রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

পিনাকী ভট্টাচার্য

Advertisement

বিশ্বের বিভিন্ন কোণ থেকে বণিকরা শহরে এসে জমা হয়েছেন। জোর কদমে বাণিজ্য হচ্ছে দেশে। বণিকদের লাভ হচ্ছে, দেশের সমৃদ্ধি হচ্ছে, রাজার কোষাগার ফুলে ফেঁপে উঠছে, রাজ্যের নাম বিশ্বের কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়ছে— সব ভাল, তার মধ্যে বিপন্ন শুধু সরাইখানার মালিকেরা। তাঁদের প্রাণ ওষ্ঠাগত বণিকদের বায়নাক্কার চোটে! এক-এক দেশের মানুষের এক-এক রকম খাবারের আবদার! অবশেষে সরাইখানার মালিকরা একজোট হয়ে এক রাস্তা বার করলেন। যদিও হাজার বছর আগের কথা, সেই দেশ তখনই কাগজ ব্যবহার করছে নিত্যি। সরাইখানার মালিকরা কাগজে লিখলেন: সে দিন কী কী খাবার পাওয়া যাবে— আর দেওয়ালে সেঁটে দিলেন।

এতে এক দিকে সরাইখানার বিজ্ঞাপনও হল, আবার মাঝরাতে মাতাল বণিকদের হুজ্জতি থেকেও বাঁচা গেল। চাহিদা অনুযায়ী এই লিস্টি বদলও হত, কয়েক দিন অন্তর বণিকদের মুখের স্বাদ বদলাতে, আর মন রাখার জন্যে। এই ভাবে জন্ম নিল মেনু কার্ড। আর এই অভিনব পন্থা অন্য মহাদেশে পৌঁছে গেল অচিরেই। দেশের নামটা বোধহয় আর বলে দিতে হবে না— কারণ হাজার বছর আগে কাগজের ব্যবহার শুধু চিনদেশেই হত। সময়টা সং বংশের শাসনকাল— যখন বাণিজ্যে চিন বিশ্বে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল সারা বিশ্বে। আর এই গল্পের পটভূমি সেই সময়ের রাজধানী বিয়ানজিং— যাকে আমরা বর্তমানের কাইফেং বলে চিনি।

Advertisement

‘মেনু’ কথাটা এসেছে ভোজনরসিক ফরাসি দেশ থেকে, মূল শব্দটা লাতিন ‘মিনুটুস’— যার মানে ‘কোনও কিছুকে ছোট আকারে দেখা’। রান্না ফরাসি দেশে এক প্রধান শিল্প— শুধু স্যুপই ওখানে ২০০ রকমের আছে। বিশ্বের বিভিন্ন কোণ থেকে ফ্রান্সে আসা ভোজনবিলাসীদের খাওয়ার আবদার মেটাতে গিয়ে পাচক থেকে মালিক সবাই তখন বিপর্যস্ত। আর সব থেকে বেকুব বনত ভোজনবিলাসীর দল। না বুঝে না জেনে আন্দাজে অর্ডার দিয়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খাওয়াদাওয়া শেষ হত প্রচুর গালাগাল দিয়ে। কারণ গালাগালের কোনও ভাষা বা দেশ নেই— ও জিনিসটা সবাই দিব্যি বুঝতে পারে।

অনেক ভেবেচিন্তে রেস্তরাঁ-মালিকরা এক ফিকির বার করলেন— খাবারের এক লিস্টি বানালেন, যেগুলো থেকে না বুঝে অর্ডার দিলেও বিপর্যয়ের সম্ভাবনা কম। কম জটিল রান্নাগুলো থাকত এই লিস্টিতে। এই তালিকার নাম দেওয়া হল আ-লা-কার্ত; এইখান থেকে অর্ডার দিলে দায়িত্ব ক্রেতার। কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। আর বাকি খাবারগুলো পরিবেশন করার জন্য বেশ কিছু মেনু বানানো হল, যার নাম ‘তাব্ল দ্যোৎ’— যেখানে রেস্তরাঁ-মালিক তাঁর শেফ-এর সঙ্গে বসে স্বাদ-বর্ণ-আকারে তারতম্য রেখে খাবার বানাতেন, যাতে বিদেশ থেকে আসা গুর্মে বা ভোজনরসিকরা ফরাসি খানার ঠিক স্বাদ আর বিস্তার বুঝতে পারেন। সেই মেনু’তে স্যুপের আগের পদ থেকে মিষ্টান্নের পরের পদ অবধি সব সাজানো থাকত। ফরাসি মেনুকরণের আদিযুগে আ-লা-কার্ত খানাকে মেনুর কৌলীন্য দেওয়া হত না।

চিন দেশে জন্মে ফরাসি পরিবারে বড় হয়ে মেনুর বিশ্বজয়ের গল্প কিন্তু বেজায় ধাক্কা খেল ১৯২২ সালে, যখন উইলিয়াম ক্রিস্টাল সাহেব মিশরে সেত্নাখ্ত-এর মমি খুঁড়ে বার করেন। তৃতীয় রামেসিস-এর বাবা সেত্নাখত্ খ্রিস্টপূর্ব ১১৮৬-তে মমিত্ব পান— আর তাঁকে খুঁড়ে বার করার সময় বেরিয়ে আসে কিছু অদ্ভুত হায়রোগ্লিফিক্স-এর টুকরো— যা থেকে বোঝা যায়, সেত্নাখত্ মহা-ভোজনরসিক ছিলেন আর তাঁর আমলেও মেনু দেখে তিনি খাওয়ার ফরমাশ করতেন!

pinakee.bhattacharya@gmail.com

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

উনি আমাকে ওঁর কার্ডটা দিলেন। নিরঞ্জন বড়াল। কবিসুধাকর। সম্পাদক— ‘মুথাঘাস’। এর পর, পুরস্কার প্রাপ্তির তালিকা। এর মধ্যে ‘অক্সিজেন পুরস্কার’ এবং ‘কাঁচ কাটা হীরে সম্মান’ মনে আছে। কার্ডের সাইজটাও স্বাভাবিক ভাবেই বড়। একটা তাসের সাইজ। কোন কোন বৃহৎ কবি স্বহস্তে তাঁকে কাব্যগ্রন্থ প্রদান করেছেন, তারও উল্লেখ আছে। অবশেষে ঠিকানা। কাব্যনীড়। তার পর আবার ব্র্যাকেট। ব্র্যাকেটের ভিতর লেখা ‘বহু বিশিষ্ট কবির পদধূলি ধন্য’।

বলেছিলেন, আসুন না কাব্যনীড়ে। ডিম শিম হিম নিম কাশ বাঁশ রিমঝিম। এটা ওঁর বাড়ির উঠোনের কাব্যপ্রতীক। মুরগি ডিম দেয়, শিমের মাচা আছে, শীতটা উপভোগ্য, নিমপাতা ঝিরঝির করে, বাঁশের এবং কাশ-ঘাসের ঝাড় আছে ইত্যাদি।

নিরঞ্জনবাবুর সারা মুখে এবড়োখেবড়ো দাড়ি। নোংরা পাজামা, হাফ পাঞ্জাবি। বললেন, যে দিন কাব্যনীড়ে গৃহপ্রবেশ হল, সে দিন কাঁচা সিমেন্টে, ঘরের ভিতর তিন জন পাকা কবিকে দিয়ে সই করিয়ে রেখেছিলাম। ঘরেই সেই সই অক্ষয়। তার উপরই বিছানা পেতেছি। তিন জন কবির নাম বলেছিলেন নিরঞ্জন বড়াল। সত্যিই বিখ্যাত।

বললেন, শক্তিদা থাকলে শিয়োর আসতেন। এক জন শক্তির কবিতা নকল করা কবি সই করতে চেয়েছিল। ছিঃ। কিশোর-কণ্ঠী, লতা-কণ্ঠী হয়, কিন্তু শক্তি-কলমী হয় না।

আমি জানতাম, কাব্যরোগাক্রান্ত নিরঞ্জন বড়ালের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। জিজ্ঞাসা করি, বাড়ি করার টাকাকড়ি কী ভাবে জোগাড় করলেন?

উনি বললেন— কেন? কবিতার মতো করে। এত হাজার শব্দ ছড়ানো রয়েছে, খুঁজে নিয়ে, জড়ো করি, তার পর তো কবিতা নির্মাণ করি। বাড়িটাও ওর’ম করে করেছি। বাড়ি

তৈরির সব উপকরণ প্রকৃতি ছড়িয়ে রেখেছে। জড়ো করাটা আমার কাজ।

যেমন ধরো বালি। নদী তার শরীর জুড়ে বালি বিছিয়ে রেখেছে, আমার বাড়ির কাছেই নদী। মাত্র এক মাইল। রোজ দু’ব্যাগ করে বালি নিয়ে এলেই হল। নদী এক্কেবারে রাগ করে না। এক বছরে ৭০০ ব্যাগ বালি হয়ে গেল। বালিতে নুড়িও থাকে। চালুনিতে ছেঁকে নাও, নুড়ি জুটে গেল। কাছেই ইটের পাঁজা। রোজ একটা দুটো করে ইট নিয়ে এলে পাঁজাওয়ালারা কিছু বলে না। ছেলেটাকে বলেছিলাম রোজ দুটো করে ইট নিয়ে আসিস বাপ, ভাল ব্যায়াম। তা বছরে কম করে ৭০০ ইট জমল কিনা?

আর পাথর? সে তো সারা দেশেই ছড়ানো। আমার এলাকার মাটিতে পাথর নেই তো কী হয়েছে, রেললাইনে তো আছে। সারা রেললাইন জুড়েই ছড়ানো-খেলানো-এলানো-বিলানো পাথর। রোজ এক ব্যাগ করে পাথর কবির জন্য রেললাইন দিয়ে দেয়। আরে, রেল নিয়ে কত কবিতা, কত গান। রেলগাড়ির দৃশ্যটা ছাড়া ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমাটা ভাবা যায়? শিল্প-সংস্কৃতির জন্য রেললাইন এটুকু দেবে না?

আর কাঠ? সে তো বৃক্ষগণ আছেই। বৃক্ষবন্দনা তো কবিরাই করেছে যুগে যুগে। একটা কবির জন্য একটা বৃক্ষ অনায়াসে নিজেকে উৎসর্গ করে দিতে পারে। এ রকম একটা শালবৃক্ষ নিজেকে কবিতার জন্য নিবেদন করেছিল। একটা কুঠার দিয়ে প্রতি দিন ২০টি আঘাত। তার পর করাত কলে নিয়ে যাওয়া।

তবে সিমেন্ট এবং লোহা— এরা বড় হৃদয়হীন। এরা কংক্রিট গড়ার উপাদান কিনা, কবিতায় কংক্রিট শব্দটা ক্রূরতা, নিষ্ঠুরতা, হৃদয়হীনতা, কঠোরতার প্রতীক। সিমেন্ট এবং লোহা এই দুটো আবশ্যিক উপাদান আমাকে কিনতে হয়েছিল।

তার পর ধীরে ধীরে বাড়িটা করে ফেললাম। রাজমিস্তিরির সঙ্গে নিজেরাও বাপ-পুতে হাত লাগালাম। যে হাত কলম ধরে সে হাতও ধরতে পারে কার্নিক। তৈরি হয়ে গেল কবিতার বাড়ি। কাব্যনীড়।

নীড় নির্মাণের জন্য পাখিরা তন্তুজ উপাদান প্রকৃতি থেকেই তো সংগ্রহ করে। আমিও পাখির মতো। তাই ভবন নয়, বাটি নয়, কুটির নয়, নীড়। বাকি ছিল শৌচালয়। ওটাও হয়ে গেল নির্মলের কারণে। নির্মল মাঝির কবিতা ছাপিয়ে দিলাম মুথাঘাসে। সে আবার নির্মল ভারত যোজনার কর্তা লোক। এই যোজনায় খুব কম খরচে পায়খানা পাওয়া যায়। এই অকাব্যিক শব্দটা নিয়ে অনেক ভেবেছি, বিকল্প পাইনি।

একটাই মাত্র ঘর করতে পেরেছি, বারান্দা আছে, কাব্যপাঠ হয়। কবির অভাব নেই। এ ভূমিতে কবিগণ উত্তম রূপে উৎপন্ন হয়। ওদের বলেছি কাব্যপাঠে আসার সময় একটা করে ইট নিয়ে আসতে। আর একখানা ঘর খুব দরকার— শুধু কবিতার জন্য।

swapnoc@rediffmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement