একটা ভয় [কষ্ট] লজ্জা

পুজো সবে শুরু। সপ্তমী ঝলকাচ্ছে। পাড়ায় সন্ধের আরতির কিছু আগে গিয়ে আড্ডা মাতমাত। এমন সময় খেয়াল হল কানের কাছে কাঁইনানা কাঁইনানা কাঁসর বেজেই চলেছে। আরতির তো তখনও দেরি, তা হলে? দেখি বছর ছয়-সাতের একটা বাচ্চা বেবাক ওপর দিকে তাকিয়ে, প্যান্ডেলের ঝাড়বাতি চেটেপুটে খাচ্ছে আর কাঁসর বাজিয়েই যাচ্ছে। একটু বিরক্তই হলাম। ‘এই বাচ্চা, এই বাচ্চা, এই বাচ্চাআআআআ...’ জোরসে ডাকি, বাকি পিলপিলে শহর আর জাঁকের প্রতি তার কোনও মন নেই, সমীহও নেই। সে ঝাড়বাতির প্রেমে আকুল তখন।

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৪ ০০:১৯
Share:

পুজো সবে শুরু। সপ্তমী ঝলকাচ্ছে। পাড়ায় সন্ধের আরতির কিছু আগে গিয়ে আড্ডা মাতমাত। এমন সময় খেয়াল হল কানের কাছে কাঁইনানা কাঁইনানা কাঁসর বেজেই চলেছে। আরতির তো তখনও দেরি, তা হলে? দেখি বছর ছয়-সাতের একটা বাচ্চা বেবাক ওপর দিকে তাকিয়ে, প্যান্ডেলের ঝাড়বাতি চেটেপুটে খাচ্ছে আর কাঁসর বাজিয়েই যাচ্ছে। একটু বিরক্তই হলাম। ‘এই বাচ্চা, এই বাচ্চা, এই বাচ্চাআআআআ...’ জোরসে ডাকি, বাকি পিলপিলে শহর আর জাঁকের প্রতি তার কোনও মন নেই, সমীহও নেই। সে ঝাড়বাতির প্রেমে আকুল তখন। কিছু ক্ষণ পর শুনতে পেয়ে হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকায়। হাত নেড়ে কাছে ডাকি একটু কড়া করে বলব বলেই। হেলেদুলে ভারী কাঁসর হাতে নিয়ে সে আমার দিকে আসে। কিছুটা ভ্যাবলা, কিছুটা ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকে। বলি, ‘এখন তো আরতি শুরু হয়নি, তা হলে এত জোরে কাঁসর বাজাচ্ছ কেন?’ ক্ষীণ গলায় উত্তর এল, ‘ওই বড় দাদাটা যে বলল, হাত থামাবি না বাজিয়ে যা।’ বুঝলাম কেউ একটা রসিকতা করেছে ওর সঙ্গে। বললাম, ‘ঠিক আছে, এখন বাজিয়ো না, যখন আরতি শুরু হবে তখন বাজিয়ো।’ বড় করে ঘাড় নেড়ে চলে গেল কালোকুলো রোগা ছেলেটা।

Advertisement

যখন পেছন ফিরে চলে যাচ্ছে, দেখি সে পরে রয়েছে একটা বড়দের ধুতি। অনেক কষ্টে অনেক প্যাঁচ দিয়ে কোনও মতে সামলেসুমলে রেখেছে। আর গায়ে একটা হাতকাটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। এ কী! একটা ছোট্ট ছেলে কেন সুন্দর নতুন জামাপ্যান্টের বদলে একটা এত্ত বড় ধুতি পরে রয়েছে? আবার ডাকলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি বাবার সঙ্গে এসেছ?’ ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। ‘বাবা কি ঢাক বাজায় এখানে?’ কেবল ঘাড় নেড়েই সে উত্তর দেয়। বুঝতে পারলাম প্রথম বার ডেকে পাঠানোতেই সে বড় ভয় পেয়েছে। কলকাতা তো, তায় শাড়ি পরা দিদিমণি ডেকে প্রশ্ন করেছে!

পর দিন অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে গিয়ে প্যান্ডেলের মুখেই দেখা। একগাল হাসি। যেন একটা চেনা লোক পেয়েছে। পরে বাইরে এসে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছি, হঠাৎ দেখি কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বললাম, ‘কী নাম রে তোর?’ ‘যুদিষ্টি।’ ও, যুধিষ্ঠির? ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। পরনে সেই ধুতি আর গেঞ্জি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাল ঠাকুর দেখেছিস?’ বলল, ‘হ্যা।ঁ’ ‘কোথায়?’ আঙুল তুলে আমাদের পাড়ার ঠাকুরটাই দেখাল। ‘না না, এটা ছাড়া আর দেখিসনি?’ বলল, ‘দেখেছি তো আমাদের গেরামেরটা। পুরোটা শেষ হয়নি যখন আমরা চলে এলাম।’ বুঝলাম কলকাতার পুজো, তার রমরমা, আধিক্য, চেকনাই ফেল মেরে গেছে যুদিষ্টির কাছে।

Advertisement

এর পর নবমী দশমী যখনই দেখেছি, এক গাল হেসেছে ধুতি-গেঞ্জি পরা যুদিষ্টি। লাফিয়ে লাফিয়ে কাঁসর বাজিয়েছে। প্যান্ডেলেই ভোগ খেয়েছে। এক রাশ ঘুম নিয়ে চেয়ারে ঢুলেছে, কখন ভিড় পাতলা হবে আর প্যান্ডেলের পেছন দিকটায় শুতে পাবে।

দশমীর শেষে আবার বড়দের মতো বকশিস চাইতে এসেছিল আমার কাছে, খানিকটা অধিকার নিয়েই বোধহয়। ভেবেছিলাম একটা জামা কিনে দেব। কিন্তু কানে এল, ওর বাবা শিখিয়ে দিচ্ছে, ‘বকশিস মানে টাকা চাইবি, বুঝলি? কেউ যদি মিষ্টি-টিষ্টি দেয় তো বলবি ও সব চাই না, টাকা দিন।’ আমার কাছে এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘চমচম খাবি?’ খুব জোরে ভয়ার্ত চোখ করে মাথা নাড়ল। আমি বকশিস দিয়ে দিলাম। ধর্মরাজকে রংচঙে টি-শার্টে দেখার সাধ মিটল না আমার।

amisanchari@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement