ভারতবর্ষ বৈচিত্রপূর্ণ দেশ, এখানে নানা রকম খেলা হয়। যে খেলায় অংশগ্রহণই আসল, তাকে ছেলেখেলা বলা হয়, যেমন অলিম্পিক। সেখানে ইয়াব্বড় টিম বানিয়ে বিদেশ থেকে প্যাকেজ টুরে ঘুরে এলেই হল, পদক জেতা বাধ্যতামূলক নয়। কোনও কোনও ছেলেখেলায় আবার অংশগ্রহণ করারও দরকার পড়ে না, যেমন বিশ্বকাপ ফুটবল। চার বছর অন্তর ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনাকে ‘আমাদের টিম’ বানিয়ে রাস্তার ধারে পতাকা ওড়ালেই ল্যাঠা খতম। একে বলে সকারের বাইরে থেকে সমর্থন, মতান্তরে মায়ার খেলা। কিছু খেলা সংসদীয়, যাকে ঘোড়া-কেনাবেচা বলা হয়। কিছু কিছু খেলা গণতান্ত্রিক, যেমন ভারতের ডেভিস কাপ, সেখানে খেলোয়াড়রা যা চায় তা-ই হয়। কিছু খেলা গা-জোয়ারি, যেমন দোল। সেখানে যাকে-তাকে ধরে মুখে কালিঝুলি মাখিয়ে দিতে হয়। আর যে খেলা ঠিক খেলা নয়, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষাৎ মাসতুতো ভাই, তার নাম ক্রিকেট। সে খেলায় মাঠের মধ্যে খিস্তি করতে হয়, যাকে ইংরেজিতে স্লেজিং এবং বাংলায় নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসন বলে। কিছু ক্রিকেট ম্যাচ তো একেবারে হাতাহাতি যুদ্ধ, যেমন ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ, সে হল মিনি কারগিল। দেশের মধ্যে হলে এই ম্যাচে পিচ খুঁড়ে দিতে হয়। অস্ট্রেলিয়ায় হলে ম্যাচের বাইরে মারপিট করতে হয়, যে কারণে একে ভদ্রলোকের খেলা বলা হয়। ইংল্যান্ডের মাঠে ভারতের পতাকা নিয়ে ঘুরলে তাকে গণতান্ত্রিক অধিকার বলে, ভারতের মাটিতে আর্জেন্টিনার জার্সি পরে ঘুরলে তাকে বলে ক্রীড়াপ্রেম। কিন্তু পাক-ভারত ম্যাচ দেশপ্রেমের একেবারে পরাকাষ্ঠা বলে ভারতের মাটিতে বসে পাকিস্তানকে কিংবা পাকিস্তানের মাটিতে বসে ভারতকে সমর্থন করলে, তাকে দেশদ্রোহিতা বলা হয়। এ হেন দেশবিরোধীদের ধরতে পারলে পড়শিরা ঠ্যাঙায়, পুলিশ পারলেই জেলে পোরে, পিতৃদেবের নাম হয়ে যায় খগেন।
ভারতীয় উপমহাদেশ দেশপ্রেমের জন্য বিখ্যাত, যে কারণে এত বৈচিত্রের মধ্যেও এ দেশের সেরা খেলা ক্রিকেট। এখানে ক্রিকেট খেলে ভারতরত্ন পর্যন্ত পাওয়া যায়। অন্যত্র দেশপ্রেম দেখানোর তেমন চান্স পাওয়া যায় না বলে সব প্রেম ক্রিকেটের মধ্যে দিয়েই বেরিয়ে আসে। যুদ্ধ করার সুযোগ তেমন মেলে না বলে ক্রিকেটেই দল বেঁধে ডান্ডাপেটার শখ মিটিয়ে নেওয়া হয়। বিশ্বকাপে দেশীয় ব্যাটসম্যান যখন পিটিয়ে আফ্রিকান বলের সুতো খুলে নেয়, গোটা দেশে যুদ্ধোন্মাদনার ঝিঁঝি লেগে যায়। এই সুতো সম্পর্কিত উদ্দীপনা প্রসঙ্গেই কবিগুরু ‘একই সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন’ লিখেছিলেন (তখন জনসংখ্যা কম ছিল)। এই সুতোই চুরিচামারি, বেটিং, সুপ্রিম কোর্টে ক্ষমতার জন্য কামড়াকামড়ি, মামলা-মোকদ্দমা, নানা রকম বৈচিত্রের মধ্যে গোটা দেশকে একসঙ্গে গেঁথে রাখে। ট্রেন, বাস ও সরকারি অফিসের ফাইল সতত লেটে চলে, কিন্তু যুদ্ধু-যুদ্ধু খেলার সময় গোটা দেশ কঠোর নিয়ম মেনে টিভির সামনে বসে। হারলে একই সঙ্গে শোকসভা হয়, জিতলে একই সঙ্গে বিজয়োৎসব। একেই আমরা ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ বলি।
bsaikat@gmail.com