পোস্ট-মডার্নিজমের কী দাপট! সমার্থশব্দকোষ অলরেডি গোল্লায়, মধ্যশিক্ষা পর্ষদও উঠল বলে। এখন ‘কোদালকে কোদাল’ বলার পাট চুলোয় গেছে, সবই ইন্টারপ্রিটেশন। রামপ্রসাদী যুগে সর্বপ্রথম কোদালকে কোদণ্ড বলা চালু হয়। তখন একে আর্ষ প্রয়োগ বলা হত, এখন নাম ফ্রয়েডিয়ান স্লিপ। এখন মেল্টিং পট মানে আমেরিকা, উন্নয়ন মানে শপিং মল, ভাই মানে মস্তান, গরু মানে মা, জাতীয় ভাষা দেবনাগরী, দেবভাষা ইংরিজি। আগে হাইফান্ডা জিনিস বলতে আগমার্কা বামপন্থা বোঝানো হত, আঁতেল নাম বলতে ‘প্রগতি’, ‘স্ফুলিঙ্গ’। এখন ইন-থিং বলতে সাবঅল্টার্ন, হাতে তাগা-তাবিজ লাগিয়ে স্লিভলেস জামা পরে হনুমান চালিসা পাঠ করাকে আমরা এথ্নিক বলি, আভাঁ-গার্দ লিট্ল ম্যাগের নাম হয় অনার্য কিংবা জাম্বুবান। আগে মার্ক্সবাদকে গ্লোবাল ল্যাংগোয়েজ বলা হত, বিশ্ববিপ্লবকে ভবিতব্য। এখন গ্লোবালাইজেশনের পরে চিনেরা বিপ্লব বলতে সস্তার খেলনা বানানো বোঝে, আর আমেরিকানরা বহির্বিশ্ব বলতে এলিয়েন। ভাষার এই দুর্বোধ্যতা আন্দাজ করে বহু আগে থেকেই নোবেল কমিটি শুধু পশ্চিমি ভাষাতেই সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ দিচ্ছে। আগে একে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ বলা হত, এখন নতুন নাম পোস্ট-কলোনিয়ালিজ্ম।
এখন বানান ভুলের ইংরিজি ‘টাইপো’, বেসুরো-গানের ‘রক’। চড় মারার ইংরিজি অ্যাটেম্পট-টু-মার্ডার, গণপিটুনির তৎসম ক্ষমাপ্রদর্শন। তিন দিন আগে পর্যন্ত উপাচার্য শব্দরূপ ছিল ভিনি-ভিডি-ভিসি, এখন হয়েছে এলাম-দেখলাম-ল্যাজ গোটালাম। এই যে লেখা পড়ছেন, চল্লিশ বছর আগে একে বলা হত পল্লবগ্রাহী পিছনপাকামি, এখন এর নাম হয়েছে ইন্টারডিসিপ্লিনারি। আগে বোম মেরে আস্ত জনপদ উড়িয়ে দেওয়াকে বলা হত ‘মারি তো গন্ডার’, এখন প্রথম বিশ্বের ইংরিজিতে তাকে বলে স্যানিটাইজ, মতান্তরে নিউট্রালাইজ। আর এক-আধটা খুচরো লোককে পিছন থেকে গুলি করে মারার ইংরিজি এনকাউন্টার। এ অবশ্য তৃতীয় বিশ্বের ভোকাবুলারি, কিন্তু পোস্ট-মডার্ন পণ্ডিতরা হেবি আহ্লাদিত, প্রথম বিশ্বের শব্দভাণ্ডারে তৃতীয় বিশ্ব এখন দুদ্দাড় এনকাউন্টার করে দিচ্ছে। আমেরিকাতেও পুলিশ বারো বছরের বাচ্চাকে গুলি চালিয়ে খতম করছে, প্রকাশ্যে গলা টিপে মারছে রাস্তার সিগারেট-বিক্রেতাকে এবং তৃতীয় বিশ্বের ভাষায় একে তারা সেল্ফ-ডিফেন্স বলছে। সে নিয়ে পথ-অবরোধ, কলরবও হচ্ছে বিস্তর। তবে এ সব ব্যাপারে এখনও তৃতীয় বিশ্ব স্লাইট এগিয়ে বলে, হলিউড এখনও পথে নামেনি, আর আমেরিকার বুদ্ধিজীবীরা ‘আমরা সবাই খুনি’ পোস্টার নিয়ে মিছিল করছেন না, এই রক্ষে। সেটা হয়ে গেলেই পোস্ট-মডার্ন দুনিয়ায় ষোলো কলা পূর্ণ। তখন বিশ্ব জুড়ে চুরি-চামারি-খুনকে সার্ভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট এবং পুলিশে ধরলে তাকে কেন্দ্রের চক্রান্ত বলা চালু হবে। আর পোস্ট-মডার্ন তাত্ত্বিকরা দাড়ি চুমরে বলবেন, চিন্তার কী আছে, অর্থের কোনও অনর্থ হয় না, অর্থ অসীম সম্ভাবনাময়, যখন-তখন বেড়াল রুমাল হয়ে গেলে তাকে হযবরল নয়, দিফারঁস বলা অভ্যেস করুন, বাকিটা এমনিই হয়ে যাবে।
bsaikat@gmail.com