রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের বড় ছেলে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। জীবনের শেষ আট বছর তিনি ছিলেন শান্তিনিকেতনের রসগুঞ্জনের অবিসংবাদিত খলনায়ক। জীবন-সায়াহ্নে নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে-ছুড়ে, সুদূর দেহরাদূনে ঘর বেঁধেছিলেন তিনি। বন্ধুপত্নীর সঙ্গে।
প্রশাসনিক নানা জটিলতায় শান্তি ছিল না রথী ঠাকুরের। স্ত্রী প্রতিমা দেবীর সঙ্গে সম্পর্কেও হয়তো কোনও উত্তাপ অবশিষ্ট ছিল না। ১৯৫৩ সালের অগস্টে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যান রথী ঠাকুর। সঙ্গে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরা। তাঁর আদরের ‘মীরু’! এর ঢের আগেই অবশ্য মীরার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা নিয়ে কানাকানি চরমে ওঠে। উপাচার্য থাকতেই বন্ধুপত্নী মীরা চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে হাজারিবাগ গিয়েছিলেন, সেই হাওয়া-বদল সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেয় শান্তিনিকেতনে। আবার উপাচার্যের লেটারহেডেই এক বার মীরা দেবীকে চিঠিতে লিখছেন: ‘ডাক্তার বাবু বলেছিলেন আজ sponging নিতে। সুপূর্ণা ঠিক পারে না— তাই তোমার যদি অসুবিধা না থাকে তবে কি একবার ১১টার কাছাকাছি এসে এটা করতে পারবে?’ এই প্রস্তাব একটু বিসদৃশ ও অস্বস্তিকর, হয়তো এই অনুমানেই চিঠির মাথাতেই ফের লিখে দিচ্ছেন: ‘যদি অভ্যাস না থাকে তো জানিও— আমি নিজে ম্যানেজ করে নেব। সঙ্কোচ কর না।’ কিন্তু সঙ্কোচের বিহ্বলতা যে দুজনেরই এত দ্রুত ও এত দূর পর্যন্ত কেটে যাবে, মুখরক্ষাই দায় হবে শেষমেশ, তা ঠাকুরবাড়ির লোকজন ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেননি।
এ ঘটনার প্রসঙ্গেই রথীন্দ্রনাথের বোন মীরা ঠাকুর গঙ্গোপাধ্যায় মেয়ে নন্দিতা কৃপালনিকে চিঠিতে লিখেছিলেন: ‘বৌঠান আর আমি তাই বলি যে লোকের কাছে মুখ রক্ষার এই চমৎকার ব্যবস্থা করলেন। নিজে পালিয়ে গিয়ে তাঁকে ত আর সে-গুলো শুনতে হবে না যা হয় আমাদের হবে।’ রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রতিমা দেবীও লিখছেন: ‘এত বৃদ্ধ বয়েসে শেষটা যে নিজেকে একটা এরকম উদ্দামতার মধ্যে নিয়ে ফেলবেন তা ভাবিনি।’ আর সমসময়েই, আত্মপক্ষ সমর্থনে ভাগ্নি নন্দিতাকে লিখছেন রথীন্দ্রনাথ, দেহরাদূন থেকে: ‘তোরা হয় তো অনেক গুজব শুনতে পেয়েছিস্— সব কথা সত্যি না জেনে হঠাৎ বিশ্বাস না করলে খুসী হব।’
গুজব আর সত্যের রহস্যময় আলো-আবছায়ায় ঘেরা রথীন্দ্রনাথের জীবনের এই অংশটি ধরতে ‘আপনি তুমি রইলে দূরে’ গ্রন্থে গুরুত্বপূর্ণ এই সব চিঠিপত্র সংকলন ও সবিস্তার আলোচনা করেছেন নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকী রথীন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘিরেও যে প্রশ্নের মেঘ জমাট বেঁধেছিল, সে প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। দেহরাদূনেই মারা যান রথীন্দ্রনাথ। ডেথ সার্টিফিকেট অনুযায়ী, মৃত্যু হয় অন্ত্রের সমস্যায়। কিন্তু তাঁর বোন মীরা ঠাকুর গঙ্গোপাধ্যায় মেয়েকে লিখছেন: ‘সময় মত রোগের চিকিৎসা করে নি তাও ত যে শুনছে সেই বলছে কিন্তু সত্যি কি ওরা কিছু খাইয়ে মেরে ফেলেছে? শেষকালে এই ছিল কপালে! ওদের সবই ত দিয়েছিলেন তবু প্রাণে মারল কেন?’
মীরা চট্টোপাধ্যায় ও রথীন্দ্রনাথের মধ্যে যে সম্পর্কই থাকুক না কেন, সম্ভবত তা শুরু থেকেই স্পষ্ট ছিল মীরার স্বামী নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। তাঁর কোনও বিরোধিতা ছিল বলেও মনে হয় না। তাঁর সংরক্ষণে থাকা একটি চিঠিতেই ‘মীরু’র উদ্দেশে ‘রথীদা’ নিজের তীব্র অনুভূতি উজাড় করে দিয়েছেন: ‘আমার কেবল মীরু আছে— সেই-ই আমার সমস্ত জগৎ ব্রহ্মাণ্ড।... তাকে আমার সবকিছু দিয়েছি— নিজেকেও সঁপে দিয়েছি।’ প্রথাগত প্র্যাকটিসে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাননি রথীন্দ্রনাথ। স্বভাবতই তাঁর বোন বা স্ত্রী কোনও দিনই তাঁর ‘মীরু’কে মেনে নিতে পারেননি। কখনও বলেছেন ‘কী ভয়ঙ্কর মেয়ে মানুষ’, কখনও শঙ্কিত হয়েছেন ‘বুড় বয়সের দুর্ব্বল মন, একেবারে মীরার কবলে তলিয়ে যাবেন।’ এ সব প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা আজ সম্ভব নয়। কিন্তু সন্দেহ নেই, ঠাকুরবাড়ির ঝকঝকে, পবিত্র-পবিত্র উঠোনে রথীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্যতিক্রমী। সমালোচিত হয়েও, স্বতন্ত্র।
susnatoc@gmail.com