রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

মিটিয়োরলজিকাল অফিস বা হাওয়া অফিসে আজকাল ‘চার্টিং’ প্রায় উঠেই গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে টেলিপ্রিন্টারের সংখ্যার সাংকেতিকে আবহাওয়ার তথ্য আসত, বিলি হত বিভিন্ন টেবিলে, যেখানে বিছিয়ে রাখা আছে বিশ্ব মানচিত্র, ‘কোড’-এ আসা তথ্যগুলি ‘ডিকোড’ করে বিভিন্ন প্রতীকে বসাতে হত ম্যাপে। এটাই চার্টিং। পরে বিশ্লেষণ করতেন আবহাওয়াবিদরা। এখন তো সবই কম্পিউটারেই হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৪ ০০:০০
Share:

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

Advertisement

মিটিয়োরলজিকাল অফিস বা হাওয়া অফিসে আজকাল ‘চার্টিং’ প্রায় উঠেই গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে টেলিপ্রিন্টারের সংখ্যার সাংকেতিকে আবহাওয়ার তথ্য আসত, বিলি হত বিভিন্ন টেবিলে, যেখানে বিছিয়ে রাখা আছে বিশ্ব মানচিত্র, ‘কোড’-এ আসা তথ্যগুলি ‘ডিকোড’ করে বিভিন্ন প্রতীকে বসাতে হত ম্যাপে। এটাই চার্টিং। পরে বিশ্লেষণ করতেন আবহাওয়াবিদরা। এখন তো সবই কম্পিউটারেই হয়।

যখন ওই দফতরে চাকরিতে ঢুকলাম, আমাকে চার্টিং শিখিয়েছিলেন শশাঙ্ক চক্রবর্তী। উনি বলেছিলেন সবই নম্বরের খেলা রে ভাই। সাট্টা বল, সংবিধান বল, ওয়েদার বল, সব। পেনাল কোড-এ ৩৭৬ আর ৩৭৭-এর মধ্যে ব্যাশ-কম আছে। তেমন ওয়েদার কোড-এর ৬২ আর ৬৩-র মধ্যেও ব্যাশ-কম আছে। টাকের মধ্যে দুই ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল, মুইচ্ছা নিল, এইটার কোড ৫৫, আর ‘আজনবি’ সিনেমায় যে বৃষ্টিতে রাজেশ খন্না আর জিনত আমন ‘ভিগি ভিগি রাতোঁ মে’ গান করতে করতে নাচে, সেইডা হইল ৬৫-এর বৃষ্টি। সংখ্যা দিয়ে যে কোনও জায়গাও বুঝান যায়। ৪২৮০৭ মানে কলকাতা। হয়তো ৩৭৪০ মানে লাসা। ধর আইছে ৪৩০০৩/ ২৭০০৬/ ১০০০ বুঝবা বোম্বে শহরে পশ্চিমা হাওয়া, ছয় নটিকাল মাইল স্পিড, বাতাসে ধূলাবালি... সব শিখামু।

Advertisement

আনুষ্ঠানিক ট্রেনিংয়ের আগেই উনিই ছিলেন আমার ট্রেনার। নানা রকমের চার্টিং হয়। শশাঙ্কদা সারফেস চার্টিং করতেই পছন্দ করতেন। আমি ওঁর পাশে বসে থাকতাম। উনি চার্ট করতে করতে আবহাওয়া সম্পর্কিত মন্তব্যও করতে থাকতেন। এবং তখন বুঝেছিলাম উনি এক জন দেশপ্রেমিক। যেমন, পাকিস্তানের কোয়েটাতে ৮৬ স্নো-ফল। ট্যাম্পারেচার মাইনাস টেন। মিঞাগো ব্লাডারে তো বরফের চাক। প্যাচ্ছাব বন্ধ। হায় হায় রে, লাহোরে ৪৯ ফগ। কিছু দেখা যায় না। গাড়িগুলাইন ধাক্কাধাক্কি কইরা মরুক গিয়া। শারজায় ৪৬ ডিগ্রি। ইন্ডিয়া ক্রিকেট টিম হাইরা গিয়া ঘরের পোলারা ঘরে ফিরা আসছে। বেশ করছে। পাকিস্তান-সাউথ আফ্রিকার ফাইনাল। অরা এক্কারে হত্তুকি হইয়া গেছে গা।...শুকাইয়া কিশমিশ। আরে, নানকিন্-এ হ্যারিকেন। সবার হাতে হ্যারিকেন, ...বাঁশ।

ওঁর ধারাবিবরণী-সম্পৃক্ত চার্টিং যদি সিনেমায় শ্যুট হত, সেন্সর বোর্ড অনেক কথাই বিপ্ করে দিত। কান্দাহারে ডেন্স ফগ প্লাস ডাস্ট স্টর্ম। ভিজিবিলিটি ০১০। সকালে বালির উপর কী যে ত্যাগ করল, বুঝতেই পারল না রে...।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম শশাঙ্কদা, এত রসেবশে থাকেন কী করে এই বয়সে? শশাঙ্কদা বলেছিলেন রস? তবে কই। কাঠের জ্বালের রান্না দ্যাখছ? উননের তলে চ্যালা কাঠ ভইরা দেয়, কাঠ পুড়তে পুড়তে যত ছোট হইতে থাকে, দেখবা, কাঠের পুঁয়া দিয়া বিজবিজ কইরা রস বাইর হয়। আমার হইল সেই রস। আই এ্যাম নাও ফিফটি সেভেন। রিটায়ারের টাইম আইস্যা গেল। তিরিশ বছর ধইরা চার্টিং করলাম। পোড়া কাঠের শ্যাষ রসগুলি বাইর হইতাছে, বোঝলা?

শশাঙ্কদা রিটায়ার করেছিলেন। আমিও ওই চাকরিটা ছেড়ে নতুন চাকরিতে ঢুকলাম।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

অনেক দিন পর হাওয়া অফিসের এক পুরনো সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হল আমার। যা হয়, পুরনো স্মৃতির জাবর কাটা। শশাঙ্কদার কথাও উঠল। আমরা ঠিক করলাম শশাঙ্কদার সঙ্গে দেখা করতে যাব।

গেলাম। ওঁর ছেলে বলল, বাবাকে নিয়ে মুশকিল হচ্ছে খুব। এখন ছিয়াশি বছর বয়স। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে কী-সব সংখ্যা বলেন শুধু, ডাক্তারও বোঝে না, আমরাও বুঝি না।

আমরা আমাদের পরিচয় দিলাম। চিনতে পারলেন মনে হল। জিজ্ঞাসা করলাম খবর কী? উনি কতগুলি সংখ্যা বলে গেলেন। আমার বন্ধু ডিকোড করছিল। ‘আকাশ থমথমে, হাওয়া নেই। চল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ছিয়ানব্বই পার্সেন্ট।’ মানে প্যাচপ্যাচে গরম আর কী। বললেন এখন দরকার কী জানো? এইট অক্টা সি বি। ৬৫ টি এস। মানে হল আকাশ জুড়ে বজ্রগর্ভ মেঘ এবং বজ্রবিদ্যুত্‌। বললেন, কেন জানো? বলেই আবার কতগুলি সংখ্যা। ৮৯৪৪৩/ ৫২১৯৯...বলতেই থাকলেন। আমি আমার মতো ডিকোড করলাম বাংলার সৌভাগ্য-সূর্য অস্তাচলগামী। কে তাকে ভরসা দেবে? আকাশ থমথমে। আকাশে বজ্রমেঘ, অথচ বজ্রপাত হচ্ছে না।

আমি বলি, শশাঙ্কদা, দেশের অবস্থা ছাড়ুন। আপনি কেমন আছেন তাই বলুন।

আবার কতগুলি সংখ্যাই বললেন। বিপি ৯৫/ ২০০, পিপি ৩০০, এইচ বি ০৯...

এ সব কিছুটা বুঝলাম তবু। ব্লাডপ্রেশার, সুগার, হিমোগ্লোবিন এ সব বলছেন। বুঝলাম শরীর সুবিধার নয়।

বললেন চ্যালা কাঠটা পুইড়াও পোড়ে না। অখনও একটু একটু রস বাইর হয়, আর কয় কবে আসবে ৪৩৩২১/ ১৭০১২...

বন্ধুটি বলল ছেঁড়া মেঘভাসা নীল আকাশ আর শীতল দক্ষিণা বাতাসের কথা বলছেন শশাঙ্কদা।

swapnoc@rediffmail.com

পিনাকী ভট্টাচার্য

কোফ্তা হচ্ছে ভেড়া বা গরুর মাংসের কিমা দিয়ে তৈরি, পশ্চিম এশিয়া আর ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার। এতটাই জনপ্রিয়, শুধু তুরস্কেই ২৯১ রকমের কোফ্তা পাওয়া যায়। ‘কোপ্তা’ বা ‘কোফ্তা’ শব্দটার উত্‌স পারস্য শব্দ ‘কোফ্তে’ থেকে, যার মানে মাংসের কিমার মণ্ড বা গোলা। তবে কোফ্তা নামকরণের অনেক আগে থেকেই এই বিশেষ পদটা বিশ্বের নানান রান্না-ঘরানায় চার-ছয় মেরেছে। কোফ্তা যে ভেড়া, শুয়োর, গরু, বা কোনও চারপেয়ের মাংস ছাড়া বানানো যায় না, এই মতামত তৈরি হওয়ার অনেক আগে থেকেই কোফ্তা রান্না হচ্ছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। ২৫ খ্রিস্টাব্দে মার্কাস গাভিয়াস আপিসিয়াস-এর রোমান ভাষায় লেখা প্রাচীন রেসিপি বইয়ে কোফ্তার মতো পদের বিবরণ আছে কিন্তু সে সময় এই রান্নার জন্যে সেরা মাংস ধরা হত ময়ূরের মাংসকে। তার পরের পছন্দের বাছাই ছিল যথাক্রমে পায়রা, খরগোশ আর মুরগির মাংস। শুয়োরের মাংসের স্থান ছিল তার পরে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোফ্তা রান্নায় রেড-মিট প্রায় আবশ্যক হয়ে যায়। তার একটা বড় কারণ যদিও এই বাসি আর উদ্বৃত্ত মাংস দিয়ে কোফ্তা বানিয়ে ফেলে সাশ্রয় করা একটা সহজ পন্থা ছিল। এ ছাড়াও মাংসের মণ্ডের সঙ্গে সবজি আর মশলার ব্যবহারে মাংসের পরিমাণটাকে বেশ ওজনদার দেখাত। সব মিলিয়ে কোফ্তা গৃহস্থের হেঁশেলে এক নিয়মিত খাবার হয়ে দাঁড়াল।

অন্ধকার যুগে স্পেনে যখন খ্রিস্ট-মতাবলম্বীদের সংখ্যা তরোয়ালের জোরে বাড়ানো হচ্ছে, ধর্মান্তরিত না হলে মাথার ওপর নেমে আসছে কঠিন শাস্তি, ইহুদিরা প্রবল চেষ্টা করত নিজেদের ধর্ম গোপন করে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের দলে মিশে গিয়ে গা-ঢাকা দেওয়ার। সেই সময় স্পেনের রাজন্যবর্গের আর ধর্মগুরুদের কাছে কোফ্তা এক ধরনের লাই-ডিটেক্টর হয়ে উঠেছিল। সে দেশের রাজা ভোজনসভার ব্যবস্থা করতেন আর সেই ভোজনসভায় আমন্ত্রিত প্রজাদের উপস্থিতি আবশ্যক ছিল। বিভিন্ন পদের সঙ্গে সেখানে শুয়োরের মাংস দিয়ে বানানো কোফ্তাও পরিবেশন করা হত। খাওয়ার শেষে আমন্ত্রিতদের ধন্যবাদ জানানোর সঙ্গে সঙ্গে যে পদগুলো পরিবেশন করা হয়েছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করা হত। কোফ্তা বানানোর বর্ণনা শুনে ইহুদিরা স্বাভাবিক ভাবেই তাদের ধর্মের নিষিদ্ধ মাংসের ও রকম বিবরণ শুনে ওয়াক ওয়াক করে বমি করতে দৌড়ত আর তখনই গ্রেফতার করে তাদের কঠিন শাস্তির সামনে ফেলা হত। এই শনাক্তকরণ পদ্ধতি এড়াতে যারা এই রাজভোজে সাড়া দিত না, তারা স্পেনীয় রাজন্যবর্গের কাজ আরও সহজ করে দিত কারণ রাজার আদেশ ছিল এই ভোজে যারা আসবে না তাদের ইহুদি বলে শনাক্ত করা হবে আর তাদের ওপর নেমে আসবে শাস্তির খাঁড়া।

সুইডেনে কোফ্তার কথা প্রথম পাওয়া যায় ১৭৫৪ সালে কাজ্‌সা ওয়ার্‌গ-এর লেখা রান্নার বইয়ে, যেখানে তিনি কোফ্তার সঙ্গে মাখন-সিক্ত নুডল্‌স মেশাবার নিদান দেন। রান্নার বইটা এতটা জনপ্রিয় হয়েছিল, ওই দেশে কোফ্তা খুব জনপ্রিয় পদ, আর কোফ্তার সঙ্গে মাখন মাখা নুডল্‌স্‌ খাওয়া আজ প্রায় আবশ্যক।

ভারতীয় হেঁশেল, সে যতই আমিষ-বিমুখ হোক, কোফ্তা-বিমুখ কিন্তু এক্কেবারেই না। যার জন্যে শুধু এই দেশেই পনির থেকে শুরু করে কাঁচকলা সব কিছুরই কোফ্তা হয়!

pinakee.bhattacharya@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement