একটা ভয় [কষ্ট] লজ্জা

বনমালী কাকা ছিল আমাদের দেশের লোক। বছরে বার দুই আসত। কখনও এক টিন গুড় নিয়ে, কখনও জমির চাল, চাষের আলু, মাচার তাজা লাউ নিয়ে। জ্যাঠা ডাক্তার ছিলেন। কখনও হয়তো ওর বাড়ির কারও উপকার করেছিলেন, বিনি পয়সায়। এমনতরো কৃতজ্ঞতা উত্তরাধিকারসূত্রে আমি অনেক দিন অবধি বয়ে যেতে দেখেছি। স্কুল থেকে ফিরে এক দিন শুনলাম বনমালী কাকা নাকি বর্ধমান মেডিকেল কলেজে ভর্তি।

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫
Share:

বনমালী কাকা ছিল আমাদের দেশের লোক। বছরে বার দুই আসত। কখনও এক টিন গুড় নিয়ে, কখনও জমির চাল, চাষের আলু, মাচার তাজা লাউ নিয়ে। জ্যাঠা ডাক্তার ছিলেন। কখনও হয়তো ওর বাড়ির কারও উপকার করেছিলেন, বিনি পয়সায়। এমনতরো কৃতজ্ঞতা উত্তরাধিকারসূত্রে আমি অনেক দিন অবধি বয়ে যেতে দেখেছি। স্কুল থেকে ফিরে এক দিন শুনলাম বনমালী কাকা নাকি বর্ধমান মেডিকেল কলেজে ভর্তি। অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। দেশেরই আরও এক জন লোক আমার জ্যাঠার থেকে একটা চিঠি করিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে, যদি জ্যাঠার কেউ চেনা থাকে, যদি চিকিৎসাটা বিনা পয়সায় হয়। মাস খানেক পরে শুনলাম বনমালী কাকা ভাল হয়ে গ্রামে ফিরে গিয়েছে।

Advertisement

সে বছর কালীপুজোয় দেশের বাড়ি গিয়ে বনমালী কাকাকে দেখে ধড়াস করে একটা ধাক্কা লাগল। বনমালী কাকা দেখা করতে এসেছে। মুখ মলিন, যন্ত্রণার রেখাগুলো সারা মুখে নকশা তুলেছে, আর বাঁ পায়ের পাতাটা নেই। ওটাই ছিল অ্যাক্সিডেন্ট। ‘কী দিদিমণি, কেমন আছ গো?’ এক ধরনের প্রসন্নতা নিয়েই বলল বনমালী কাকা। ‘কই তুমি তো বলোনি বনমালী কাকা, তোমার এমন হয়েছে?’ জ্যাঠা দেখলাম খুবই রাগারাগি করছে, ‘তোরা আমায় জানালি না এক বার যে পা-টা অ্যাম্পুট করতে হবে? অপারেশনের আগে এক বার কলকাতায় নিয়ে যাওয়া যেত।’

বুঝলাম, চিকিৎসার দায় আর ভার বড় বেশি হয়ে যাওয়ায় এক ধরনের রিজাইন দিয়েছিল বনমালী কাকা ও তার পরিবার। স্মিত মুখে বসে অনেক বকুনি সে শুনতেই থাকল। যেন কোথাও একটা ভরসা পাচ্ছিল জীবনে। বাইরে তখন ঠাকুরের গায়ে ঘামতেল লাগানো চলছে, কাল পুজো।

Advertisement

ঠাকুরদালান, বৈঠকখানা পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে গিয়ে দেখি মা আর জেঠিমা বনমালী কাকার বউকে খুবই গজগজ করে বলছে, ‘আমাদের তো এক বার জানাতে পারতে, এত বছরের সম্পর্ক। ছি ছি, একেবারে উচিত করোনি।’ বুঝলাম বনমালী কাকার অ্যাক্সিডেন্ট নিয়েই কথা চলছে। যা বুঝিনি, তা এ বার শুনলাম। বনমালী কাকার বউ খুব নিচু স্বরে বলল, ‘আসলে, মেয়েটাকে ও-বার পুড়িয়ে মারলে ওরা, কেউ কবুল গেল না গো। থানা-পুলিশ দিন কয়েক করলাম। কী-ই বা করতে পারি আমরা। ফেরার সময় মানুষটার আর মাথার ঠিক ছিল না। তাই অমন করে বাসের সামনে পড়ে গেল।’ আমার হার্ট রেট বেড়ে গেল, কড়াইয়ে লুচি ভাজা থেমে গেল। কিন্তু বনমালী কাকার বউ একই গুনগুন স্বরে বলতে লাগল তার পরের সব ঘটনা।

আমার মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করছিল, বাইরে বেরিয়ে এলাম। মনে হল, মেয়েটা মরে গেল, এরা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করল না? পা কাটা গেল, এরা কেঁদে রেগে পৃথিবী তোলপাড় করল না? এমন করে মিনমিন করে বলে চলেছে যেন আলুতে পোকা পড়েছে? বুঝলাম, আমার আসল শকটা লেগেছে এই মেনে-নেওয়ায়। এই অতলান্ত কষ্টকেও একটা নিতান্ত চলতি ঘটনা হিসেবে, প্রায় অভিযোগহীন গ্রহণ করায়। দারিদ্র, দুর্দশা, না-পাওয়া কোনও মানুষকে তা হলে এতটা প্যারালাইজ করে দিতে পারে, যে, তার চরম কষ্টকে সে মনে করে প্রাত্যহিকী, তার প্রাপ্য? তার মেয়ে খুন হয়েছে, তার পা কাটা পড়েছে, সেই জন্য সে কাজ পায় না আর তাই তার সংসারে আরও অভাব— আর সে উথালপাথাল কষ্ট পাওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে? যেন এমনটা তো হওয়ারই ছিল, ভাগ্যিস এর চেয়ে বড় কিছু হয়নি!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement