তিনি বলতেই পারেন, সব কিছু আপেক্ষিক। তাই বলে, সেটাই শেষ কথা হিসেবে গ্রাহ্য হবে! তিনি যদি দিনের পর দিন তাঁর দু-দুজন স্ত্রীকে ক্রমাগত ঠকিয়ে গিয়ে থাকেন, লোকে চুপ করে থাকবে? সেটা প্রবল পরকীয়া থেকে শুরু করে, দুর্দান্ত গবেষণায় ভরপুর সাহায্য নিয়ে, শেষমেশ অস্বীকার করা পর্যন্ত গড়ালে?
শুনলেই ধাক্কা লাগে, মহাজগতের একমাত্র পপুলার সমীকরণ E= mc2 -এর প্রবক্তা হিসেবে যে আইনস্টাইন নামক ভদ্দরলোকটিকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়, তিনি নাকি আদৌ এর ষোলো আনা মৌলিকত্বের দাবিদারই নন, অর্ধেক নাকি তাঁর অর্ধাঙ্গিনীরই! পদার্থবিদ্যার বহু পণ্ডিতই আর পাঁচ জন বিজ্ঞানীর রেফারেন্স টেনে বলে থাকেন, থিয়োরি অব রিলেটিভিটি আদৌ আইনস্টাইনের আবিষ্কার কি না, তা নিয়ে ঢের বিতর্ক আছে। কিন্তু পরদা ফাঁস না হলে, তিনি যে পরদানশিন করে রেখেছেন তাঁর প্রথম পক্ষ মিলেভা ম্যারিককেই, আইনস্টাইনের মৃত্যুর ৩০-৩৫ বছর পর্যন্ত তা কে জানত! যদি না তাঁদের বড় ছেলে হান্স অ্যালবার্টের সেফ্টি ভল্টে রাখা চিঠিগুলি প্রকাশ্যে আসত!
‘এটা নিয়ে আমাদের আরও কাজ করতে হবে। আমাদের কি উচিত প্রতিষ্ঠিত ধারণার উলটো দিকে যাওয়া? আমি নিশ্চিত নই, তবে সব কিছুই সম্ভব।’ আইনস্টাইনকে লিখছেন তাঁর স্ত্রী মিলেভা। জবাবে লিখছেন আইনস্টাইন, ‘আমাদের এটা ভাল করে ভেবে দেখতে হবে। কিন্তু আমি এটা জানি, এক সঙ্গে কাজ করতে পারাটা সব সময়ই দারুণ ব্যাপার!’ ‘আই’ নয়, ‘উই’। ‘মাই’ নয়, ‘আওয়ার’। ‘আওয়ার’ থিয়োরিজ, ‘আওয়ার’ ওয়ার্ক। পারস্পরিক প্রেমপত্রে ছত্রে ছত্রে ‘আমাদের’, ‘আমরা’! মিলেভাও ছিলেন পদার্থবিদ্যায় বিদুষী। সে যুগে বিরল। ফেডেরাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-তে পদার্থবিদ্যার প্রতি প্রেমই তাঁদের কাছাকাছি এনেছিল। সত্যি কি না, বলা মুশকিল, তবে লোকে বলে, আইনস্টাইনের গবেষণায় গণিতের অংশগুলি নাকি তাঁরই করা। সরাসরি কষে দেওয়া না হোক, নিদেন পক্ষে ইকুয়েশনগুলি তাঁরই সংশোধন করে দেওয়া বটে! কিন্তু আইনস্টাইনের প্রেমপত্র থিসিসে গড়ালেই ‘আমরা’ কেন হয়ে গেল ‘আমি’?
১৯০৫। সদ্যবিবাহিত আইনস্টাইন। সাধারণ অপেক্ষবাদ-সহ আইনস্টাইনের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি কাজ তখন প্রকাশিত হচ্ছে দুনিয়াখ্যাত ‘অ্যানালেন দের ফিজিক’ জার্নালে। সেখানকার সম্পাদকীয় বিভাগের এক সহায়ক রুশ বিজ্ঞানী আব্রাহাম জোফে পরে জানাচ্ছেন, সে দিন সব ক’টি পাণ্ডুলিপিই ‘আইনস্টাইন-মেরিক’ নামে ছিল। কিন্তু শেষমেশ সব ঝোলটাই গিয়ে পড়ে আইনস্টাইনের পাতে। কেন? আইনস্টাইনের বৈপ্লবিক গবেষণা তখন এমনিতেই বিজ্ঞান-দুনিয়া মেনে নিতে পারছিল না, সেখানে এক জন ‘অবলা নারী’র নাম এসে পড়লে ব্যাপারটা আরও লঘু হয়ে যেত? না কি গোটা পরিবারটার বেঁচেবর্তে থাকার জন্য একক আইনস্টাইনের প্রতিষ্ঠা, মায় ঠিকঠাক একটা চাকরি পাওয়াটাই লক্ষ্য ছিল? কিন্তু তিনি, মহান আইনস্টাইন, কেন আজীবন মেনে নেবেন এই মিথ্যাচার? তা হলে কি পুরুষতন্ত্রের সেই চেনা আপারহ্যান্ড? কোনও দিন, কোত্থাও, কক্ষনও কেন তিনি স্বীকার করবেন না তাঁর স্ত্রীর এক ফোঁটা কৃতিত্বের কথা! সে জন্যই কি তাঁর বিখ্যাত কোট আজও ফেসবুকে-ফেসবুকে ফেরে— ‘দ্য সিক্রেট টু ক্রিয়েটিভিটি ইজ নোয়িং হাউ টু হাইড ইয়োর সোর্সেস!’
মিলেভার সঙ্গে আইনস্টাইনের ডিভোর্স হচ্ছে ১৯১৯-এ। জিনিয়াসের কনফিডেন্সে আইনি কাগজে লিখে দিচ্ছেন, কোনও দিন নোবেল পেলে, সে টাকা তাঁর স্ত্রী-ই পাবেন! এরেই বুঝি ‘ক্রেডিট’ কয়! যদিও, অসুস্থ মিলেভা ও তাঁর স্কিৎজোফ্রেনিক ছেলের জন্য তা একেবারেই যথেষ্ট ছিল না। কিন্তু আইনস্টাইন তো তার সাত বছর আগে থেকেই তুতো-বোন এলসার প্রেমে পাগল। বিচ্ছেদের ঢের আগেই জঘন্য ব্যবহার করছেন মিলেভার সঙ্গে। চিঠিতে লিখছেন, ‘আমার থেকে আর কোনও ভালবাসা আশা কোরো না... আমি বলামাত্রই কোনও ট্যাঁ ফোঁ-টি না করে আমার শোওয়ার ঘর বা পড়ার ঘর ছেড়ে পাততাড়ি গুটোবে!’
হায় দ্বিতীয়া স্ত্রী এলসা, তুমিও ঠকলে! ইতিহাস বলছে, ইন্টারনেট বলছে, তুমি জানতেও পারোনি— অন্তত ছ’জন যুবতীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তোমার স্বামী, সুপুরুষ, সুদর্শন অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের।
susnatoc@gmail.com