রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৪

কেচ্ছা

সুস্নাত চৌধুরীনিন্দুকরা বলে, (থমাস ও জন) নোল ভ্রাতৃদ্বয় তো শিশু, জোসেফ স্তালিনই আসলে ফোটোশপের আদি পিতা। স্তালিনের জমানায় সোভিয়েত ইউনিয়নে যে ভাবে একের পর এক ফোটোগ্রাফ রি-টাচ করে ‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল’ কীর্তি চলেছে, তার পরদা ফাঁস হলে পাবলিক এ কথা বলবেই। শুধু ভবিষ্যৎ নয়, অতীতকেও নিজের প্রয়োজন মতো গড়ে নিতে চেয়েছিলেন সোভিয়েত সর্বাধিনায়ক। অতীতের কোনও নথি যখনই তাঁর বর্তমানকে খোঁচা দিতে পারে বলে মনে করেছেন... না, তাকে ‘ডিলিট’ করেননি, আলতো ‘এডিট’ করে নিয়েছেন! ইতিহাসকে অংশত মুছে নিয়ে, তার পর তুলে ধরেছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৪ ০০:১৭
Share:

নিন্দুকরা বলে, (থমাস ও জন) নোল ভ্রাতৃদ্বয় তো শিশু, জোসেফ স্তালিনই আসলে ফোটোশপের আদি পিতা। স্তালিনের জমানায় সোভিয়েত ইউনিয়নে যে ভাবে একের পর এক ফোটোগ্রাফ রি-টাচ করে ‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল’ কীর্তি চলেছে, তার পরদা ফাঁস হলে পাবলিক এ কথা বলবেই। শুধু ভবিষ্যৎ নয়, অতীতকেও নিজের প্রয়োজন মতো গড়ে নিতে চেয়েছিলেন সোভিয়েত সর্বাধিনায়ক। অতীতের কোনও নথি যখনই তাঁর বর্তমানকে খোঁচা দিতে পারে বলে মনে করেছেন... না, তাকে ‘ডিলিট’ করেননি, আলতো ‘এডিট’ করে নিয়েছেন! ইতিহাসকে অংশত মুছে নিয়ে, তার পর তুলে ধরেছেন।

Advertisement

স্তালিনের আগেও লেনিনের আমলে সোভিয়েতে টুকটাক ফোটো ম্যানিপুলেশন হয়েছে। দেখা গিয়েছে মাও-এর চিনেও। পরিভাষায় যাকে বলে ‘এয়ারব্রাশিং’। স্তালিন এয়ারব্রাশিং-কে অন্য উচ্চতায় তুলে আনলেন। পরিণত করলেন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন গুরুত্বপূর্ণ এক কাজে। শোনা যায়, যাঁরাই তাঁর বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের শুধু বর্তমান থেকে খালাস করেই থেমে থাকেননি, ইতিহাস থেকেও ছেঁটে দিয়েছেন। একটা-দুটো নয়, এমন অনেক হত্যা ও পুরনো ছবি থেকে উধাও হওয়ার রেফারেন্স একযোগে টানা যায়, যাকে নেহাতই সমাপতন ভাবলে চাপ আছে।

৭ নভেম্বর, ১৯১৯। অক্টোবর বিপ্লবের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি। মূল ছবিতে লেনিনের সঙ্গে ছিলেন সোভিয়েত নেতৃত্ব। স্তালিনের শিল্পীরা ছবিটি বদলে দিলেন। নয়া সংস্করণে বিলকুল ভ্যানিশ স্তালিন-বিরোধী লিয়ন ট্রটস্কি, লেভ কামেনেভ ও আর্টাশেস খালাটভ। সেই ট্রটস্কি, স্তালিনের জমানায় যাঁকে নির্বাসনে যেতে হচ্ছে, যিনি খুন হচ্ছেন ১৯৪০ সালে। সেই কামেনেভ, যিনি কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছেন, মৃত্যুদণ্ডে প্রাণ হারাচ্ছেন। সোভিয়েতের প্রকাশন বিভাগের একদা-প্রধান খালাটভকেও হত্যা করছে রাষ্ট্র।

Advertisement

৫ মে, ১৯২০। মস্কোর স্ভের্দলোফ স্কোয়ারে রুশ সেনাবাহিনীর উদ্দেশে লেনিনের সেই বিখ্যাত বক্তৃতার ছবি। একই পরিণতি ঘটল ট্রটস্কি আর কামেনেভের। উধাও হলেন ছবি থেকে।

১৯ জুলাই, ১৯২০। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় বিশ্ব কংগ্রেস। সে দিন হাজির ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়ও। মূল ছবি থেকে এম এন রায়-সহ সকলকে ছেঁটে ফেলা হল। রয়ে গেলেন কেবল লেনিন আর গোর্কি! স্তালিনের বিরাগভাজন হয়েও এম এন রায় তবু দেশে ফিরে এসেছিলেন, ছবি থেকে মুছে যাওয়া বাকিদের কেউ পড়েছিলেন মৃত্যুদণ্ডের মুখে, কেউ বা সত্যি সত্যিই হারিয়েই গিয়েছিলেন।

আর একটি দৃষ্টান্ত নিকোলাই ইয়েজোভ। ‘কমিসার’ হিসেবে স্তালিনের সোভিয়েতে নানা গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের শীর্ষ পদে ছিলেন। কিন্তু মতান্তর ও মনান্তরে স্তালিনের বিশ্বাসযোগ্যতা হারান। অতএব, খতম। অতঃপর স্তালিনের ডার্করুমও তাঁকে হাপিস করে দেয়। ওপরের ছবি দুটি দেখুন। ডান দিকের ছবিতে ইয়েজোভ গায়েব। চিত্র-ঐতিহাসিকদের কাছে আজও ইয়েজোভ-এর চলতি নাম, ‘দ্য ভ্যানিশিং কমিসার’!

নিজের ‘ইমেজ’ তৈরিতেও কারচুপি করতে দ্বিধা করেননি স্তালিন। ১৯২৬-এ লেনিনগ্রাদে তোলা একটি ছবিতে স্তালিনের সঙ্গে ছিলেন আরও তিন জন— নিকোলাই অ্যান্টিপোভ, সের্গেই কিরোভ ও নিকোলাই শ্ভেরনিক। এর পরই ধাপে ধাপে ফোটোগ্রাফটি ‘ক্রপ্ড’ হতে থাকে। শেষমেশ এসে দাঁড়ায় একটি পেন্টিং-এ। স্তালিন সেখানে এক ও একমাত্র— সর্বশক্তিমান নায়ক! ১৯২৯ সালে ছবিটি আঁকানো হয় রুশ শিল্পী ইসাক ব্রডস্কি-কে দিয়ে। কাকতালীয় মনে হয়, এই ব্রডস্কিই যখন লেনিনকে ধরেছিলেন তাঁর আঁকা লেনিনের পোর্ট্রেটটিতে সই করে দিতে, লেনিন নাকি বলেন, ‘এই প্রথম আমি এমন কিছুতে সই করছি, যার সঙ্গে আমি একমত নই।’

হয়তো ইতিহাসকেও নিজের অধস্তন কর্মচারী মনে করেছিলেন স্তালিন। তাই সে দিন ‘ক্যামেরা’ নামক যন্ত্রটির প্রশ্নাতীত বিশ্বাসযোগ্যতার মিথকে কাজে লাগিয়ে ভাঁওতা দিয়েছিল সোভিয়েত সেন্সরশিপ। কথায়-ছবিতে এ সব বৃত্তান্ত তুলে ধরেছেন ব্রিটিশ গ্রাফিক ডিজাইনার ও গবেষক ডেভিড কিং, ‘দ্য কমিসার ভ্যানিশেস: দ্য ফলসিফিকেশন অব ফোটোগ্রাফস অ্যান্ড আর্ট ইন স্তালিন’স রাশিয়া’ বইতে। বইটা পড়ার পর রুশ শিল্পীদের প্রতি মাথা শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসবে। সে দিন ফোটোশপ ছাড়া, কম্পিউটার ছাড়া তাঁরা এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন! স্বৈরাচারীর আদেশই আবিষ্কারের জননী!

susnatoc@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement