স্কুলে গিয়ে এমন অস্বস্তিকর ও অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আর্যকে কোনও দিন পড়তে হয়নি। অন্য দিনের মতোই যথারীতি সকাল সাড়ে দশটাই ভাত খেয়ে, স্কুলব্যাগ নিয়ে আর্য উপস্থিত হয়েছিল স্কুলে। আর্যর ক্লাস সিক্স। আর্যর স্কুল বিষ্ণুপুর স্যর রমেশ ইনস্টিটিউশন, বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ। ক্লাসরুমে ঢোকার পর থেকেই সব বন্ধুরা ওর ঢাউস স্কুলব্যাগের দিকে অবাক ও সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে দেখতে থাকল। বন্ধুরা জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে, তোদের বাড়ির অনেক পুরনো জিনিস কি আবার বের করা হয়েছে?’ আর্য বলল, ‘কেন?’ উত্তরে বন্ধুদের জবাব, ‘আরে তোর ব্যাগের ছাপানো বই, খাতা, পেন— এ সবের ব্যবহার প্রায় বিশ বছর আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’ আর্য এ বার লক্ষ করল তার সব বন্ধুদের কাছেই আছে শুধু একটা পাতলা ডায়েরির মতো ব্যাগ। এর মধ্যে ক্লাস শুরুর বেল পড়তেই সুমিতস্যর এসে ক্লাসে ঢুকলেন। স্যরের চেহারাটা কেমন যেন বদলে গিয়েছে। আগে ছিলেন ছিপছিপে পাতলা, অথচ আজ যেন বেশ ভারিক্কি আর বয়স্ক গোছের লাগছে। আর্য লক্ষ করল স্যরের হাতে অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টার, চক, ডাস্টার, বই— এ সব কিছু নেই। আছে কেবল একটা ১৬ ইঞ্চি ই-প্যাড। স্যর ঢুকতেই ছাত্ররা উঠে দাঁড়াল। স্যর তাঁর ই-প্যাডের মিউজিক প্লেয়ার থেকে জাতীয় সঙ্গীতের বাটন টিপলেন। ছাত্ররাও তাই। শুরু হল জাতীয় সঙ্গীত। জাতীয় সঙ্গীত শেষ হলে স্যর চেয়ারে বসলেন। ছাত্ররা নিজের নিজের বেঞ্চে বসল। স্যর ই-প্যাড খুলে রোল-কলের পেজে রোল-কল করলেন। এ বারে স্যর ছাত্রদের বললেন, ‘প্রত্যেকে নিজের নিজের ই-প্যাডে বিজ্ঞান বইয়ের ৩৪ পাতা ওপেন করো।’
ছাত্ররা সেই পেজ ওপেন করল। ই-প্যাডকে এখন বুক-রিডার মোডে আনা হয়েছে।
আর্য গভীর বিস্ময়ে লক্ষ করল, এ বারে সুমিতস্যর দেওয়ালে আটকানো একটা বিশাল বড় ইলেকট্রনিক বোর্ডে বোর্ড-ওয়ার্ক শুরু করলেন। পেনে লেখার প্রচলন অনেক আগেই উঠে গিয়েছে। স্যর ওয়্যারলেস কি-বোর্ডে টাইপ করে বোর্ড-ওয়ার্ক করতে থাকলেন। ছবি আঁকার প্রয়োজন হলে কোরেল-ড্র’তে ড্রয়িংটুল ব্যবহার করছেন।
স্যর ছাত্রদের বললেন, ‘প্রত্যেকে ই-প্যাডে ব্লু-টুথ অন করো। বোর্ড-ওয়ার্কের প্রত্যেকটি কথা ও ছবি তোমাদের ই-প্যাডে পৌঁছে যাবে। তোমরা কেবল বিষয়বস্তুতে মন দাও।’ আর্য শুনল একটি ছাত্র আর একটি ছাত্রকে নিচু গলায় বলছে, ‘জানিস, বাবা-মা’র কাছে গল্প শুনেছি যে, তাঁরা যখন স্কুলে পড়তেন, তখন স্যরেরা চক, ডাস্টারের সাহায্যে বোর্ড-ওয়ার্ক করতেন। আর সেগুলো দ্রুত খাতায় লিখতে কী গলদঘর্মই না হতে হত! আর ছিল বিশাল স্কুলব্যাগ। তাতে থাকত ভারী ভারী স্কুলের বইখাতা।’
