বেড়াজাল: ভবিষ্যতের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে আস্থা। মেক্সিকো সিটিতে মার্কিন দূতাবাসের সামনে। ছবি: এএফপি
হঠাৎ উপড়ে ফেলার, ছিঁড়ে নেওয়ার মহাযজ্ঞ, আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্তে। মা-বাবার কাছ থেকে শিশুদের টেনেহিঁচড়ে আলাদা করে দেওয়া হল। কারণ এই শিশুদের মা-বাবারা বেআইনি ভাবে মেক্সিকোর সীমানা পেরিয়ে আমেরিকায় ঢুকে পড়েছিলেন। ভেবেছিলেন আমেরিকার মতো দেশ, মোটামুটি চলে যাবে জীবনটা। থাকাথাকি নিয়ে তর্কবিতর্ক, ঝামেলাঝাঁটি হবে বটে, অশান্তি, পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদও হবে, কিন্তু সত্যি সত্যি তাড়িয়ে দেবে না আমেরিকা। এই দেশটা তো চিরদিন সবাইকে আশ্রয়ই দিয়েছে। বেমক্কা ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার পাতে ছিটকে এসে পড়বেন আর টিকেই যাবেন, এ কথাটি ভাবা হয়নি!
কিন্তু তিনি এলেন, এবং ভোটের লড়াইয়ে যে অবিশ্বাস্য রকমের ভয়ানক প্রতিশ্রুতিগুলি হাঁকিয়েছিলেন সেগুলো ধরে ধরে আক্ষরিক অর্থে সত্যি করে তুলতে লাগলেন। তার মধ্যে মেক্সিকোর অবৈধ অভিবাসীদের আমেরিকা থেকে উৎখাত করার কথাটিও ছিল। অতএব হুকুম জারি হল: আমেরিকায় থাকার বৈধ কাগজপত্র ছাড়া যারা আমেরিকায় রয়েছে, তাদের সীমানা পার করে দেওয়া হবে। কিন্তু এ দিকে আবার দেশে আইন আছে: যে শিশু মার্কিন মুলুকে জন্মাবে সে জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক। মেক্সিকোর অভিবাসীদের যে শিশুরা আমেরিকাতেই জন্ম নিয়েছে, তারা মার্কিন নাগরিক। সুতরাং শুরু হল এক ভয়ানক কাণ্ড। মা-বাবাকে জোর করে বর্ডার পার করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কারণ তাঁরা অবৈধ বাসিন্দা, আর তাঁদের শিশুদের আটকে রাখা হচ্ছে, কারণ তারা বৈধ নাগরিক।
চার দিক থেকে চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প তাঁর হুকুম একটু সংশোধন করে বলেছেন, বাচ্চাদের যেন মা-বাবার কাছ থেকে আলাদা করা না হয়। কিন্তু এই শিশুদের তাদের মা-বাবার কাছে ফেরত পাঠানোর আইনি এবং বাস্তবিক, দুই রকম সমস্যাই রয়েছে। আর কে বলতে পারে, ট্রাম্প কাল তাঁর মত বদলাবেন না? হাল্লার রাজার মতোই তো তাঁর মতিগতি!
আচ্ছা, জোর করে যখন মায়ের হাত থেকে টেনে ছাড়িয়ে নেওয়া হয় একটা পাঁচ কিংবা তিন কিংবা আট বছরের শিশুর হাত, তার যন্ত্রণা কী ভাবে বা়জে সেই শিশুর বুকে? যে ছোট্ট মানুষটা এখনও পৃথিবী গ্রহটা কী, কেমন, তা-ই বুঝল না ঠিক করে, সে হঠাৎ তার পরম আশ্রয়, তার মা-বাবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেল! আলাদা করে দেওয়া হল তাকে। এত ছোট শিশু তো মা-বাবার ভরসা ছাড়া আর কিছুই জানে না, সে কী করে বুঝবে ট্রাম্পের আমেরিকায় কেন তার মা-বাবা অবাঞ্ছিত!
আমেরিকার যে সব ডিটেনশন সেন্টারে এই শিশুদের রাখা হয়েছে, সেখান থেকে দিনরাত্তির শুধু কান্নার শব্দ ভেসে এসেছে। বিরাট বিরাট ‘খাঁচা’র মধ্যে একসঙ্গে অনেক শিশু, সিমেন্টের মেঝেতে শুতে হয়, ঠিকঠাক বাথরুম নেই, দিনরাত আলো জ্বলছে, চোখে আলো লাগছে সারা ক্ষণ, স্নান করার ব্যবস্থা নেই— সব মিলিয়ে শিশুরা ভয়ের কুণ্ডলী। অনিশ্চিত সমুদ্রে খাবি খাওয়া ইতস্তত কিছু প্রাণ। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হল মা-বাবার কাছ থেকে আলাদা হওয়ার অসহায় নিরাপত্তহীনতা। এটাই তাদের মনগুলোকে একেবারে তছনছ করে দিয়েছে।
এতটাই তছনছ যে সেই মনকে পুরোপুরি সুস্থির করা, সুস্থিত করা হয়তো আর কখনও সম্ভব নাও হতে পারে। যে পরিমাণ মানসিক চাপ এই শিশুদের নিতে হয়েছে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন তার ফল হতে পারে সাংঘাতিক। একটা শিশুকে তার নিরাপত্তার গণ্ডি থেকে ছিনিয়ে নিলে তার স্বাভাবিক বেড়ে ওঠাতেই ছেদ পড়ে। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগাযোগের যে প্রধান সূত্র, সেই মা-বাবার আশ্রয় থেকে টেনে বার করে একটা রুক্ষ পৃথিবীর জমিনে এনে ফেলে দেওয়া হয়েছে তার শৈশবকে— তার উপর মানসিক চাপ পড়বে না? তার অস্তিত্ব ছড়িয়েছিটিয়ে যাবে না?
সীমান্তে মা-বাবার কাছ থেকে বাচ্চাদের আলাদা করে দেওয়া কি কেবল নীতির প্রশ্ন? শুধুমাত্র মানবাধিকারের প্রশ্ন? এই প্রশ্নগুলো আছে অবশ্যই, কিন্তু তার পাশাপাশি আছে আর একটা প্রশ্ন। এই আলাদা করে দেওয়ার ফলে শিশুদের মনের উপর আর তাদের জীবনের উপর কী প্রভাব পড়ে, সেই প্রভাব কতটা স্থায়ী হয়, সেই প্রশ্নটাও খুব বড়। মা-বাবার কাছ থেকে দীর্ঘ দিন আলাদা থাকার যে সাংঘাতিক প্রভাব পড়বে এই ছোট্টদের মনে, বিশেষজ্ঞরা তাকে বলেন ‘টক্সিক স্ট্রেস’ অর্থাৎ বিষময় মানসিক চাপ। তাঁদের মতে, এমন বিচ্ছেদের ফলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক গঠনের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়তে পারে। ঠিক এই কারণেই শিশু বিশেষজ্ঞরা বার বার প্রতিবাদ করেছেন ট্রাম্পের এই বিচ্ছেদ-নীতির। আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব পেডিয়াট্রিক্স জানিয়েছে, ‘শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষা ও উন্নতির জন্য আমরা যা যা ভাল বলে বিশ্বাস করি, তার ঠিক বিপরীত হচ্ছে এই বিচ্ছেদ। পরিবারের থেকে শিশুকে আলাদা করে দেওয়ার ফলে তার যে ক্ষতিটা হয়, তা আর প্রায় কখনও পূরণ হয় না।’ টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন মনোরোগ বিদ্যার অধ্যাপক বলেছেন যে, আলাদা হওয়ার জন্য শিশুরা যে ভয়ঙ্কর মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তা হল আসলে আত্মার খুন, ‘সোল মার্ডার’। এ হল এক জন মানুষের জীবনের ভালবাসা ধ্বংস হয়ে যাওয়া। মা-বাবার থেকে শিশুকে আলাদা করে যে হিংসা তার প্রতি করা হল, সেই হিংসাই শিশুটির আত্মাকেও খুন করল।
মা-বাবার কাছ থেকে ছোট বেলায় আলাদা হওয়ার ফলে একটি শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা অত্যন্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার মানসিকতাটাই, স্বভাবটাই পালটে যায়। সে হয়তো হাসিখুশি, গান ভালবাসা একটা ছেলে কিংবা ছবি আঁকতে ভালবাসা, দুষ্টুমি ভরা একটা মেয়ে— তার বদলে হয়ে গেল ভীতু, গোমড়া, তটস্থ, টেনশন করা একটা মানুষ। আমরা প্রতিনিয়ত এই ধরনের হিংসা এবং তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হতে দেখি বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে। আর যেহেতু প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা, তাই এই দীর্ঘ মানসিক চাপ কার ওপর কেমন প্রভাব ফলে, অঙ্ক কষে তার কিছু বলা যায় না। কে কতটা চাপ সহ্য করে, বা কাটিয়ে উঠে, ‘স্বাভাবিক’ জীবনযাত্রার জন্য জুতসই হয়ে উঠবে, সেটা তার মানসিক গঠনের ওপর নির্ভর করবে। কেউ খুব বেশি সংবেদনশীল হলে ভবিষ্যতে কুঁকড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক তার পক্ষে। মানুষের সঙ্গে মিশতে না চাওয়া, নিজেকে যে কোনও কাজের অযোগ্য মনে করা, সব কিছুতেই ভয় পাওয়া— এ সব অনুভূতিই তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে। যেহেতু খুব আশ্রয়হীন জীবন কাটিয়ে বড় হয় এরা, তাদের সেই দগদগে যন্ত্রণা থেকে জন্ম নেয় নিজেকে অপছন্দ করার, সবার থেকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা। ফলে তকতকে জীবনের সাফল্যও তাদের কাছে কম ধরা দেয়। পারিবারিক জীবনেও তারা যে খুব স্বাভাবিক থাকে, তেমনটা নয়। আপাত-স্বাভাবিক দেখালেও মনের নানা স্তরের জটিলতা ক্রমাগত তাদের অস্বস্তিতে রেখে দেয়।
আমরা তো এমন মানুষ দেখেছি, যে এক দিন খুব দুরন্ত, প্রাণবন্ত, মিশুকে ছিল। হস্টেল যাওয়ার পর কী হল কে জানে, একেবারে বদলে গেল ছেলেটা। হয়ে উঠল রাগী, বেয়াড়া, মুখে মুখে জবাব দেওয়া, এবং একলা থাকা একটা মানুষ। অথচ আমরা তো সবাই তার ভাল চেয়েছিলাম বলেই তাকে হস্টেলে পাঠিয়েছিলাম। হস্টেলের ঘর অন্ধকার করে যখন সে কাঁদছিল, তখন আমরা জানতাম কি— তার দরকার এক আশ্চর্য ঝাপ্পি, জাদু কি ঝাপ্পি! যার নাম অক্সিটোসিন। এটি একটি হরমোন। এই হরমোন শিশুর শরীরে নির্গত হয় যখন মা বা বাবা বা অন্য কোনও প্রিয়জন তাকে আদর করেন, কোলে টেনে নেন, চুমু খান তার গালে। তাতে লাভটা কী? ঘটনা হল, আমাদের মনে কোনও কারণে যে স্ট্রেস হয়, অক্সিটোসিন তাকে প্রতিহত করে। সেই স্বাভাবিক ওষুধটা যদি না থাকে, তা হলে শিশুরা একটা মানসিক আঘাত পেলে তার প্রতিক্রিয়াটা কমতে চায় না, মানে স্ট্রেসটা চলতেই থাকে। তখনই সেটা হয়ে দাঁড়ায় ‘টক্সিক স্ট্রেস’। মা-বাবার থেকে আলাদা হওয়ার সময় অক্সিটোসিন হরমোনও যে বনবাসে চলে গেল, আর তার ফলে মানসিক চাপ সহ্য করার স্বাভাবিক সামর্থ্যেরও ক্ষয় হল তার, তীব্র আঘাত পেল শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য। কিন্তু ট্রাম্প এবং তাঁর প্রশাসনের লোকেরা সে সব নিয়ে মাথা ঘামাবেন, এমনটা ভাবাও বোধহয় চূড়ান্ত বোকামি।
ওঁদের নীতি এবং পদ্ধতি এমনই যে ইচ্ছে করলেও মাথা ঘামানো কঠিন। আমেরিকার আধিকারিকরা এই ছোট্ট ‘কোমল বয়সের’ বিচ্ছিন্ন শিশুদের জন্য বিশেষ ধরনের থাকার ব্যবস্থা করেছেন। যেখানে কয়েক মাসের হামাগুড়ি দেওয়া বাচ্চা থেকে বছর তিনেকের শিশুরা থাকতে পারে। এক জন গবেষক টেক্সাস-এর এ রকম একটি শেল্টারে গিয়েছিলেন। ব্যবস্থা খুবই ভাল। ‘বাড়ির’ মতোই পরিবেশ। খেলনা, বই, শোওয়ার কট, সবই আছে, কিন্তু বাচ্চাগুলো আশ্চর্য রকম চুপ। কেউ কেউ খেলনা নিয়ে খেলছে, কেউ সম্পূর্ণ শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। একটি মেয়ে ঘরের মাঝখানে বসে সমানে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে আর হাতটাকে মুঠো করে মাটিতে মারছে। দেখাশোনা করার মহিলা মেয়েটিকে খেলনা, বই এগিয়ে দিচ্ছে কিন্তু কোলে তুলে নিয়ে ভোলাতে পারছে না। কারণ, কর্মীরা কেউ বাচ্চাদের কোলে নিতে পারবে না— কঠোর নির্দেশ। যে স্নেহের স্পর্শ তাদের সবচেয়ে প্রয়োজন, তা থেকে আইন মোতাবেক শিশুদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।
এই শিশুদের যন্ত্রণার কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই বলেছেন। সেই সূত্রেই কেউ কেউ বলেছেন নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা। নিজের জীবনে কোনও কারণে অভিভাবকদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের ভয়াবহ কান্না-বেলার কথা। ‘হলোকস্ট’-এর স্মৃতিও বলেছেন অনেকে। যে সব শিশু কোনও ভাবে বেঁচে গিয়েছিল তখন, সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা তাদের পরবর্তী জীবনকে কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে, তার কথা। এখন তাঁদের বয়স আশি-নব্বইয়ের কোঠায়। তবু আজও তাঁরা স্মরণ করেছেন, তাঁদের মা-বাবার থেকে আলাদা হওয়ার মন-কেমন সারা জীবন মনটাকে তিক্ত করে রেখেছে, পৃথিবীকে অযথা অবিশ্বাসের চোখে দেখতে শিখিয়েছে। নিউ ইয়র্কের একটি এনজিও-র অধিকর্তা জানিয়েছেন, তিন বছর বয়সে তিনি তাঁর মা-বাবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যান। তাঁর মতে, এক বার এই ভাবে ছিন্নমূল হয়ে গেলে কোনও কিছুই আর এক রকম থাকে না, পরবর্তী জীবনে যত আদর-ভালবাসায় সে থাকুক না কেন। তিনি বলেছেন, একটা ছোট্ট শিশু আর তার মা, আসলে দুটো আলাদা মানুষ নয়, এক জনই— একটাই অস্তিত্ব তাদের। সেই শিশুকে যখন তার মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়, তখন সেটা অপরাধ, ক্রাইম।
মার্কিন অভিবাসন দফতর জানিয়েছে, এই বাচ্চাদের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারের সহানুভূতি রয়েছে। যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে তারা যেতে বাধ্য হচ্ছে সেটা সত্যিই কষ্টের। কিন্তু আইন বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। তাদের মা-বাবারা আইনভঙ্গ করেছিল বলেই এই পদক্ষেপ করতে হয়েছে তাদের।
আইনকানুন তার জায়গায় থাকুক, ডোনাল্ড ট্রাম্পও হোয়াইট হাউসে বিরাজ করুন। কিন্তু মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন যে বাচ্চা মেয়েটা ডিটেনশেন সেন্টারে সমানে কেঁদে যাচ্ছে, আর নামতার মতো একটা নম্বর আউড়ে চলেছে, তার আন্টির ফোন নম্বর, সেই মেয়েটার কী হবে! তার মুখে একটাই আকুতি: ‘আমার আন্টিকে একটা ফোন করে দাও, প্লিজ। আমি আর কোনও দুষ্টুমি করব না, আমি খুব ভাল হয়ে থাকব, আমি সব কথা শুনব। আমায় এখান থেকে নিয়ে যাও প্লিজ, প্লিজ...’