কিম জং উন কি সত্যিই রক্তলোলুপ শয়তান!

আগামী মঙ্গলবারের দিকে এখন অধীর আগ্রহে তাকিয়ে তামাম দুনিয়া। সে দিনই সিঙ্গাপুরে ডোনাল্ড ট্রাম্প-কিম জং উন বৈঠক যে! সে দিনই বোঝা যাবে, উত্তর কোরিয়ার একনায়কটি কি সত্যিই রক্তলোলুপ শয়তান! না কি, লৌহ যবনিকার আড়ালে চতুর এক মস্তিষ্ক!আগামী মঙ্গলবারের দিকে এখন অধীর আগ্রহে তাকিয়ে তামাম দুনিয়া। সে দিনই সিঙ্গাপুরে ডোনাল্ড ট্রাম্প-কিম জং উন বৈঠক যে! সে দিনই বোঝা যাবে, উত্তর কোরিয়ার একনায়কটি কি সত্যিই রক্তলোলুপ শয়তান! না কি, লৌহ যবনিকার আড়ালে চতুর এক মস্তিষ্ক!

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৮ ০০:০০
Share:

ছবি: কুনাল বর্মণ

গত সপ্তাহের শুক্রবার। তারিখটা ১ জুন। ওয়াশিংটনে ওভাল অফিসে বসে আছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, এমন সময় খবর এল— উত্তর কোরিয়ার এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্তা এসেছেন পিয়ংইয়ং থেকে দূত হয়ে, হাতে একটা চিঠি। চিঠিই সেটাকে বলতে হবে, গতি নেই, কিন্তু খামের সাইজ দেখলে ওটাকে চিঠি না বলে ফোল্ডার বা ফাইলই বলা উচিত। অত বড় খাম কূটনীতির পৃথিবীতে দেওয়া-নেওয়ার চল নেই আজ পর্যন্ত। মুখ-আটকানো দৈত্যাকার খামে আছেটা কী? কিছু না জেনেই ট্রাম্প হইচই শুরু করলেন, নিজের হোমরাচোমরাদের ডেকে সেটাকে নিলাম করার ভান করলেন: ‘‘বলুন, কত, কত, কত?’’ হাসাহাসির মধ্যে নানাবিধ অনুমান আরম্ভ হল, কী আছে ওর মধ্যে। পরমাণু-অস্ত্রের কথা কেন, গোটা বিশ্ব-ইতিহাসই তো ঢুকে যেতে পারে ওর মধ্যে, এমনই আকৃতি। কিন্তু না, ওভাল অফিস থেকে আর কোনও খবর বাইরে এল না, জানা গেল না ট্রাম্প কী পেলেন ওটার মধ্যে। লোকেরা কেবল বলাবলি করল, ট্রাম্প এখন ওর চেয়েও একটা বড় খাম খুঁজছেন, ১২ জুন তাঁদের দুই জনের বৈঠকের আগে কিং জম-উনকে পাঠাবেন বলে!

Advertisement

সে বারের মতো আর কী। পর পর দু-দু’টি পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা এবং সেই নিয়ে ট্রাম্পের হুমকি শুনে কিম জং-উন ট্রাম্পকে শাসিয়েছিলেন, বেশি ঝামেলা নয়, কিমের টেবিলের ঠিক নীচেই কিন্তু পরমাণু মিসাইলের বোতামটা আছে, টিপে দেওয়ার অপেক্ষা! ট্রাম্প উত্তরে বলেছিলেন, হুঁহুঁ, আমারও আছে! আর আমার বোতামটা আরও অনেক বড়!

ট্রাম্প মশাইকে তো আমরা ইতিমধ্যে চিনেছি, কিন্তু তাঁর সঙ্গে যিনি সমানে সমানে টক্কর দিয়ে চলেছেন, এই ব্যক্তিটিকে কি ভাল করে চিনি এখনও? যে কোনও হিসেবেই কিন্তু এই ভদ্রলোক, মানে উত্তর কোরিয়ার মহামান্য কিম জং-উন হলেন এমন এক নেতা যে রকমটা বিশ্বপৃথিবী কস্মিনকালেও দেখেনি! গোটা আমেরিকা তাঁকে খ্যাপায় ‘ফ্যাটবয় কিম’ বলে, ভয় পায় ‘ব্লাডথার্স্টি টাইর‌্যান্ট’ বলে। তিনি আপাতত এই গ্রহের একমাত্র বংশানুক্রমিক স্বৈরাচারী, যিনি অত্যাচার-অনাচারে এই মুহূর্তে, যাকে বলে, অ-তুলনীয়। দিনের অধিকাংশ সময় তিনি মদ্যপানে ডুবে থাকেন, দিনের প্রায় পুরোটা চেন-স্মোকিং-এ কাটান। এবং যৌন স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য সাপের বিষ সেবন করেন। সবই অবশ্য শোনা কথা। কিন্তু আজ অবধি এই সব ‘শোনা কথা’য় পিয়ংইয়ং-এর কেউ কোনও আপত্তি জানায়নি।

Advertisement

ইনি এমন নেতা, যিনি তাঁর বাবার ‘মিলিটারি-ওনলি’ রাজ্যশাসন পদ্ধতিকে আরও খানিক তুঙ্গে তুলেছেন। বাবা একের পর এক পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে অন্য দেশকে তাতিয়ে দিতেন, ইনি একের পর এক পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্রের নিষিদ্ধ পরীক্ষা চালিয়ে অন্যান্য দেশকে ভয়ে আধমরা করে রাখেন। ট্রাম্প যতই হম্বিতম্বি করুন, আরও বড় বোতামের হাঁক ছাড়ুন, কতখানি ভয় পেলে কিম-এর এত আস্পর্ধা সহ্য করে তিনি বৈঠকে বসার জন্য হন্যে হয়ে থাকেন, বোঝাই যায়!

কিম এমন নেতা, যিনি ২০১২ সালে ক্ষমতায় আসার পর ২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত নিজে অন্য কোনও দেশে যাননি, অন্য কোনও রাষ্ট্রপ্রধানকে নিজের দেশে আসতেও বলেননি। না আছে তাঁর কোনও বন্ধু, না আছে কারও সঙ্গে তাঁর পরিচয়। যে দেশটির সঙ্গে তাঁর দেশের অনেক কালের ঘনিষ্ঠতা, সেই মহাশক্তিধর চিনও অনেক চেষ্টা চালিয়ে চিনতে-জানতে পারেনি তাঁকে। গোটা পৃথিবী কেবল একটাই কথা জানে, সম্পূর্ণ একাকী নির্বান্ধব এই স্বৈরাচারী নেতা নিজের দেশেও যা-ইচ্ছে-তাই করেন, বাইরের দুনিয়াতেও সেটাই করতে চান। কারও ভয়ে গুটিয়ে থাকার পাত্র তিনি নন, আমেরিকার ভয়ে তো না-ই!

ইনি এমন নেতা, যাঁর সম্পর্কে শোনা যায় তিনি নাকি তাঁর কাকাকে মেরে মৃতদেহটাকে কুকুরে খাইয়েছিলেন! কথাটার সত্যিমিথ্যে যাচাই হয়নি, তবে কুকুর অংশটা বাদ দিলেও যা পড়ে থাকে, সেটাও হৃদয়গ্রাহী। বাবা কিম জং-ইল’এর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় বসেই কনিষ্ঠ পুত্র কিম জং-উন গলা কেটেছিলেন নিজের কাকার। কাকার প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল খুব বেশি, আর সেই প্রভাব খাটিয়ে কাকা তাঁর ভাইপোকে ক্ষমতায় বসতে সাহায্য করেছিলেন! বিপদের গন্ধ পেতে ভুল হয়নি ধুরন্ধর ভাইপোটির। বুঝে নিয়েছিলেন, এক জনকে ক্ষমতা পেতে সাহায্য করেন যিনি, অন্যকেও যে কোনও সময় ‘সাহায্য’ করতে পারেন! সুতরাং সোজা মস্তক-ছেদন। কেন কাকাকে মারার সিদ্ধান্তটা নিতে হল, সেই কারণগুলোর একটা তালিকাও প্রকাশ করেছিলেন ওই সময়ে। একটা কারণ ছিল এই রকম— দলের পলিটব্যুরো মিটিং-এ যে দিন কাকাকে মারার পরিকল্পনা করছিলেন ভাইপো, কাকা নিজেই সামনে বসে মন দিয়ে ব্যাপারটা শুনেছিলেন, সকলের সঙ্গে মিলে হাততালিও দিয়েছিলেন, কিন্তু ভাইপোর সন্দেহ হয় কাকার সেই হাততালিতে যেন একটা আনমনা ভাব, আন্তরিকতার অভাব! নিজের হত্যা-পরিকল্পনা শুনে ভাইপোর প্রতি আনন্দ-ভক্তিতে মোটেই আত্মহারা হননি তিনি! এত বড় স্পর্ধা, এত অশ্রদ্ধা প্রদর্শন? সহ্য করা সম্ভব?

আসলে সন্দেহবাতিকটা তাঁর অসুখ! সে জন্য অবিশ্বাসী বিদ্রোহী সন্দেহে কত অগুনতি লোককে মারতে হয়েছে ‘বাধ্য হয়ে’। কী করবেন তিনি, যদি কেউ মনে বিশ্বাস না রাখে, মুখে বিশ্বাস না দেখায়? ক্ষমতাটা তো রাখতে হবে! প্রকাশ্য জনস্থানে সর্বসমক্ষে বিদ্রোহীদের কিংবা কল্পিত বিদ্রোহীদের গলা কাটতে হয় তাই, সেই পুরনো গিলোটিন স্টাইলে। এখনও রোজকার নিয়ম, তিনি সামনে এসে দাঁড়ালে যদি উপস্থিত সমস্ত জনগণ আবেগে আপ্লুত হয়ে ডাক ছেড়ে না কাঁদে, যদি কারও চোখে জলের ঘাটতি পড়ে, তা হলেই ব্যস! ‘সন্দেহবশে’ সে দিনই তাদের বাড়ি পেয়াদা হানা দেয়, পত্রপাঠ তাদের পাঠানো হয় জেলে, অর্থাৎ বাধ্যতামূলক লেবার ক্যাম্পে, যার আসল অর্থ— কনসেনট্রেশন ক্যাম্প।

খুব কম বাইরের লোক উত্তর কোরিয়ায় যেতে পেরেছেন। সেই হাতে-গোনা কয়েক জনের মধ্যে আছেন বাস্কেটবল খেলোয়াড় রডম্যান। ২০১৩ সালে পিয়ংইয়ং-এর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন তিনি। স্টেডিয়াম-এ নাকি হঠাৎ করেই ঢুকে পড়েছিলেন রাষ্ট্রনেতা কিম, আর ‘পুরো আধ ঘণ্টা স্টেডিয়াম-ভর্তি লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছিল, প্রত্যেকটি মানুষ হাপুসনয়নে কাঁদছিল।’

বাইরের লোক যায় না বলে উত্তর কোরিয়ার ভেতরের কথা জানার উপায়ও কম। তবু যেটুকু টুকটাক ছবি বাইরে ভেসে আসে। ও দেশে বাড়ি থেকে মানুষকে ধরে নিয়ে যায় সরকার। শিশুদেরও। শ্রমিক হিসেবে খাটায় তাদের। উদয়াস্ত পরিশ্রম, খাবারদাবারের ব্যবস্থা ছাড়াই, ফাঁকি মারলেই শারীরিক নির্যাতন। মেয়েদের ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন, অবশ্যই। কেউ ফাঁকি দিচ্ছে কি না, কিম জং-উন নিজেই দেখে যান আকস্মিক টহলে।

দেশ ছেড়ে পালানো? উঁহু, ও সব গেরো ঢিলা রাখেননি কিম। ভাল করে জানেন তিনি, দুই কোরিয়া মিলে ছোট্ট একটা ভূখণ্ড, সেখানে উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে আন্তর্জাতিক সীমানা পেরোলেই অন্য কোরিয়া, অন্য পৃথিবী! দক্ষিণের সেই কোরিয়ায় খোলামেলা সমাজ, বিশ্বায়নের বাজার, গণতন্ত্রের রাজনীতি। ঝাঁ-চকচকে শহর, উন্নয়ন-সমৃদ্ধ গ্রাম। আমেরিকা-ইউরোপের সঙ্গে দহরম মহরম। ভাল খাওয়া ভাল থাকা। ভাল পড়াশোনা ভাল গবেষণা। উত্তরের পীড়ন-জর্জরিত বুভুক্ষু সন্ত্রস্ত মানুষ কি দক্ষিণের খবর পায় না? না, পায় না, বাইরের খবর পাওয়ার ‘স্বাধীনতা’ বন্ধ করেছেন কিম। আর পেলেই বা কী, পালিয়ে আসার প্রশ্নই নেই। দুই কোরিয়ার মধ্যে সীমান্তে যে কড়া নজরদারি, পৃথিবীর আর কোনও প্রতিবেশী-রাষ্ট্রের সীমানায় তেমনটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। মোবাইল ফোন জ্যাম করে দেওয়ার বন্দোবস্ত আছে সীমানার দুই দিকেই। দক্ষিণ কোরিয়া কোনও আপত্তি করে না। আরে, নিউক্লিয়ার পাওয়ার বলতেই যাদের কিছু নেই, তারা আবার বলবে কথা!

বাবা কিম জং-ইল বুঝেশুনেই উত্তরাধিকারী পছন্দ করেছিলেন। তিন ছেলের মধ্যে ছোটটিই যে ভুবনজোড়া ধনতন্ত্র-গণতন্ত্রের আসনের মধ্যে সমাজতন্ত্রের নামে তৈরি লৌহকঠিন রাষ্ট্রতন্ত্রের যন্ত্রটিকে রক্ষা করতে পারবে, তাড়াতাড়িই সকলকে জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বুঝেছিলেন, অন্য দু’জনের তুলনায় এই ছেলেটি ছোট থেকেই বেশ ‘আগ্রাসী’। অথচ ওপরে ওপরে একটা নিপাট নিরীহপনাও তার রয়েছে, ওটাও দরকারি, ভালই জানতেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা বাবা-কিম। লক্ষ করেছিলেন, চুপচাপ ছেলেটাকে বোঝা যায় কেবল বাস্কেটবল খেলার সময়। মাঠে নামলে নিমেষের মধ্যে সে প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক। উল্টো দিকের খেলোয়াড়রা ভয়ে কাঁটা। বাবা-ছেলের এ সব কথা স্মরণ করেছেন ফুজিমোতো, যিনি এক সময় ওই পরিবারের সুশি-পাচক ছিলেন। পরবর্তী কালে উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে এসে তিনি একটি স্মৃতিকথা লেখেন, যাতে কিম বিষয়ে অনেক তথ্য পাই আমরা। রান্নার অবসরে ফুজিমোতোর কাজ ছিল বালক কিম-এর সঙ্গে বোর্ড-গেম খেলা। প্রাণ হাতে করে সে খেলা খেলতে হত, কেননা হারলেই কিম রেগে আগুন হয়ে গুটি ছুড়ে মারবেন তাঁকে, রীতিমতো আহত হতে হবে!

এ ভাবে ছোট্টবেলা থেকেই ‘ক্ষমতা ব্যবহার’ করতে সিদ্ধহস্ত ফ্যাটবয় কিম। ক্ষমতা নিয়ে ছোটখাটো ঠাট্টাও তার ছোটবেলা থেকেই। স্কুলে যাওয়ার সময় বিরাট ঢোলা একটা প্যান্ট পরে যেত, পিছনে লেখা থাকত ‘কিক মি’! ভাবটা এই, দেখোই না ভাই এক বার ‘কিক’ করে, কী হয় তোমার হাড়গুলোর! বড় হতে হতে শুরু হল সেনাবাহিনীর সঙ্গে ওঠবোস, আরওই ক্ষমতার নেশায় মশগুল হল ছেলেটা, ফুজিমোতো বলেছেন। সুইটজারল্যান্ডের স্কুলে তাঁকে পড়তে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু কোনওমতে কয়েক বছর কাটিয়েই দেশে ফিরে আসেন কিম, আর্মি কলেজে ভর্তি হন। সেই থেকে আজও আর্মির অফিসাররাই ঘিরে থাকেন তাঁকে, দশ দিকে। সেনা-ঘেরাটোপ ছাড়া এখন নিজের প্রাসাদেও এক পা হাঁটেন না কিম। একনায়কদের সমস্যা তো ওটাই, সব সময় ভয়, এই বুঝি গেল প্রাণটা, এই বুঝি কেউ মারল ছুরি। ট্রাম্পও অমনই ভিতু। কিমও। আমরা সাধারণ মানুষরা কি বুঝব এই মহা-ক্ষমতাবানদের দুঃখ-কষ্ট?

বুঝব কি, এই এক বার বিদেশ আসার জন্যই কত রকম অসুবিধে হল তাঁর? তাঁকে যে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হল আস্ত একটা ‘কমোড’! দেশের বাইরে আসতে হলে এইটুকু তো লাগবেই। কোনও ‘অবশিষ্ট-চিহ্ন’ কি তাঁর পক্ষে বিদেশে ফেলে যাওয়া সম্ভব! যদি ভবিষ্যতে কেউ সেই সব ‘চিহ্ন’ গবেষণাগারে নিয়ে পরীক্ষা করে! কে জানে কী তথ্য বেরিয়ে পড়বে তাঁর অন্দর-বাহির নিয়ে! কে জানে কেউ ক্লোন তৈরি করবে কি না! ঝুঁকি নৈব নৈব চ। পেন-পেনসিলও এনেছিলেন সঙ্গে। তিনি নিজের দেশে ফিরে গেলেন আর তাঁর আঙুলের ছাপ পিছনে বিদেশ-বিভুঁইয়ে পড়ে রইল, এও কি হয়? এই যে ভয়ে-দুরুদুরু একনায়ক, তাঁর সম্পর্কে যদি ভাবি— ধরাধামে অবতীর্ণ এক নম্বরের রাক্ষস, কী ভুলই না করব আমরা। যদি ভাবি, আদিকাল থেকে স্বেচ্ছাচারী-স্বৈরাচারীদের লম্বা তালিকার সাম্প্রতিকতম সংযোজন ইনি, কী বোকামিটাই না হবে।

না, আর যা-ই হোন কিম, ‘প্রেডিক্টেবল’ নন। তাঁর কাজ কেবল, অন্যদের বোকা বানানো। এই যেমন, গত মে মাসে তিনি যখন দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সোল-এ এলেন জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক বৈঠকটি করতে, কী অসাধারণ ভেলকিই না দেখালেন! দক্ষিণ কোরিয়ার নেতা মুন-জে ইন তাঁর ঐতিহাসিক আবির্ভাবের আগে নিশ্চয়ই কয়েক রাত ঘুমোতে পারেননি কী হতে চলেছে ভেবে! কিন্তু সব ভয়-ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে বৈঠক হল দিব্যি— যাকে বলে সফল, শান্তিপূর্ণ, সৌজন্যময়। কেবল মুন-জে ইন নন, অন্যান্য নেতারাও অবাক। টেলিভিশনের পর্দায় হাজার হাজার মানুষও দেখলেন, ভয়ানক রাক্ষস বলে যিনি পরিচিত, বিলকুল অন্য রকম লাগছে তাঁকে! রাক্ষস কি কখনও এত হাসিমুখ হয়? রাক্ষস কি ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে? রাক্ষস রাষ্ট্রনায়ক কি নিজের দেশ নিয়ে পরিহাসে মাতেন? অথচ মুন জে-ইনকে নিজের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন কিম, ‘‘দেখবেন, প্লেনে করে আসবেন কিন্তু, ও দেশের রাস্তাঘাট যা জঘন্য!’’ সন্ধেয় ব্যাঙ্কোয়েট-এ নিজের আসন ছেড়ে প্রত্যেক আমন্ত্রিতের কাছে এগিয়ে গিয়ে কথা বললেন, এত ভদ্র। কোনও বিষয়ে কথা বলতে ‘ব্রিফ’ নিলেন না, এত আত্মপ্রত্যয়।

ফল হল এই, দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ যেন মেতে উঠল তাঁকে নিয়ে। নকল ‘কিম’রা সোল শহরের এ দিক-ও দিক ঘুরে বেড়ালেন ওই কয়েক দিন: সেই মাও জে দং-মার্কা কোট, সেই আশ্চর্য চৌকোমার্কা হেয়ারস্টাইল, যার নাম ফ্রেড ফ্লিনস্টোন হেয়ারকাট। নিজের দেশে সব উঠতি তরুণকে বাধ্যতামূলক ভাবে যে হেয়ারকাট রাখতে আদেশ দিয়েছেন কিম।

ব্যাপারটা তা হলে ঠিক কী? ‘হাইলি সাসপিশাস’ লোকটা এক দিকে আমেরিকাকে পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দেয়, আর অন্য দিকে দক্ষিণ কোরিয়াকে শান্তির ললিত বাণী শোনায়? লোকটা কি খ্যাপা? নাকি বড্ড বেশি সেয়ানা?

বেচারা ট্রাম্পের জন্য দুঃখ হয়। এমনিতেই ‘আমেরিকা-ফার্স্ট’ প্রেসিডেন্টটির অভ্যাস সবই সাদা-কালোয় দেখা। আমেরিকার বাইরে গোটা পৃথিবীটাই তাঁর চোখে শয়তানির আড্ডাখানা, আমেরিকান ছাড়া সবাই ঘোর ঘৃণার বস্তু।
তার উপর তাঁকেই কি না সামলাতে হবে কিম জং-উন নামক এই অভূতপূর্ব অদৃষ্টপূর্ব মূর্তিমান বিভ্রমটিকে!

আপাতত রাতদিন সেই অমোঘ প্রশ্নটাই তাই কুরে কুরে খাচ্ছে ট্রাম্পকে: আচ্ছা, কিম কি সত্যি সত্যি পাগল? না কি তিনি কেবল সেয়ানামি করেন?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement