গানের একটু টুকরো, হয়তো স্থায়ীটুকু আজকাল সহজে শুনে নেওয়া যায় সেলফোনে কাউকে কল করলে। দু-একজন চিত্রপরিচালককে চিনি। কালেভদ্রে ফোনে কথা হয়। কল করলে শুনি আগের গানটি আর নেই। নতুন গান বাজছে। বুঝি, তাঁর নতুন ছবির গান। এক জন প্রযোজককে চিনতাম। তাঁর ফোনেও একই গল্প। গায়ক-গায়িকাদের সঙ্গে যোগাযোগ খুব কম। কবিদের সঙ্গেও প্রায় নেই। দুজনকে চিনি, যাঁরা সুর দেন ছবির গানে, এমনি গানেও। কিন্তু তাঁদের সুর করা গান ছবির বাইরে ক’জন শোনে জানি না।
অনুপম রায়ের ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ গানটি কয়েক বছর আগে অসংখ্য বাঙালির সেলফোনে বেজে উঠত। খুবই লোকপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন অনুপমবাবু, তাঁর গানটিও। সেই সময়ে আর কারও গান এতটা পরিসর দখল করেছে বলে মনে হয় না। পরে এই গীতিকার-সুরকারেরই ফিল্মি রচনা ‘আমার মতে তোর মতন কেউ নেই’ চিত্রপরিচালকের ফোনে শুনেছি, আরও জনা তিনেকের ফোনে, কিন্তু ‘আমাকে আমার মতো’র মতো সেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা আর ছিল না।
এমন হতে পারে আমি ভুল বলছি, আবার তা না-ও হতে পারে। অন্যান্য ছবিতেও আধুনিক গান থাকছে। কোনও কোনও গান, শুনছি, ভয়ানক চড়ার পরদায় কেউ গাইছেন— এত চড়ায় যে কণ্ঠের আওয়াজ আর স্বাভাবিক নয়। বয়স তো কম হল না, জলও তো খেলাম কত বিচিত্র ঘাটের। গলা ও গায়কি শুনেই বোঝা যায়, স্বাভাবিক গলা দিয়ে ওই উদ্ভট উচ্চগ্রামে যাননি গায়ক। ওই উচ্চতায় আওয়াজই যাচ্ছে পালটে। সুরটি যে ঠিক কেমন তা বোঝা মুশকিল। খান সাহেব আবদুল করিম খান এক কালে এফ-শার্পে গাইতেন। দেবী সরস্বতীর এক কন্যা কেসরবাঈ কেরকারও গাইতেন একই পরদায়, তবে এক সপ্তক নীচে। একটা গোটা সপ্তকের তফাতে একই পরদাকে ‘সুর’ মানছেন দুই বিরাট কণ্ঠশিল্পী। দুজনের আওয়াজই মধুর, সাবলীল। আজ, যাঁরা ওই পেল্লায় গ্রামে গাইছেন, তাঁদের ‘গানের গলা’ ঠিকমত আছে কি না সন্দেহ।
বাংলার বাউলদের মধ্যে এমন গায়কদের পাওয়া গিয়েছে, যাঁরা অস্বাভাবিক রকম চড়ায় গান ধরেন। হয়তো তাঁদের পরিবেশ, হয়তো খালি গলায় গান গেয়ে অনেকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ তাঁদের বাধ্য করে অত উঁচু পরদায় গাইতে। শহরের লোকরা গ্রামের কোনও মেলায় বা উত্সবে গিয়ে তাঁদের সেই গান শুনে তারিফ করেন। আশির দশকে উত্তর আমেরিকা সফরের সময়ে সলিল চৌধুরী আমায় বলেছিলেন, ‘সাহেবরা, দেখবি, আমাদের দেশ থেকে বাউল নিয়ে এসে ওঁদের ওই চিল-চিল্লানো গানগুলো শোনে। ওদের কাছে এগুলো এথ্নো-মিউজিকোলজির বিষয়।’
জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই যেন তারসপ্তকের মগডালে উঠে সুনামি-ঘরানায় যাঁরা আজ গাইছেন, তাঁদের স্বাভাবিক গলা কেমন কে জানে।
দেশের মানুষের কানে কী ধরনের গানের গলা বেতারের মাধ্যমে পৌঁছবে, সেই দিকে এক সময়ে রাষ্ট্রের ছিল কড়া নজর। তখনও বেতার ছিল সম্পূর্ণ সরকারি। বেসরকারি এফএম বেতার তখনও আসেনি। আকাশবাণীর অডিশনে পাশ না করলে কোনও গায়ক বা বাদক বেতারে অনুষ্ঠান করতে পারতেন না। আমাদের দেশে সরকারের সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কেই দুর্নাম রটানো হয়ে থাকে। কোনও কোনও দুর্নাম একেবারে অকারণ ও ভিত্তিহীনও নয়। এমন হওয়া বিচিত্র নয় যে, উত্কোচের সাহায্যে কোনও কোনও দুর্বল গায়ক-বাদকও অতীতে আকাশবাণীতে সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেটাই যদি রেওয়াজ হত বা অমন ঘটনা যদি হামেশাই ঘটত, তা হলে দীর্ঘকাল ধরে এত জন গুণী, এলেমদার সংগীতশিল্পীকে আমরা পেতাম না। তা হলে অনুপযুক্ত, গলার আড়-না-ভাঙা ‘শিল্পী’দের গানও আমরা বেতারে বেশি শুনতাম, যা আমরা কিন্তু বছর পঞ্চাশেক অন্তত শুনিনি। বেতারে ‘বি-হাই’ শ্রেণির শিল্পী না হলে গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানি কোনও শিল্পীকে রেকর্ডিং-এর জন্য ডাকতেন না।
অন্য দিকে এটাও দেখা যায় যে, কোনও কোনও প্রতিভাবান শিল্পী বা শিক্ষার্থী পরীক্ষায় বা অডিশনে ভাল ফল করেন না। কাজেই কেউ বলতে পারেন, ছাঁকনি প্রথাটি তুলে দিলে এক ধরনের গণতন্ত্রায়ণ দেখা দেবে। সতীনাথ মুখোপাধ্যায় নাকি ছ’বার আকাশবাণী কলকাতার অডিশনে পাশ করতে পারেননি। বিশ্বাস হতে চায় না। সে যা-ই হোক, বেতার-অডিশনে অন্তত বি-হাই গ্রেড অর্জনের ওপর যে দেশে এক কালে কোনও গায়কের গান প্রকাশ্যে আসার সম্ভাবনাটি নির্ভর করত, আজ সে দেশে গানের রেকর্ডিং করা, চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করা, বেতারে সেই গান বাজা— এই ব্যাপারগুলি আর শিল্পীর দক্ষতা, উত্কর্ষের স্বীকৃতির ওপর নির্ভর করে না। চলচ্চিত্র প্রযোজক বা পরিচালকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকলে ছবিতে প্লে-ব্যাক করা, এমনকী সংগীত পরিচালনা করা জলভাত। আজ থেকে বছর তিরিশেক আগেও এটা কল্পনা করা যেত না। বাংলা ছায়াছবিতে এক কালে প্রধানত আকাশবাণী-অনুমোদিত গীতিকাররাই যোগ দিতে পেরেছিলেন। সুরকারদের বেলাতেও তাই। ব্যতিক্রমও ছিলেন, কিন্তু কম। এই রীতির ফলে হয়তো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের অভাবে কোনও কোনও প্রতিভাবান মানুষের বিকাশ সম্ভব হয়নি। কিন্তু, ছাঁকনি-ব্যবস্থাটা থাকায় অপদার্থ অক্ষমরা এই দুনিয়ায় ঢুকতে পারেনি। এর ফলে সাংস্কৃতিক ভাবে আমাদের জাতির লাভই হয়েছে।
কোনও রকম শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, তালিম, দক্ষতা, পটুত্ব, অভিজ্ঞতা ছাড়াই সংগীতের ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশের সুযোগ এসে পড়ায় এবং মিডিয়া
হাতে থাকলে নাম করে যাওয়া এবং ভাল আয় করার রাস্তা খুলে যাওয়ায় যা দেখা যাচ্ছে— কণ্ঠের মধ্য দিয়ে কোনও পৃথক ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠছে না। বেশির ভাগ গলার আওয়াজ একই রকম, স্টাইলও এক। আর, কথায় স্মার্টনেস ও আধুনিক কবিতার ধাঁচা থাকলেও সুরগুলো মোটের ওপর একই রকমের। গত শতকের সত্তরের দশক পর্যন্ত আধুনিক গানে সুর ও কণ্ঠের যে বৈচিত্র ছিল, আজ তা বলতে গেলে নেই। বাজনাতেও যে অভিব্যক্তি ও বক্তব্য ফুটে উঠত অতীতে, আজ তার অনেকটাই উধাও। গিটার ও সিন্থেসাইজার-কেন্দ্রিক যন্ত্রানুুষঙ্গের অতিব্যবহারে একঘেয়েমিই এসে পড়ে বেশি। গলার আওয়াজ, গায়কি, উচ্চারণ, সুর, কথা-সুরের মিলিত আবেদন ও বাজনার ধ্বনি— সব দিক দিয়েই আজকের বাংলা গান যেন ফিরে গিয়েছে গেল শতকের আশির দশকে।