এ বারে স্যর আগে থেকে তৈরি করা কিছু প্রশ্ন ছাত্রদের ই-প্যাডে ব্লু-টুথের সাহায্যে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, ‘তোমরা ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রশ্নের উত্তরগুলো ই-প্যাডে টাইপ করে আমার প্যাডে সেন্ড করে দাও।’ হঠাৎ সুমিতস্যরের নজর পড়ল আর্যর দিকে। তিনি আর্যর দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ‘কী ব্যাপার, তুমি এই সব বই-খাতা কোথা থেকে পেলে? নিশ্চয়ই তোমার বাড়ির অনেক পুরনো জিনিস পরিষ্কার করা হচ্ছিল। কাল থেকে কিন্তু আবার ই-প্যাড নিয়ে স্কুলে আসবে।’ স্যর একটি ছাত্রকে বললেন, ‘মনিটরের কাছে শুনলাম তুমি গতকাল সেকেন্ড পিরিয়ডে ই-প্যাডে গেম খেলেছ। আমি এই বিষয়টা তোমার মা’র মেল আইডিতে জানিয়ে দিচ্ছি। আর শোনো, শুধুমাত্র টিফিন ব্রেকের সময় তোমরা ই-প্যাডে গেম খেলতে পার।’ এ বারে স্যর আর একটা ছাত্রকে বললেন, ‘কী ব্যাপার, তোমার টাইপ স্পিড এত কম কেন? প্রাইমারিতে কী শিখে এসেছ? এখন তো আর বাংলায় টাইপ করার জটিলতা নেই। বাংলা উচ্চারণ কিন্তু রোমান হরফ। শোনো, ক্যাপসের ব্যবহার ঠিকঠাক করবে। প্যারা ভাগের দিকে নজর দেবে। Punctutation যেন ঠিকঠাক পড়ে। প্রয়োজনে italic হরফ ব্যবহার করবে। important point under line করবে। দরকার মতো Bullet ব্যবহার করবে। Blue ছাড়াও Black, green এই সব colour ঠিকঠাক ব্যবহার করতে হবে। আর spell checker যে বানানগুলো ভুল দেখাচ্ছে, সেগুলো ঠিক করে নেবে।
তবেই না তোমার matter-এর মান উন্নত হবে।’
ঘণ্টা পড়ল। ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে স্যর টিচার্স-রুমে ঢুকলেন। পিছন পিছন আর্য টিচার্স-রুমের বাইরে এসে দাঁড়াল। একটি প্রকাশনী সংস্থার প্রতিনিধি সেখানে উপস্থিত। তিনি স্যরকে বললেন, ‘স্যর, আমাদের হাইটেক প্রকাশনীর ক্লাস সিক্সের বিজ্ঞান বইয়ের ই-কপি পেয়েছেন? আপনার মেল আইডি-তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছাত্রদের একটু বলবেন স্যর। আমাদের সাইটে ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডে পেমেন্ট করলেই ওরা ওই ই-বুক ডাউনলোড করতে পারবে।’
হঠাৎ একটা ঠেলা খেয়ে সম্বিৎ ফিরে পেল আর্য। আর্যর মা ডাকছে, ‘কী রে, আর কতক্ষণ ঘুমোবি? রাত জেগে গল্পের বই পড়ে ঘুম আর ভাঙে না! সকাল আটটা বাজছে এ বারে ওঠ। স্কুলব্যাগে স্কুলের বই-খাতা সব ঘুছিয়ে নে।’ আর্য দেখল, কাল রাতে যে বইটা পড়তে পড়তে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, সেটা তখনও খোলা।
বইটির নাম ‘টাইম মেশিন’, লেখক এইচ জি ওয়েলস্।
ছবি: দেবাশীষ দেব।