Keypad Phones

ফোনে নয়, মনে মোর পাখি আজ গান গায়

অবিরত স্মার্টফোন ব্যবহারে কি মানুষ ক্লান্ত? অজস্র নোটিফিকেশনের বিরামহীন ধ্বনি কি বিরক্ত করে আজকাল? অস্বস্তি থেকে রেহাই পেতেই কেউ কেউ ফিরে আসছেন বেসিক ফোনে।

Advertisement

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২৪ ০৭:৩১
Share:

ভিড়ে ঠাসা মেট্রোয় আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকের ফোনটা খুব সাধারণ স্বরে বেজে উঠল।

Advertisement

‘অসাধারণ’ কথাটা লিখতে বড় ইচ্ছে করছিল। যা সাধারণ নয়, তাই তো অ-সাধারণ। ঝিনচ্যাক ক্যাকোফোনির যে নিত্যনতুন চমকদার রিংটোন শুনি এখানে-ওখানে যেখানে-সেখানে, সেই তুলনায় আমার সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের ফোনের রিংটোন খুবই ম্যাড়মেড়ে। ছা-পোষা। কোনও রকম কায়দা ছাড়া মোনোফোনিক স্বর। উনি নজর কেড়েছিলেন তখনই। চমকের অবশ্য বাকি ছিল। পকেট থেকে এ বার উনি শুধু ফোন বার করলেন না। একই সঙ্গে বার করে ফেললেন বছর কুড়ি আগের হারিয়ে যাওয়া সময়। কলেজজীবনের কথা মনে পড়ে গেল মুহূর্তে। মুঠোফোন মানে তখন হাতের মুঠোয় দুনিয়া ছিল না। মোবাইল ফোন ব্যবহারের অর্থ ছিল শুধুমাত্র কথা বলা এবং মেসেজ করা। মধ্য-চল্লিশের ভদ্রলোক ফোনটি কানে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব কথা সারলেন। ফোনটি পকেটে ঢুকিয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। এক হাতে উপরের হাতল ধরে অন্য হাতে একটা বই সামলাচ্ছিলেন ট্রেনে ওঠা ইস্তক। ফের বইয়ের অক্ষরে ডুবে গেলেন তিনি। আমি খানিক কুণ্ঠা নিয়েই ওঁকে বিরক্ত করলাম। আমার চোখের ভাষা দেখেই সম্ভবত আমার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা প্রশ্নের সন্ধান পেয়েছিলেন তিনি। বললেন, “কী জিজ্ঞেস করবেন জানি। এই বাজারেও বেসিক ফোন কেন, তাই তো? উত্তরটা হল, আমার ইচ্ছে। আমি বাঁচতে চাই।”

আমি মাথা নাড়ালাম, হতভম্বের মতো। ভদ্রলোক এ বারে বললেন, “দিনরাত ওই যন্তরটায় বুঁদ হয়ে না থেকে একটু সাধারণ হওয়ার চেষ্টা করে দেখুন। ভাল লাগবে। যে যন্ত্রের যেটা কাজ, তাকে ওইটুকুই করতে দিন। জীবন বদলে যাবে।”

Advertisement

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু কোথায় পেলেন আপনি এমন এই ফোন? এমন মডেল তো ‘ধুলায় হয়েছে ধূলি’, কতকাল আগে।”

উনি বললেন, “দুনিয়ায় সব মেলে, শুধু খোঁজার চোখ থাকা চাই। স্টেশন এসে গিয়েছে আমার। যাই তবে ভাই। বাই।”

আমার মনের মধ্যে বুড়বুড়ি-কাটা আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভদ্রলোক ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। আমি ফের আমার স্মার্টফোনে মগ্ন হলাম, ট্রেনের অন্য যাত্রীদের মতো। সমাজমাধ্যমের কোনও পোস্ট যেন মিস না হয়ে যায়, বেঁচে থাকার মন্ত্র তো করে নিয়েছি এটাই। মন্ত্র জপতে গেলে যন্ত্র লাগে হাতে। সর্ব ক্ষণ।

ভদ্রলোক যেন বিদায় নিয়েছিলেন অজস্র প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে। না হলে তাঁর বলা ‘আমি বাঁচতে চাই’ কথাটা আমার প্রতি দিন মনে পড়বে কেন? চোখ বুজলেই ভেসে আসছে তাঁর সেই ছোট্ট ফোনটির কথা। আমার ফোনের গরিলা গ্লাস-অ্যামোলেড ডিসপ্লের সাত ইঞ্চি পর্দার সঙ্গে ওই ফোনের স্ক্রিনের তুলনা করতে গেলে হাসি পায়। একটা দেশলাই বাক্সও ওই স্ক্রিনের আয়তনকে হার মানাবে। তবে মুশকিলটা হল, হাসি পাওয়ার সঙ্গে কোথায় যেন মিশে যাচ্ছে এক ধরনের অস্বস্তি। স্মার্টফোন ছিল না যখন, তখন তো মেট্রোয় দিব্যি বই পড়তে পড়তে যেতাম আমিও। বইমেলা থেকে কেনা রাশি রাশি বই শেষ করেছি মেট্রোর যাত্রাপথে। কলেজজীবনে কেনা শারদীয় পুজোসংখ্যার বহু উপন্যাস বুঁদ হয়ে শেষ করেছি ওই সুড়ঙ্গপথেই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়েছি কি না জানি না, তবে স্মার্টফোনকে সর্বস্ব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ হারিয়ে ফেলেছি বই পড়ার অভ্যেসও। না হলে এখন কেন মনে হচ্ছে, হারিয়ে ফেলা সময় তো ফিরে পাব না আর!

ভদ্রলোক ভুল বলেননি। অনলাইন খুচরো বিপণির সার্চ অপশনে গিয়ে প্রিয় মোবাইল ফোন ব্র্যান্ডের লেটেস্ট মডেলকে খুঁজত যে আঙুলগুলো, তাদের বললাম, সন্ধান করো দেখি বেসিক ফোন, কিংবা ফিচার ফোন। দেখো দেখি, এমন বোতাম টেপা ডাইনোসর যুগের ফোন সত্যিই কি বেঁচে আজ, এই বাজারে? কী আশ্চর্য! পর্দা আলো করে চলে এল সাবেকি মোবাইলের কয়েকশো মডেল। দাম শুরু মাত্র আটশো টাকা থেকে। দেখলাম, অধিকাংশ মোবাইলেরই রেটিং পাঁচের মধ্যে চারের উপরে। ইউজ়ার রিভিউতে ক্লিক করে দেখলাম, মন্তব্য করেছেন কয়েক হাজার মানুষ। মানে, ব্যবহারকারী। হাল আমলের স্মার্টফোনের রিভিউয়ের তুলনায় এমন ফোনের রিভিউ সম্পূর্ণ আলাদা। এর ভিন্ন পরিসর। ‘এক চার্জে পাঁচ দিন চলে’, ‘পড়ে গেলেও ভাঙে না’, ‘খুবই হালকা তাই পকেটে রাখলে বোঝা-ই যায় না’, এমন মন্তব্য করার পাশাপাশি বহু মানুষ লিখেছেন, ‘কমপ্লিট পিস অব মাইন্ড’। মানে, এ ধরনের ফোন ব্যবহার করে মনের শান্তি! অনেকেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এক জন লিখেছিলেন, ‘স্মার্টফোনে মত্ত ছিলাম যখন, দিন আমার কাছে মোটে বারো ঘণ্টার ছিল। এখন আমার প্রতি দিন তিরিশ ঘণ্টার।’ উনি ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন তা বুঝিনি। তবে ওই রিভিউদাতা আরও এক লাইন জুড়ে দিয়েছিলেন এ প্রসঙ্গে। লিখেছিলেন, ‘স্মার্টফোনের মতো এত শুঁড় নেই বোতাম-টেপা বেসিক ফোনের। দিনে কম করে ছ’ঘণ্টা এখন আমি নিজের জন্য পাই। যন্ত্রের বদলে নিজের সঙ্গে কথা বলি। এ আনন্দের মর্ম আলাদা।’ অন্য এক জন বলছেন, ‘স্মার্টফোন থেকে এই ফোনে শিফট করার পরে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলার পরিমাণ কমেনি কিন্তু মোটেই। যেটা কমেছে তা হল, কথা ছাড়া ফোনের ভুলভাল ব্যবহার। ওই বাড়তি সময়টা আমি নিজের কাজে লাগাচ্ছি। বহু বছর পরে ছবি আঁকার অভ্যাসটাকে ফিরিয়ে আনলাম। সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য ব্যবহার করা শুরু করেছি ল্যাপটপ। সামাজিকতাও হল। কিন্তু তার সঙ্গে এঁটেও থাকা হল না। বন্ধুরা, আইডিয়াটা কেমন?’

