতে পাথর দূর করে। প্রদাহ কমায়, হরমোনের সমস্যা সারায়, স্মৃতিশক্তি-দৃষ্টিশক্তি-রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, এমনকী দাঁত পর্যন্ত ঝকঝকে করে। আজকাল নাকি ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও উপকার পাওয়া যাচ্ছে। যদিও সত্যিই কী করে খোদায় মালুম।
হাসিখুশি বছর চব্বিশের হীরা সিংহ এই ক’দিন আমাদের রাঁধুনি ছিল। হীরা দেহরাদূনে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করছে, সঙ্গে কাজ করে দেহরাদূনের একটি মার্কিনি ভাজা মুরগির দোকানে। সেও ছুটি নিয়ে চলে আসে কীড়া-জড়ি খুঁজতে। হীরাকে জিজ্ঞেস করি, এ বছর (২০১৪) কত উঠেছিল দর? বলল, স্থানীয় দর ছিল ন’লাখ, সেটা হাত ঘুরে চিনে পৌঁছেছিল বত্রিশ লাখে। মানে সোনার চেয়েও বেশি দামে। এই জন্যই এই নরম সোনার সঙ্গে ঘোরে মৃত্যু, প্রতারণা, বিদ্বেষ। কীড়া-জড়ি খুঁজতে গিয়ে পাহাড় থেকে পড়ে এ বারই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে হীরার এক বন্ধু। ২০১৩ সালে চামোলির বংশীনারায়ণে মারা গেছিল এক সঙ্গে আট জন, এই কীড়া-জড়ি খুঁজতে গিয়েই। বেমনি গ্রামে এক জন এসে বলেছিল, সে ভাল দর দেবে। সবাই তার কাছে ওজন মেপে কীড়া-জড়ি জমা করে দিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে সে সব কীড়া-জড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়, আর কেউ কোনও দিন তাকে খুঁজে পায়নি। যদিও এই নরম সোনা সংগ্রহ বেআইনি নয়, কিন্তু এর বিক্রি পুরোপুরিই হয় চোরাবাজারের মাধ্যমে। পাহাড়িদের থেকে কিনে কয়েক বার হাত ঘুরে দিল্লি বা নেপাল হয়ে পৌঁছে যায় চিনে। চিনে ১৯৯৯ সাল থেকেই এই কীট-ছত্রাক বিপন্ন তালিকাভুক্ত। আমাদের সরকার বাহাদুর এখনও তার কর্তব্য স্থির করতে পারেননি। বা এর মাধ্যমে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, স্থানীয় মানুষের জীবিকার সংস্থান হচ্ছে, তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে— এই ভেবে হয়তো চোখটি বুজে আছেন। যেমনটি বুজে থাকেন, পাহাড়ের আর একটি সত্যিই বেআইনি ব্যবসা গাঁজাপাতা হাতের তালুতে ঘষে-ঘষে গুলি পাকিয়ে চরস হিসেবে বিদেশে পাচার করার ক্ষেত্রে।
তবে কিলো কিলো দূরের কথা, কয়েকশো গ্রাম কীড়া-জড়ি পাওয়াও চাট্টিখানি কথা নয়, কারণ জায়গা সীমিত, লোক প্রচুর। ভাগাভাগি নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াই শুধু নয়, এই জায়গার সীমানা নিয়ে গ্রামে-গ্রামে ভীষণ দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়। যেমন সুতোলের সঙ্গে ওয়ানের হয়েছে। সুতোল গ্রাম-পঞ্চায়েতের অনেকটা অংশ কীড়া-জড়ির একেবারে খাস-জায়গা। সেখানে ওয়ানের সীমানায় উঁচু নেড়া পাহাড় কম থাকায় কীড়া-জড়ি একটু কম গজায়। লোভে পড়ে ওয়ানের লোক নিজেদের সীমানা ছাড়িয়ে সুতোলের এলাকায় কীড়া-জড়ি তুলতে ঢুকলেই মারপিট। এই হল ঝগড়ার আসল কারণ।
যাই হোক, পর দিন বিকেলে ভয়ে ভয়ে সুতোলে তো ঢুকলাম। এদের ঝগড়ায় আমাদের বাঙালি উলুখাগড়ার প্রাণটা না গেলেই হয়। এর মধ্যে পথে শুনলাম, আমাদের বাংলারই পঞ্চাশ বছরের পুরনো একটি প্রতিষ্ঠিত মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবের সদস্যরা হোমকুণ্ড থেকে ফেরার পথে সেই চারটি ভেড়ার একটিকে ধরে এনেছিল মহাভোজের জন্য। দুর্ভাগ্যক্রমে সেটি সুতোলবাসীরই নন্দাদেবীকে উৎসর্গীকৃত। ফলে তাদের তো সুতোলের লোকেরা প্রায় এই মারে তো সেই মারে, পরে তারা বারো হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে মুক্তি পায়। শুনে তো আরও ভয় হল! বাঙালি জাতভাইদেরও পেয়ে আমাদেরও জরিমানা করবে নাকি!
সুতোলের রাস্তা সম্পূর্ণ কংক্রিটে বাঁধানো, বেশির ভাগ বাড়িও তাই। পাহাড়ের প্রথাগত পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে সেই সুন্দর সুন্দর ছোট্ট ছোট্ট বাড়িগুলো নয়। এই পাহাড়ে সিমেন্ট, স্টোন চিপ্স, লোহার রড সবই কিন্তু ভীষণ দুর্লভ, সুতরাং দুর্মূল্য— তবুও। বেশ কয়েকটি নতুন আধুনিক মডেলের গাড়িও দেখলাম বাড়ির বাইরে রাখা। মোটরসাইকেলও দেখলাম অনেকগুলো। রাস্তায় বিজলি বাতিও জ্বলছে। দেবুর দিল্লি-মুম্বই হয়তো বাড়াবাড়ি, কিন্তু কীড়া-জড়ির কল্যাণে নগরায়নের প্রচেষ্টা সর্বত্র বিদ্যমান। এর মধ্যে এক মহিলা টুংটুং করে গরু-মোষের লম্বা পাল নিয়ে ঢুকছেন। ওঁর বারো-তেরো বছরের ছেলেও লাঠি হাতে অত বড় বড় গরু-মোষগুলোকে মুখে ‘টড়াক-টড়াক’ আওয়াজ করতে করতে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের দিকে গম্ভীর ভাবে তাকাতে তাকাতে। তাড়াতাড়ি পথ ছেড়ে দাঁড়ালাম। পেছনে দেখি একটা ঝোপও এগিয়ে আসছে। সামনে এলে বুঝলাম ওই মহিলারই মেয়ে ঘাস-জঙ্গল কেটে নিয়ে আসছে। কিন্তু সে এতই ছোট যে বোঝার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে।
আগে তো সুতোলে দিব্যি ঘর-টর পাওয়া যেত, এ বার আর কিছুতেই পাই না। শেষে একটি সদ্য তৈরি বাড়িতে ঠাঁই হল। নতুন তক্তপোশ পাতা, কিন্তু তার ওপর বোধহয় একশো বছরের পুরনো দুর্গন্ধযুক্ত তোশক এবং কম্বল। ঘরের ভাড়া নাকি দু’হাজার। বললাম, এই ঘর দু’হাজার? মালিক কটমট করে তাকিয়ে বললেন, ‘এই ঘর’ মানে! জানেন এই বাড়ি তৈরি করতে আমার কুড়ি লাখ টাকা খরচা হয়েছে? ওঁর আবার গাড়ির সার্ভিসও আছে, যাতে করে উনি লোকজনকে ঘাটে (বার্নিং ঘাট নয়, নিকটবর্তী শহর) পৌঁছে দেন। সেই সার্ভিসটিও আমরা নেব। আমাদের এই ক’দিনের পাহাড়ি সঙ্গীদের জন্য ভেড়া সহযোগে যে মহাভোজ বা বড়াখানার আয়োজন করা হবে, তার যাবতীয় মাল-মশলাই তাঁর দোকান থেকেই কেনা হবে— এই দুটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে তিনি ক্ষমাঘেন্না করে একটু রেট কমালেন।
সে দিন একটু রাত হয়ে যাওয়ায় দেবু-রঘুদের ঠ্যাং-ট্যাং কেউ খোঁড়া করতে আসেনি। মহাভোজও সুসম্পন্ন। কিন্তু পর দিন সকালে দেবু-হীরা-রঘু কারও পাত্তা নেই। তিন নেপালিও কিছু বলতে পারে না। তবে কি সুতোলের লোক সত্যিই ওয়ানের চার জনকে বেঁধে রাখল? অনেক বেলায় যখন তারা সহাস্যে ফিরল, জানা গেল আপন আপন সুতোলের আত্মীয়দের নিয়ে সৌভ্রাতৃত্বের বার্তা দিতে তারা সুতোল পরিক্রমায় বেরিয়েছিল এবং সে লক্ষ্য আপাতত সফল। মনে মনে বললাম, পরের কীড়া-জড়ির মরশুম পর্যন্ত এ সাফল্য ধরে রাখতে পারলেই হয়।
এ দিকে আমাদের বাড়িওয়ালার ১১-১২ বছরের ছেলেটি সকাল থেকেই ঘুরঘুর করছে, মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়। অন্য পাহাড়ি ছেলে হলে হয়তো লজেন্সটা-টফিটা দিতাম, কিন্তু এ তো রীতিমত বড়লোকের ছেলে, তাই যেচে কিছু দিতে সাহস হচ্ছে না। কিছু ক্ষণ বাদে ওর মা এসে বললেন, ছেলেটির কানে খুব ঘা হয়েছে, হাতেও পাঁচড়া ভর্তি, জ্বরও হয়। আশেপাশে ডাগদার-স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিছুই নেই। আমাদের কাছে যদি কিছু বঙ্গালি দাওয়া থাকে। কারণ বাঙালিরা মানেই ডাগদার আর বাঙালি দাওয়াও খুব শক্তিশালী। এটা অবশ্য বহু পাহাড়ি মানুষেরই বিশ্বাস, পাহাড়ে গেলে বহু বিজ্ঞাপন দেখা যায় বাঙালি দাওয়াখানার। বাঙালি দাওয়া না থাকলেও নামী ওষুধ কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক আর প্যারাসিটামল ছিল, তাই দিলাম। ওঁর নিজেরও নাকি খুব গ্যাস হয়, তার জন্য যদি কিছু থাকে দাওয়া। গ্যাস! পাহাড়েও ‘গ্যাস-রোগ’! নগরায়ন তা হলে বহুমুখী! খালি বাড়ি-গাড়ি-রাস্তায় আটকে নেই। সঙ্গে থাকা প্যান্টোপ্রাজল জাতীয় ওষুধও দিলাম। ওষুধের দাম নিতে অস্বীকার করলে শেষে উনি জোরজার করে দুটো ছোট কোলবালিশ সাইজের পাহাড়ি শসা আর লাল লাল রাজমার অনেক শুঁটি খেত থেকে তুলে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।
পুরনো সঙ্গীরা সবাই আমাদের গাড়িতে তুলে দিতে এল। সবাইকে বুকে জড়িয়ে বিদায় দিয়ে গাড়িতে উঠলাম। হীরাকে বললাম, ফেসবুকে যোগাযোগ রেখো আর পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন হয়ে গেলে তোমার বোনের মতো স্কুলে পড়াও বা অন্য একটা ভালো চাকরির চেষ্টা করো। হীরা বলল, কিন্তু কীড়া-জড়ির মতো এত কম সময়ে এত টাকা কি কোনও চাকরিতে পাওয়া যাবে? বললাম, কিন্তু তোমার বন্ধুর মতো তোমারও যদি খারাপ কিছু ঘটে যায়? হীরা হেসে কপালে ওর স্মার্টফোনটা ঠেকাল। বুঝলাম, সম্মুখে মহাভারত। বাড়িওয়ালার অত্যাধুনিক গাড়ি আমাদের নিয়ে রওনা দিল কংক্রিটের পাহাড়ি রাস্তা ধরে শহরের দিকে।
nirmalyadg@gmail.com