বাইশ বছরের বিবাহিত জীবন কাটিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদে গিয়েছেন কন্যাসমা এক রমণীর প্রেমে বিভোর হয়ে। প্রবল পরকীয়ায় মজেছেন, কিন্তু সেই নারীকেও রক্ষিতা করেই রেখেছেন আমৃত্যু। আর সে কথা গোপন রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে গিয়ে, জন্ম দিয়েছেন বিবিধ কেচ্ছার।
চার্লস ডিকেন্স। খ্যাতির শীর্ষে থাকা এই ইংরেজ সাহিত্যিক তখন ব্যস্ত ‘দ্য ফ্রোজেন ডিপ’ নাটকের আয়োজন নিয়ে। সেটা ১৮৫৭ সাল। নাটকের একটি চরিত্রের জন্য বাছা হল বুদ্ধিদীপ্ত অভিনেত্রী নেলি ওরফে এলেন ললেস টারনান-কে। বয়সে ডিকেন্সের বড় মেয়ে মেরি-র চেয়েও বছর খানেকের ছোট। দিন কয়েকের মধ্যেই বাজিমাত করলেন ঝকঝকে সুন্দরী নেলি। অষ্টাদশীর প্রেমে ঘায়েল হলেন পঁয়তাল্লিশ-উত্তীর্ণ ডিকেন্স। গোপনে ফুল ফোটাতে থাকল পরকীয়া প্রেম।
সে ফুল সুগন্ধী না বিষময়, তা বোঝার আগেই এক দিন চোখে সরষে ফুল দেখলেন ডিকেন্স। লন্ডনের এক গয়নার দোকান থেকে পাঠানো ছোট একটি মোড়ক ঘটনাচক্রে এসে পড়ল তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিনের হাতে। ভেতরে একটি সুদৃশ্য সোনার ব্রেসলেট। সঙ্গে নেলির উদ্দেশ্যে চিরকুট। ক্রোধে ফেটে পড়লেন ক্যাথরিন। কিন্তু তীব্র ঝাঁজ দেখিয়ে নেলির সঙ্গে সম্পর্কের কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন ডিকেন্স। বললেন, নেলি তাঁর ‘মেয়ের মতো’; থিয়েটারের অন্যতম মুখ্য অভিনেত্রীকে ছোট্ট একটি স্মারক পাঠানো কী এমন গর্হিত কাজ!
ক্যাথরিন এ সব কথায় ভুললেন না। অতএব, বিচ্ছেদ। পথের কাঁটা সরানোর এমন মওকা চট করে মেলে না। কিন্তু ডিকেন্সের মতো নামীদামি লোকের বিচ্ছেদের কথা পাঁচকান হওয়ায় চার দিকে তখন নানা রটনা। ভিক্টোরীয় সমাজের ক্রমবর্ধমান ছ্যা ছ্যা আটকাতে ফের ভুল করলেন ডিকেন্স। যাঁরা তাঁকে নিয়ে নানা সন্দেহ বয়ে বেড়াচ্ছেন কিংবা তিনি বিপথে চালিত হচ্ছেন বলে মনে করছেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে ১৮৫৮-র ২৫ মে একটি বিবৃতি লিখে ডিকেন্স তুলে দিলেন তাঁর ম্যানেজারের হাতে। ম্যানেজার বেছে বেছে নানা জনকে সেই চিঠি পড়ালেনও, কিন্তু অচিরেই তা দুম করে প্রকাশিত হয়ে গেল ইংল্যান্ড ও আমেরিকার নানা পত্রপত্রিকায়। আরও ছড়িয়ে পড়ল ডিকেন্সের কেচ্ছা। স্ত্রীর সঙ্গে যে তাঁর দীর্ঘ দিন বনিবনা হচ্ছিল না, তা এক রকম সত্যিই। কিন্তু বিচ্ছেদ-সংক্রান্ত সাফাই গেয়ে সে বিবৃতিতে ডিকেন্স প্রমাণ করতে চাইলেন, স্বামী-স্ত্রীর বোঝাপড়ার অভাবই তাঁদের আলাদা থাকার যৌথ সিদ্ধান্তের একমাত্র কারণ। নেলি-র নাম না করে বোঝাতে চাইলেন, যাঁকে নিয়ে এত রটনা, সেই তরুণী তাঁর মেয়েদের মতোই নিষ্পাপ। আরও বড় ভুলটা ডিকেন্স করলেন ৭ জুন। এ বার নিজ উদ্যোগেই পত্রপত্রিকায় ছাপলেন আর একটি ‘পারসোনাল’ বিবৃতি। আরও জোর দিয়ে বোঝাতে চাইলেন, নতুন কোনও প্রেম-টেম নয়, মিল না হওয়াই বিচ্ছেদের কারণ। এতে আরও শোরগোল পড়ে গেল, ডিকেন্সের অবৈধ সম্পর্কের ব্যাপারে যাঁরা বিন্দুমাত্র জানতেন না, তাঁরাও রসালো কেচ্ছার ছিটেফোঁটা চেখে নিলেন।
এমনও শোনা গেল, ডিকেন্সের প্রেম আসলে তাঁর বাড়ির দেখভালের দায়িত্বে থাকা, নিজেরই শ্যালিকা জর্জিনা হগার্থের সঙ্গে। কেউ বলল, ডিকেন্সের অবৈধ বাচ্চার জন্ম দিয়েছেন নেলি। ডিকেন্স কিন্তু চির কাল চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন নেলির সঙ্গে সম্পর্কের কথা। তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত এ সব ঘটনা, রটনা আর সন্দেহের স্তরেই থেকে গিয়েছে। পরে তাঁর জীবনীকার ও গবেষকরা এই অবৈধ প্রণয়কে সত্য বলেই মনে করেছেন। বিভিন্ন নামে বাড়ি ভাড়া নিয়ে তিনি যে নেলিকে রেখেছিলেন, তার প্রমাণও মিলেছে। ডিকেন্সের পরবর্তী কালের উপন্যাসেও বেশ কিছু চরিত্রে স্পষ্ট হয়েছে নেলির ছায়া।
শেষ দিন পর্যন্ত নেলির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ডিকেন্সের। কিন্তু বিচ্ছেদের পর আর কখনও স্ত্রী ক্যাথরিনের মুখোমুখি হননি তিনি। মৃত্যুশয্যায় ক্যাথরিন মেয়ে কেট-এর হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁকে লেখা ডিকেন্সের চিঠিগুলো। বলেছিলেন, ‘এগুলো ব্রিটিশ মিউজিয়মে দিও, যাতে পৃথিবী জানতে পারে এক দিন তিনি আমায় ভালবাসতেন।’