রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৪ ০০:৪০
Share:

পিনাকী ভট্টাচার্য

Advertisement

এক ছিল হাবশি রাখাল— নাম ছিল তার কাল্দি। ইথিয়োপিয়ার পাহাড়ি জমিতে সে তার ছাগল চরাতে নিয়ে যেত। এক দিন কাল্দি দেখল তার শান্ত ছাগলগুলো অদ্ভুত ব্যবহার করছে। কেউ লাফাচ্ছে, কেউ খুব জোরে ডাকছে, কেউ পিছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। মোদ্দা কথা, দিনের শেষে ছাগলগুলোর প্রাণশক্তি আর ফুর্তি যেন আচমকা বেশ কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। ছাগলদের পিছনে পিছনে ছুটে, তাদের উত্তেজনার কারণ খুঁজতে গিয়ে, কাল্দি এক ঝোপের মধ্যে উজ্বল লাল কিছু কুল-জাতীয় ফল দেখতে পেল। কৌতূহলী হয়ে সে নিজেই সেই নাম না জানা ফল মুখের মধ্যে নিয়ে কামড় বসাল। তার পর? মন আর শরীর দারুণ চনমন করে উঠল। এক্কেবারে কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! মনে একরাশ ফুর্তি নিয়ে কাল্দি বাড়ি ফিরল তাড়াহুড়ো করে— গিন্নির জন্য পকেটভর্তি নতুন আবিষ্কার করা ফল নিয়ে। গিন্নি পরামর্শ দিল পাশের খ্রিস্টান সাধুদের আশ্রমে গিয়ে এই ফলের কথা বলতে আর কিছু ফল দিয়ে আসতে।

ভালমানুষ কাল্দি আশ্রমে গিয়ে বিপাকে পড়ল। কারণ সন্ন্যাসীরা তার কাছে এই ফলের গুণাগুণ শুনে এই নতুন ফলকে সন্দেহের চোখে জরিপ করতে লাগল। শেষে এক সন্ন্যাসী নিদান দিল— এই ফল শয়তানের সৃষ্টি। বলে, ফলগুলো নিয়ে সামনের অগ্নিকুণ্ডে ছুড়ে ফেলে দিল। আর তখনই আগুন থেকে ভেসে এল এক স্বর্গীয় সুবাস। সাধুরা ঝুঁকে অবাক হয়ে দেখল, সেই মিষ্টি গন্ধটা আসছে আগুনে রোস্ট হওয়া সেই ফলের দানা থেকে। পর ক্ষণেই সিদ্ধান্ত বদল। আগুন থেকে সেই ফলের দানা বার করে তার গায়ের আগুন নিভিয়ে গরম জলে ডুবিয়ে রেখে দেওয়া হল। সেই আশ্রমের সমস্ত সাধু ইতিমধ্যে ওই মিষ্টি গন্ধের টানে আগুনের চারপাশে জড়ো হয়েছিলেন। তাঁরা সবাই এ বার সেই জলটা খাওয়া মনস্থ করলেন যাতে ফলের আধপোড়া দানাগুলো ডোবানো ছিল— ইতিমধ্যে জলের রং গাঢ় খয়েরি হয়ে গিয়েছে। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের চা-উৎসবের ধাঁচেই সবাই মিলে এই পানীয় গ্রহণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, এই পানীয় পেটে পড়লে একঘেয়ে ধর্মীয় উপচার পালনের সময় ঝিমুনি আসে না। সাধুরা প্রতিজ্ঞা করলেন যে এই নতুন পাওয়া পানীয় দিয়ে মুখশুদ্ধি করে তাঁরা অর্চনায় বসবেন।

Advertisement

একই রকম এক ফলের কথা আছে ইয়েমেনের উপকথায়। শেখ ওমর নামে এক সুফি সাধক ছিলেন, তিনি ডাক্তারিও করতেন। সে দেশের রাজা এক অপরাধে শেখ ওমরকে নির্বাসন দিলে তিনি পাহাড়ের কোলে এক গুহায় আশ্রয় নেন। যখন খাবারের অভাবে ওমর মৃতপ্রায়, সেই সময় তিনি এক ঝোপে লাল কুল-জাতীয় কিছু ফল খুঁজে পান। খেতে গিয়ে দেখেন সাংঘাতিক তেতো ফল, আর ভীষণ শক্তও বটে। একটু নরম হলে যদি তিক্ততা কমে, সেই মনে করে ওমর গুহায় জ্বালা আগুনে ফলগুলো ফেলে দেন। কিন্তু তাতে ফল হল বিপরীত— ফলগুলো আরও শক্ত হয়ে গেল। তখন নিরুপায় ওমর জলে ফুটিয়ে ফলগুলো নরম করতে গেলেন। হঠাৎ তাঁর নাকে এল এক সুন্দর গন্ধ, যা ওই জল থেকেই বের হচ্ছে। সেই খয়েরি জল খেয়ে ওমর অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। এবং এই ফলের গুণাগুণ অন্যদের বলেন।

ইথিয়োপিয়ার আর ইয়েমেনের লোককথার সে দিনের পানীয়টা যে কফি, এটা নিশ্চয়ই আর বলে দেওয়ার দরকার নেই? আর কাল্দির গল্প যদিও ৮৫০ খ্রিস্টাব্দের, এই গল্পটা লিখিত অবস্থায় জনসমক্ষে এসেছে ১৬৭১ সালে।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

ল্যান্ড সিলিং অ্যাক্ট’-এর বলে জোতদারদের লুকনো জমি উদ্ধারের পবিত্র কর্মে ‘কানুনগো’ হিসেবে জোতদারের আশ্রয়েই আছি। এক জোতদারেরই বাড়ি ভাড়া নিয়ে ‘ভূমিসংস্কার অফিস’ তৈরি হয়েছে। অফিসের পেশকার-আমিন-পিয়নরা গাদাগাদি করে অফিসেই রয়েছেন, গ্রামদেশে কে বাড়ি ভাড়া দেবে? তারাপদ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বহু বিঘে জমির মালিক। তাঁর একটা ধানকলও ছিল, কোনও কারণে সে সময় কলটা বন্ধ ছিল। সেই ধানকলের গদিঘরে থেকে, ওঁরই টেবিল-চেয়ারে বসে মৌজাম্যাপ খুলে ওঁরই বেনামি এবং সিলিং-বহির্ভূত জমি খুঁজে বের করার গুরুদায়িত্ব আমার। তারাপদবাবু মাঝে মাঝে এসে জিজ্ঞাসা করতেন, কী স্যর, কাজ এগুচ্ছে তো?

তখন চালেরও কর্ডনিং ছিল। ধানকলগুলিকে লেভি দিতে হত। এক জন মোটাসোটা ইন্সপেক্টর আসতেন মাঝে মাঝে, উনি এলেও গদিঘরেই থাকতেন। ইন্সপেক্টর সাহেব এলেই আর এক জনকে আসতে দেখতাম, তাঁর নাম ইদ্রিস। ইদ্রিস আর ইন্সপেক্টর সাহেবের মধ্যে একটা রহস্য-নিবিড় সম্পর্ক ছিল। ওরা দুটিতে গুটিগুটি দূরে চলে যেত, আম বা

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

আমড়াতলায় দাঁড়িয়ে কথা বলত, বুঝতাম, ধানকল বা হাস্কিং মিলগুলির লেভি সম্পর্কিত নীতি নির্ধারিত হচ্ছে।

গ্রামটার নাম ভেদিয়া, কলকাতা থেকে বোলপুর যেতে হলে বোলপুরের ঠিক আগের স্টেশন। ইন্সপেক্টর সাহেবের নামটা আজ মনে নেই আর, কিন্তু ইদ্রিসকে মনে আছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে ইদ্রিসের কোনও সম্পর্ক ছিল না। ইদ্রিসের মাইনে বা কমিশন ইন্সপেক্টর সাহেবই দিতেন। সাহেব এলে ইদ্রিস নীতিনির্ধারক মিটিং ছাড়াও সাহেবের মাথা মাসাজ করে দিত, শীতকালে গায়ে তেল মাখিয়ে দিত। আর, ইদ্রিসের একটা খাতা ছিল, ওটা দেখতেন সাহেব। তারাপদবাবু ওকেও বলতেন— কী স্যর, কাজ এগুচ্ছে তো?

ইন্সপেক্টর সাহেবের হয়ে মিল পরিদর্শন বাপারটা ইদ্রিসই করে রাখত। আর পরিদর্শনের রিপোর্ট চার নম্বরের হাতি মার্কা খাতায় ইদ্রিসই লিখে রাখত, এবং আমড়াতলার মিটিঙে পরবর্তী ‘নেসেসারি অ্যাকশন’ স্থির হত। সাহেবের মাসে দু’বারের বেশি আসতে হত না, সাহেব ওঁর স্বীয় বাসভবনেই পারিবারিক সঙ্গসুখ উপভোগ করতেন।

ইদ্রিস ওই গাঁয়েরই লোক। বছর ত্রিশেক বয়স তখন ওর। আমার সঙ্গে দেখা হত, ভাবও হল। যদিও ওর চাল সম্পর্কিত সংবাদ গুপ্তই রেখেছিল আমার কাছে। ও বলত, ‘নিস্পেক্টারি তো আমার পাট্টাইম কাজ স্যার, মেন কাজ তো ডাক্তারি।’

চমকে উঠেছিলাম। ডাক্তারি? কী ডাক্তার তুমি?

— মানুষ-জানোয়ার-ছাগল-পাগল সব কিছুর।

ক্রমশ জানতে পারলাম ও খাসি হাজাম। মানে, কচি পাঁঠার অণ্ডকোষ বের করে নিয়ে খাসি করে। এঁড়েকে হেলে করে। তখন এ সব কর্ম করার জন্য ইম্যাসকুলেটর-এর প্রয়োগ ছিল খুব কম। ক্ষুর-নরুন দিয়েই করতে হত। গরুর বাঁটফুলো রোগের চিকিৎসায় পারদর্শী ছিল। এক বার বার্ড ফ্লু রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল, রেডিয়োতে বলত ‘বার্ড ফ্লু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার’। লোকমুখে ওটা বার্ড ফুলু হয়ে বাঁটফুলোয় পরিণত হল। ইদ্রিস আমাকে বলেছিল, ব্যাপারটা বুঝতে পারছিনে স্যার। মুরগির কী করে বাঁটফুলো রোগ হবে!

ইদ্রিস মানুষ ও শুয়োরের বাচ্চাদের কৃমি বের করার জন্য একই শিশুতোষ বড়ি দিত। আবার স্বামীকে বশে রাখার জন্য পানিপড়া, আর বউদের বশে রাখার জন্য সিঁদুরপড়াও দিত। কারুর জিন-পরি-ভূত-পেত্নির ভর হলে কাগজে দোয়া লিখে তাবিজ বানিয়ে দিত। আবার পিঠ ব্যথা হলে একটা থালায় মন্ত্র পড়ে পিঠে বসিয়ে দিত, ব্যথার বিষ টেনে নিয়ে থালাটা নিজেই খসে পড়ত।

ইন্সপেক্টর সাহেবের পিঠে থালা বসিয়ে এক দিন আমাকে চাক্ষুষ দেখাল ইদ্রিস। নুদুস ইন্সপেক্টর সাহেবের পিঠে আটকে কাঁসার থালা। সাহেব বসে আছেন, থালাটা পড়ছে না। মিনিট খানেক পরে থালাটা আলগা হয়ে গেল। ইদ্রিস জিজ্ঞাসা করল, ব্যথাটার ইলাজ হল না স্যার? স্যর বললেন— ট্রেনে পাঁচ ঘণ্টা বসে পিঠটা ধরে গেস্লো, এখন আরাম লাগছে।

ইদ্রিস আমাকে এক বার বলল, আপনি তো মাঝে মাঝেই কলকাতা যান, আমার জন্য একটা বই আনতে পারবেন? স্বপন পান্ডে বিরচিত সচিত্র অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা। আমি বলি, আবার অ্যালোপাথি কেন, বেশ তো কবিরাজি চলছিল। ও বলল কবিরাজি ঠিকই আছে, বাংলার গাছগাছড়া কথা বলে, কিন্তু সেই সঙ্গে একটু অ্যালোপাথিও শুরু করে দেব স্যার। সব বিদ্যাই জেনে রাখা ভাল। এনে দিলাম, ওর পছন্দ হল না। বলল, সচিত্র লেখা আছে, কিন্তু চিত্র কই? কোক শাস্তরে এর চেয়ে ভাল ভাল চিত্র থাকে।

ছুটিতে বাড়ি গিয়ে পিঠে থালা বসানোটা আমার করায়ত্ত হল। থালার পিছনটা একটু অবতল (convex) মতো থাকে। সামনে চাপ দিয়ে সমান করে নিয়ে কোনও মসৃণ পিঠে চেপে দিলে বাতাসের চাপেই আটকে থাকে। আমার বাবার পিঠে আটকে দিলাম।

ইদ্রিসের পিঠটাও চর্বিপ্রলেপিত মসৃণ। আমি ইদ্রিসকে বললাম, এত লোক ঠকিও না। দ্যাখো, তোমার পিঠে থালা বসিয়ে দিচ্ছি। এবং সত্যিই ওর পিঠে থালা বসিয়ে দিলাম। ঠিক সেই সময় তারাপদবাবুর প্রবেশ। উনি আশ্চর্য। কী? ব্যাপারটা কী?

ইদ্রিস বলল, এই স্যারটা আমার থেকে একটু কাজ শিখছেন আর কী...।

ক’দিন পর তারাপদবাবু নিয়মমাফিক জিজ্ঞাসা করলেন, কাজ এগুচ্ছে তো স্যর?

swapnoc@rediffmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement