পিনাকী ভট্টাচার্য
রাম-এর অনেক ডাক নাম— যেমন কিলার ডেভিল, নেলসন্স ব্লাড। প্রথম নামটা দেওয়া হয়েছিল অসুখ-রূপী শয়তানকে শায়েস্তা করার জন্য। যদিও নামটা ‘ডেভিল কিলার’ না হয়ে ‘কিলার ডেভিল’ হওয়ায় অর্থটাই অন্য রকম হয়ে যায় (এই নামকরণের সময় পেটে কিছুটা রাম থেকে গিয়েছিল বোধহয়)। নেলসন্স ব্লাড নামটার পেছনে আছে এক পিলে চমকানো গল্প।
ব্রিটিশ নৌ-সেনাদের সঙ্গে রাম-এর আলাপ সেই ১৬৫৫ সালে, যখন ব্রিটিশ নৌবাহিনী জামাইকা দখল করে। ক্রমে তাদের দৈনিক রেশনের সঙ্গে ব্র্যান্ডি দেওয়া বন্ধ করে রাম দেওয়া চালু হল। একদম প্রথমে বিশুদ্ধ রাম দেওয়া হত, কিন্তু ১৭৪০ সাল থেকে অ্যাডমিরাল ভারনন-এর নির্দেশে নৌসেনাদের নিত্যি মাতলামি রুখতে রামের সঙ্গে জল মিশিয়ে দেওয়া শুরু হল (এই দৈনিক রেশনের সঙ্গে রাম দেওয়ার প্রথা বা ‘টট্’ ৩১ জুলাই ১৯৭০ অবধি চলেছে)।
ট্রাফালগারের যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাপতি নেলসন নিহত হলে, তাঁর দেহ এক পিপে ভর্তি রামে চুবিয়ে সংরক্ষণ করে দেশে ফেরত নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত হয়। ইংল্যান্ডের বন্দরে পিপে থেকে দেহ বার করতে গিয়ে নৌবাহিনীর পদস্থ অফিসাররা চমকে ওঠেন— নেলসনের দেহ রয়েছে, কিন্তু এক বিন্দু রামও পিপেতে পড়ে নেই— পুরো রামটাই যেন কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে! তদন্ত করে জানা যায়, জল-মেশানো রাম খেয়ে বিরক্ত নাবিকরা পিপেতে একটা ফুটো করে তাতে স্ট্র লাগিয়ে পুরো রামটা খেয়ে নিয়েছে। সেই থেকে রাম-এর আর এক নাম নেলসন্স ব্লাড।
অস্ট্রেলিয়াতে একবারই সামরিক উত্থান হয়েছিল আর সামরিক শাসন চালু হয়েছিল। এই ঘটনা ইতিহাসে ‘রাম বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত। ১৮০৮ সালে, নিউ সাউথ ওয়েলস কর্পস্ বেয়নেট উঁচিয়ে গভর্নমেন্ট হাউস আক্রমণ করে আর অস্ট্রেলিয়ার গভর্নর উইলিয়াম ব্লাই-কে গ্রেফতার করে। যদিও এর মূলে ছিল অনেক রকমের ক্ষমতার লড়াই, চালু মিথ হল: ব্লাই রামের রমরমে ব্যবসায় বাধা দিচ্ছিলেন বলেই তাঁর এই দশা হয়। এতে বোঝা যায়, সাধারণ লোকের মনে রাম-এর কী ধুন্ধুমার ইমেজ!
আখ-খেতের আর চিনির কলের মালিকরা চিনি আর রামের ব্যবসায় কোটিপতি হয়ে বিভিন্ন ক্যারিবিয়ান এস্টেটে থাকত— তাদের দেওয়া পার্টিগুলো হত প্রায় রূপকথার মতন। এমনই এক পার্টির বর্ণনা— বাগানের মধ্যিখানে তৈরি হল মার্বেলের এক বিশাল চৌবাচ্চা। তাতে ঢালা হল ১২০০ বোতল রাম, ১২০০ বোতল মালাগা ওয়াইন, ১০০ গ্যালন গরম জল। তাতে ৬০০ পাউন্ড সর্বোৎকৃষ্ট চিনি, ২০০ জায়ফলের গুঁড়ো মেশানো হল। এর পর ২৬০০ লেবু নিয়ে তার রস নিংড়ে ঢালা হল সেখানে।
এই বার, এই মস্ত চৌবাচ্চায় এক সুদৃশ্য মেহগনি কাঠের তৈরি নৌকো ভাসানো হল— তার সওয়ারি এক বারো বছরের ছেলে। সে দাঁড় বেয়ে ভেসে বেড়াতে লাগল আর ৬০০ অতিথিকে চৌবাচ্চা থেকে পরিবেশন করতে লাগল যত ক্ষণ না তার সমুদ্দুর শুকিয়ে যায়।
এমন একটা পার্টিতে গেলে মন্দ হয় না, তাই না? এমনই পার্টি হত আজ থেকে ৩০০ বছর আগে— ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপগুলোতে, মালিকদের খামারে। ও! বলতে ভুলেছি! সে দেশে আজও জাতীয় রাম দিবস পালন করা হয়! ১৬ই অগস্ট!
pinakee.bhattacharya@gmail.com
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
তখন গ্যালিফ স্ট্রিট ট্রাম ডিপো থেকে চাদ্দিকে ট্রাম যেত। ট্রামের জন্য অপেক্ষা করছি, দেখি বোঁদে। বলল, নিউ মার্কেট যাচ্ছে ড্রেস কিনতে। ডবল পকেট শার্ট, ‘দেয়া নেয়া’ সিনেমায় উত্তমকুমার যেমন জামা পরেছিলেন। বোঁদে উত্তমকুমারকে গুরু মানে, চুলের সামনেটা ফোলা, ঘাড়ে ইউ কাট। মানে, উত্তম-ছাঁট আর কী। হঠাৎ দেখি বোঁদে এক ভদ্রলোকের সামনে নিলডাউন হয়ে গেল। সেই ভদ্রলোকের চোখে গগল্স। তখন এগুলোকে মার্কারি গগল্স বলা হত। বাইরেটা আয়নার মতো। ওখানে মেঘের ছায়া-পাখির ছায়া পড়ে, মুখও দেখা যায়। বোঁদে ভদ্রলোককে বলল, প্লিজ দাদা, নড়বেন না, আমি একটু চুল আঁচড়াব। আপনার গগল্স-এর কাচে মুখ দেখা যায় কিনা... পিছনের পকেট থেকে চিরুনিটা বার করে বোঁদে।
বোঁদে বলত, গুরুর সঙ্গে আমার অনেক মিল। প্রথম কথা, আমার মামার বাড়ি আহিরিটোলা, গুরুরও তাই। আমিও চিংড়ি মাছ ভালবাসি, গুরুও। আমার জীবনের প্রথম দুটো সিনেমা ফলপ করল, গুরুরও তাই। এর পর ফাটিয়ে দেব, শুধু একটা ঠিকঠাক সুচিত্রা চাই।
বোঁদের খুব সিনেমায় নামার শখ ছিল। টালিগঞ্জপাড়ায় গিয়ে এক্সট্রা হতে পেরেছিল, ডায়লগ পায়নি। অবশেষে ডায়লগ পেয়ে গেল, এক্কেবারে নায়িকার সঙ্গে। রাস্তার রোয়াকে আড্ডা মারা ছেলেদের কাছে নায়িকা জিজ্ঞাসা করবে ‘প্রফেসর সুবীর মিত্রর বাড়ি কোনটা?’ বোঁদে তখন বলবে, ‘উনি তো বহু দিন এ পাড়া ছেড়ে চলে গেছেন।’ আর নায়িকার নাম সুচিত্রা সেন। বাস, বোঁদের ডাঁট বেড়ে গেল, পায়ের স্টেপিং পালটে গেল, গুরুজনদের দেখেও সিগারেট লুকোত না। জামার কলার উঠিয়ে দিল, কিন্তু অচিরেই কলার নামিয়ে দিয়েছিল, কারণ গুরু উত্তমকুমার কোনও সিনেমায় কলার ওঠাননি। আর উত্তমকুমারের সঙ্গে বোঁদের সাদৃশ্যের যে পয়েন্টটা বাকি ছিল, সেটাও হয়ে গেল। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ওরা দুজনেই অভিনয় করেছে।
ছোটবেলা থেকেই বোঁদে ছিল উত্তম-মতি। হাতিবাগানে রোববারে পাখির হাট বসত। বোঁদে একখাঁচা পায়রা কিনে এনে হরনাথ স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে— ‘শোন শোন গেরোবাজ, খোপ থেকে বেরো আজ, আকাশটা পেরো আজ, যা রে যা’ বলতে বলতে একটা একটা করে পয়সায় কেনা পায়রা আকাশে উড়িয়েছিল। ‘মায়ামৃগ’ সিনেমায় উত্তম এমনই তো করেছিলেন। এক বার একটা সাইকেলে চেপে সামনের বাস্কেটে একটা ছাগলছানাকে চাপিয়ে প্যাডেল করতে করতে গাইছিল, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়।’ আমি এই ঐতিহাসিক রোম্যান্টিকতার সাক্ষী ছিলাম না যদিও, বন্ধুদের মুখে শুনেছি, বোঁদে ‘কেমন হত তুমি বলো তো’, বলার পরই ছাগলছানাটা ভ্যাঁ করে উঠত। সেটাই তো ‘তুমিই বলো’!
হায়ার সেকেন্ডারির টেস্ট পরীক্ষায় বোঁদেকে আটকে দিল পোড়ামুখো ইস্কুল। ওর প্রিয় বন্ধু ছিল পটকা। দুজনেই ক্লাসে একই রকম ফেল করত। পটকা টেস্টে অ্যালাউ হয়ে গেল। পটকার কাঁধে হাত রেখে বোঁদে গেয়েছিল, ‘আজ দু’জনার দুু’টি পথ ওগো দু’টি দিকে গেছে বেঁকে। কিন্তু আমি শিল্পী। জীবনযুদ্ধে পথে হল দেরি। হারানো সুর ফিরে পাব ঠিক, শাপমোচন হবেই। আমি আজ কলঙ্কিত নায়ক হতে পারি, কিন্তু আমার মনে আনন্দ আশ্রম। চাওয়া পাওয়া কি মেলে? জীবনখাতার প্রতি পাতায় যতই লেখো হিসাবনিকাশ, কিছুই রবে না। আমি জানি পটকা, পৃথিবী আমারে চায়। আমারও জীবনতৃষ্ণা আছে। নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড়, হে মন বলাকা মোর অজানার আহ্বানে চঞ্চল পাখা মেলে ধরো।’
উত্তমকুমারের অভিনয় করা সিনেমা এবং ওঁর লিপ-এর গান এ ভাবেই জড়িয়ে থাকত ওর জীবনে। স্কুলেও ‘একটি ঝড়ের রাত’ রচনা শুরু হয়েছিল— উত্তমকুমার গাহিয়াছেন, ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস আজকে হল সাথী, সাত মহলার স্বপ্নপুরীর নিভল হাজার বাতি।’ বাংলার স্যর যখন বললেন বেঞ্চির উপর দাঁড়া, বোঁদে বলেছিল, কবি গাহিয়াছেন বলে রচনা শুরু হয়, কিন্তু কবি কি গায়? উত্তমকুমার এটা গেয়েছেন— লিখে কী দোষ করলাম স্যর?
স্কুল ছাড়ার পরও ও উত্তমকুমারের ডায়লগ ছাড়েনি। রকে বসা সিনিয়ররা ডেকে ওর কাছ থেকে ‘দেয়া নেয়া’, ‘সপ্তপদী’ ‘রাজদ্রোহী’র ডায়লগ শুনতে চাইত। আর বোঁদেও আশ্চর্য ভাবে যা-খুশি ইংরিজি বলে ‘সপ্তপদী’ সিনেমার ওথেলো-র ডায়লগ বলে দিত। দিস ইজ দি কঅজ মাই ডার্লিং দাই নো ক্রাই স্কাই ইন ব্ল্যাকিফেরাস অ্যান্ড পিলিং। হাই ডিয়ার হোল্ড মাই ডার্লিং দাই নো ক্রাই স্কাই ইজ ব্ল্যাকিফেরাস অ্যান্ড পিংলিং। হাই ডিয়ার হোল্ড মাই হ্যান্ড অ্যান্ড কিস দিস ইজ দি ক-অজ হোয়াই ওয়ার্ল্ড ইজ বন বন রাউন্ডিং ফাউন্ডিং নো-লস নো-গেইন সাইকেল চেন... অনর্গল বলে যেত।
‘রাজদ্রোহী’র শেষ সিন করত অনবদ্য ভাবে। ওখানে নায়িকার নাম চিন্তা। অঞ্জনা ভৌমিক অভিনয় করেছিলেন। একটা ল্যাম্পপোস্ট’কে চিন্তা বানিয়ে ল্যাম্পপোস্ট জড়িয়ে ধরে ডায়লগ দিত, শেষ দৃশ্যে একটা অন্তিম হাফচুম্বনও থাকত। এক বার এক সন্ধ্যায় গঙ্গার ধারে সবাই বোঁদেকে ধরল। রাজদ্রোহী হয়ে থাক। সেই দলে পটকাও ছিল। চা-শিঙাড়া, সিগারেট খাওয়ানো হল। একটা পাঁচ ফুটের বাঁশ ছিল ‘চিন্তা’। অন্তিম দৃশ্যের ডায়লগের সময় নাক কুঁচকে এ মা, এ কী, থুঃ করল। চুম্বনস্থানে গোবর লাগিয়ে রেখেছিল কেউ।
চিন্তা, মানে বাঁশটিকে যত্ন করে শুইয়ে রেখে ও আমাদের দিকে একটা তির্যক দৃষ্টি হানল— যেন ঝিন্দের বন্দী। মানে উত্তমকুমার। তার পর উদাস চলে গেল। গাইল— যদি জগাই মাধাই না থাকত তবে নিমাইকে কি চিনত লোকে...। ‘মৌচাক’ সিনেমার গান।
অনেক দিন পরে দেখা হয়েছিল। বুড়ো হয়েছে। বলল— গৌরবটার জন্য চিন্তা হয়। এখনও ঠিক মতো দাঁড়াতে পারল না। গৌরব, মানে উত্তমকুমারের অভিনেতা-পৌত্র।