কবীর সুমনের ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’ গানটা শুরু হয়েছিল অনেক কিছুর সঙ্গে পুরনো অভ্যেসও ছেড়ে দেওয়ার অনুষঙ্গ দিয়ে। তবে এখন দেখছি, ফেলে-আসা অভ্যেস কিংবা পুরনো চর্চাও গয়নাগাঁটি পরে হাজির হচ্ছে এই সময়ে, গটগটিয়ে। চশমার সর্বভারতীয় অভিজাত বিপণিতে দেখেছি, উত্তমকুমার বা বিকাশ রায়ের মোটা কালো চশমার ফ্রেম হাজির হয়েছে ফের। এটাই নাকি এখন ট্রেন্ড। বিস্মৃতপ্রায় গ্রামোফোন রেকর্ড আবার নতুন করে আসছে বাজারে। এক-একটি রেকর্ডের দাম হাজার তিনেক টাকা। ডি-জে যুগের পরে আভিজাত্য লেপে-দেওয়া গান শোনার পরিসরে এটাই নাকি এখন ‘ইন থিং’। এথনিক সামগ্রীর সঙ্গে মিশছে স্টাইল। দাম বাড়ছে চড়চড়িয়ে।

পরিসংখ্যান বলছে, ঠিক একই রকম ভাবে ফিরে আসছে হারিয়ে যাওয়া বেসিক ফোনও। গায়ে বসছে প্রযুক্তির ঝালর, তবে তা নির্মেদ। কথা হবে ফোর জি-তে, একেবারে ঝকঝকে। তবে দেওয়া থাকবে ততটুকুই, যতটা কথা বলা এবং মেসেজ করার জন্য লাগে। ইন্টারনেট? থেকেও নেই। সমাজমাধ্যম বা ইমেলের হাতে-গোনা কয়েকটি আইকন জুড়ে দেওয়া থাকছে। কিন্তু, ইচ্ছে করেই সেগুলো বানানো হচ্ছে সাদামাটা ভাবে। এক বার ব্যবহার করলে আর ওমুখো হতে ইচ্ছে করবে না। অন্তত ওই ফোনে।

ফোন করা আর বার্তা পাঠানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না বলে এমন ফোনের নাম দেওয়া হয়েছিল ডাম (dumb) ফোন। নামের উপরে ছড়ানো ছিল ব্যঙ্গের পাউডার। তবে অবাক করা তথ্য হল, স্মার্টফোনের আবির্ভাবে ক্রমশ তলিয়ে গেলেও আবার জেগে উঠছে বেসিক ফোন, বিশ্ব জুড়ে। সংখ্যাতত্ত্বের কচকচানিতে যাচ্ছি না। কিন্তু মোবাইল ফোনের বিক্রির বাজারে প্রতি দিনই তাদের শেয়ার বাড়াচ্ছে এই ডাম, বেসিক ফোন। একটি সমীক্ষা বলছে, আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে অন্তত পাঁচ শতাংশ বিক্রি বাড়বে এ রকম সাধারণ ফোনের। এ প্রসঙ্গে চোখে পড়ল একটি বিশ্ববিখ্যাত মোবাইল ফোন প্রস্তুতকারক সংস্থার ব্লগ। তারা বলছে, “প্রযুক্তি নিয়ে সম্পৃক্ত হতে হতে মানুষ এ বারে একটু অব্যাহতি চাইছেন। যন্ত্রের মূল কাজটিকে বজায় রেখে তার সঙ্গে জুড়ে দিতে চাইছেন নস্ট্যালজিয়া। মানুষ চাইছেন, তাঁদের নিজেদেরই হাতে গড়ে তোলা জটিল জীবন এ বারে খানিক শান্ত হোক।” এটাই হয়তো ফিচার ফোনের ফিরে আসার মূল কারণ এ বাজারে। আরও একটি শব্দ চোখে পড়ল। ডিজিটাল ডিটক্সিং। বাংলায় কী বলা যায় জানি না। সংখ্যাগত বিষমুক্তি? নাহ! বড্ড খারাপ শোনাচ্ছে।

নেট-দুনিয়ায় উঁকি দিয়ে বুঝতে পারি, ‘স্মার্টফোনকে ঘেন্না করি আমি’, এ প্রসঙ্গে প্রতি দিনই লেখা হয়ে চলেছে অগুনতি ব্লগ। তার বেশ কয়েকটি পড়ে মনে হল, বিরক্তির মূল কারণ এমন ফোনের অবিরাম জেগে থাকা এবং কয়েক হাজার নোটিফিকেশনের অজস্র বিরামহীন ধ্বনি। এক জন লিখেছেন, ‘চুপ করে থাকার অভ্যাস এই অসভ্য ফোনের নেই।’ এক জন আবার কাব্য করেছেন খানিক। লিখেছেন, ‘সব শেষে শব হয়ে গেলেও জেগে থাকবে অ্যাপ-ধ্বনি। ধিক তোরে, স্মার্টফোন।’ এঁদেরই একটা অংশ হয়তো বেসিক ফোনকে তাঁদের জীবনে বরণ করে নিচ্ছেন আবার। অতিযান্ত্রিকতা থেকে ছুটি নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন পুরনো দিনের অভ্যাসে। আর তাকে ভালবেসে ফেলছেন। স্মার্ট থেকে বেসিক ফোনে পরিবর্তনের পরে আমার এক বন্ধু মৃদু হেসে বলেছিল, “ফোনে নয়, মনে মোর পাখি আজ গান গায়।”

আধুনিক মোবাইল ফোনের আরও আধুনিক হওয়ার মহীরুহসম অ্যালগরিদমে হয়তো এর প্রভাব পড়বে না কিছু। চন্দ্রযানের যুগে, ১০৮ মেগাপিক্সেল রিয়ার ক্যামেরার যুগে পিছিয়ে পড়ার সাধ্য আমাদের নেই। তবে ওয়াকিবহাল শিবিরের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তুমুল প্রযুক্তিপূর্ণ বটবৃক্ষের পাশে জন্ম হয়েছে ছোট্ট একটা চারাগাছের। সে অতশত প্রযুক্তি বোঝে না। মুছে গিয়েছিল। নতুন পাতা নিয়ে তার পুনর্জন্ম হয়েছে। আর আনন্দের কথা হল, পাতার পাশে পাতা গজাচ্ছে রোজ। হালকা সবুজ রংটা আমাদের ভালবাসায় ভর করে রূপ নিচ্ছে গাঢ় সবুজে।

একই সঙ্গে বলা যায়, বহু মানুষের নিজের জন্য সময় বেড়ে চলেছে রবারের মতো।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement