পা ন্তা ভা তে...

আমি সামনাসামনি এত হ্যান্ডসাম পুরুষ প্রায় দেখিইনি বলতে গেলে। উত্তমকুমারকে এত সুন্দর দেখাত, কোনও পুরুষও তাঁর সৌন্দর্যকে ইগনোর করে চলে যেতে পারত না। আর, তেমনি ছিল তাঁর ব্যবহার। আমার সঙ্গে উত্তমকুমারের ভাল করে আলাপ হয় ‘কিতাব’ বলে সিনেমাটা তৈরি করার সময়। তার আগে ‘নায়ক’ দেখেছি। অসিত সেন-এর ‘জীবন তৃষ্ণা’ দেখেছি। হিরোর মতো হিরো, আবার আলাপ হওয়ার পর, বেশ কাছের মানুষ মনে হত।

Advertisement

গুলজার

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

আমি সামনাসামনি এত হ্যান্ডসাম পুরুষ প্রায় দেখিইনি বলতে গেলে। উত্তমকুমারকে এত সুন্দর দেখাত, কোনও পুরুষও তাঁর সৌন্দর্যকে ইগনোর করে চলে যেতে পারত না। আর, তেমনি ছিল তাঁর ব্যবহার।

Advertisement

আমার সঙ্গে উত্তমকুমারের ভাল করে আলাপ হয় ‘কিতাব’ বলে সিনেমাটা তৈরি করার সময়। তার আগে ‘নায়ক’ দেখেছি। অসিত সেন-এর ‘জীবন তৃষ্ণা’ দেখেছি। হিরোর মতো হিরো, আবার আলাপ হওয়ার পর, বেশ কাছের মানুষ মনে হত।

আমি যেহেতু প্রায় বাঙালি, তাই অনেক দিন ধরেই মনে একটা লুকনো ইচ্ছে ছিল উত্তমকুমারকে নিয়ে একটা সিনেমা করব। লুকনো বটে, কিন্তু ইচ্ছেটা খুব তীব্র। বলিউডে জীবন কাটিয়েও কোনও দিন দিলীপকুমারকে নিয়ে সিনেমা করার ইচ্ছে হয়নি, কিন্তু প্রায়ই ভাবতাম, ইস, উত্তমকুমারকে হিরো করে যদি ছবি করতাম!

Advertisement

‘কিতাব’ সিনেমাটা যখন তৈরি করব ভাবলাম, প্রথম মনে এল উত্তমকুমারের নাম। ফোন করলাম ওঁর সেক্রেটারিকে। দু-চার কথা হওয়ার পর উত্তমকুমারজি ফোন ধরলেন। কথা বলেই এত ভাল লাগল! বললেন, ‘স্ক্রিপ্ট পাঠান।’ দু-তিন সেকেন্ড চুপ। তার পর বললেন, ‘আচ্ছা, আমি আপনার সিনেমাটা করব।’ আমি তো আনন্দে আত্মহারা। এত ভদ্রলোক আমি কম দেখেছি। কোনও হিরো-সুলভ ট্যানট্রাম নেই। আমার কাছে ওটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া— কিছু প্রায় না জেনেই উনি রাজি হলেন আমার সিনেমাটা করতে।

শুটিং-এর সময় দেখেছি, অসম্ভব পাংচুয়াল। সারা ক্ষণ নিজের রোল রিহার্স করছেন। গল্প করলে বেশ মেজাজে গল্প করে যেতে পারতেন। কিন্তু কোনও দিন কারও সম্পর্কে একটাও বাজে কথা বলতে শুনিনি। একটা ঘটনা বলি। এক দিন গল্প করতে করতে অসিত সেনের প্রসঙ্গ উঠল। আমি বলাম, ‘উত্তমকুমারজি, দীপ জ্বেলে যাই সিনেমায় আপনাকে যে এক বারও দেখানো হল না, অথচ আপনি গানটার সঙ্গে কী ভাল অভিনয় করে গেলেন, তা-ও ক্যামেরায় কেবল আপনার ব্যাকসাইডটা দেখা গেল!’ উনি একটুও উত্তেজিত হলেন না, কেবল মৃদু হেসে বললেন, ‘ওটা তো আমি ছিলাম না, অসিত সেন নিজেই ওই অভিনয়টা করেছিলেন।’ অথচ বাংলার সবচেয়ে বড় সুপারস্টার তিনি— খুব চটেমটে বলতেই পারতেন, ‘না জেনে কথা বলছেন কেন? ওটা আমি?’ সে সবের ধার দিয়েই গেলেন না, আমার এই ভুলটা নিয়ে মাথা ঘামালেন না, রাগারাগি করলেন না।

ওঁর স্বভাবের মধ্যে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ছিল। পরদায় যাঁকে দেখে মনে হত ছোঁয়া যাবে না কোনও দিন, এক জন ঈশ্বর, সামনাসামনি গল্পের সময়, ঠাট্টা-তামাশার সময়, তাঁকে দেখেই মনে হত— আরে! এ তো যে কোনও সময় আমায় জড়িয়ে ধরে কথা বলতে পারে! আমি এটা বলতেই পারি, সুচিত্রা সেন-এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক আরও অনেক কাছের ছিল। কিন্তু কোনও দিন সুচিত্রা সেনের সঙ্গে খুব সহজে মিশব, যা ইচ্ছে গল্পগাছা করব, এটা ভাবতে পারতাম না। হাসিঠাট্টা সবই হত, কিন্তু একটা দূরত্ব ছিল। কিন্তু উত্তমকুমারজির সঙ্গে সেই দূরত্বটা ছিল না। ওঁর মধ্যে কী রহস্য ছিল, উনিই জানেন।

আর এই রহস্যটাই ওঁকে একটা আলাদা ক্লাসের মানুষ করে রাখত। ওঁর রূপ, ওঁর অভিনয় দেখে তো হরবখত মুচ্ছো যেতই লোকে। কিন্তু অফ-স্ক্রিন ক্যারিশ্মাও কিছু কম ছিল না। এটা চেষ্টা করে হয় না। মানুষের প্রতি জেনুইন ভালবাসা না থাকলে, মানুষের ভালমন্দে সত্যিকারের আগ্রহ না থাকলে, সকলের সঙ্গে অমন মাইডিয়ার ব্যবহার করা যায় না।

তবে অবশ্যই নিজেকে মেজেঘষে তৈরি করেছিলেন অনবদ্য স্টাইল। কোনও ফ্যান অনেক বার করে ওঁর সিনেমা দেখে, উচ্চারণ নকল করে, সিগারেটটা ওঁর ঢঙে খেয়ে স্মার্ট সাজতে পারে, কিন্তু ওঁর মতো নিজেকে ক্যারি করতে পারবে না। অথচ কী অসম্ভব সাবলীল! শুটিং-এর পর সকলের সঙ্গে বসে গল্প করছেন, এমনিই চেয়ারে এলিয়ে বসে আছেন, হা-হা করে হাসছেন, কিন্তু ভাবভঙ্গির মধ্যে হিরোয়িক টাচ অ্যাক্কেবারে ষোলো আনা। কেউ ডাকলে, যে ভাবে চোখ তুলে তাকাতেন, মনে হত যেন রিহার্সড। কিন্তু সেটা এক সেকেন্ড। তার পরেই মনে হবে, এত স্বতঃস্ফূর্ত কিচ্ছু এ পৃথিবীতে দেখিনি!

তবে বলিউডে ওঁর মতো বড় মাপের এক জন তেমন জায়গা করতে পারলেন না, এটা দুঃখের। আমার মনে হয় ভাষার প্রবলেমটা একটা বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হিন্দি ডিকশন-এ কিছু সমস্যা ছিল ওঁর। আমার সিনেমার জন্য তেমন কিছু প্রয়োজন ছিল না, তাই আমি আলাদা করে কিছু বদলাইনি। কিন্তু ওঁর প্রচণ্ড অধ্যবসায় তো আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, তাই আফশোস হয়, কেউ যদি ওঁকে ঠিক ঠিক গাইড করত, একটু যত্ন করে হিন্দির থ্রো, কোন শব্দে কোথায় জোর, এগুলো শেখাত, উনি ক্লাসের এক জন ছাত্রের মতোই সেটা মন দিয়ে শিখে নিতেন। তা হলে, ন্যাশনাল স্টার হওয়াটা ওঁর কাছে কোনও ঘটনাই ছিল না। হিরোর মতো চেহারা আর অভিনয়— দুটোই তো ছিল। আর, যা লোককে ডোবায়, সেই অহেতুক ইগো কক্ষনও ছিল না ওঁর।

একটাই আক্ষেপ, বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। কিতাব-এর শুটিং-এর কিছু আগেই ওঁর হার্টের কিছু সমস্যা হয়েছিল। কিন্তু সেটে ওঁকে দেখে সেটা বোঝার উপায় ছিল না। খুব ফিট লাগছিল। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘আপনাকে কিন্তু বেশ হেলদি লাগছে।’ বললেন, ‘হ্যাঁ আমি সুস্থ থাকতে ভালবাসি। আই লিভ হেলদি অ্যান্ড আই ওয়ান্ট টু ডাই হেলদি।’

এ কথা সত্যি, সব অর্থেই একটা দুর্দান্ত হেলদি কেরিয়ারের একেবারে তুঙ্গে থাকার সময় হুট করে চলে গেলেন, একদম মহানায়কের মতোই। কিন্তু, আর কয়েকটা সিন থাকলেও তো পারতেন, অত বড় একটা মানুষের কাছে আর কয়েক রিল দাবি কি আমাদের ছিল না?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement