ঠিকানা: ব্যঞ্জনহেড়িয়ায় এই বাড়িতে থাকতেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়
এ সময় তাঁকে চেনে না। তিনিও অনেক দূরে সাম্প্রতিকতা থেকে। স্মৃতি আঁকড়ে কার্যত নিভৃত-নিঃসঙ্গে সালেমন বিবি। বজবজের ব্যঞ্জনহেড়িয়ায় সেই নিভৃতিতে কখনও কখনও জেগে ওঠে তাঁর সুভাষকাকার স্বর। কথা বলেন মনে মনে।
‘‘আমার আর কী আছে বলুন, এই দুঃখ আর অশ্রু ছাড়া? চোখের জলটুকুই রাখি তাঁর পায়ের কাছে।’’ অশক্ত শরীরে হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলি বলে একটু থামেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘সালেমনের মা’ কবিতার সেই সালেমন। দৃষ্টি অস্বচ্ছ, দীর্ঘ দিনের নেত্রনালির রোগ। কিছু ক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ভারী হয়ে আসে চোখের পাতা। বুজে যায়।
ছিয়াত্তর-উত্তীর্ণ ভাঙাচোরা শরীরে রোগ আর দারিদ্রের নানা ছোপ। তবু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথা উঠলে যেন চনমনে হয়ে ওঠেন। বার বার ধরে আসা গলা ঝেড়ে বলতে থাকেন কথা। ‘‘ওই তো ও বাড়িতে থাকতেন সুভাষকাকা আর গীতাপিসি। বাড়িওয়ালি ছিল খতেজান বিবি। সামনে পুকুর, তখন জলটা এত পরিষ্কার ছিল না। আমাদের খুব ভালবাসতেন। আমার একটা ফোটোও তুলে দিয়েছিলেন সুভাষকাকা। মাথায় ধানের বোঝা চাপিয়ে। ওই প্রথম আমার ক্যামেরা যন্ত্র দেখা। ছবিও ওই প্রথম। অনেক কাল কাছে রেখেছিলাম। ওটাও আর নেই। কোনও শহুরে মানুষ তো এত ভালবেসে আমাদের সঙ্গে মেশেনি।’’ গলা ধরে আসে সালেমনের।
৬২ বছর আগে ওই মেয়েকে নিয়েই ‘সালেমনের মা’ লিখেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। কবিতায় ছোট্ট সালেমনের অসহায়তা আর কষ্ট দেখেছি আমরা। ছ’দশক পর সেই অসহায়তা যেন আরও তীব্র, ভয়ংকর।
৭৩ ফকির মহম্মদ খান রোড, গ্রাম ব্যঞ্জনহেড়িয়া, বজবজ, ২৪ পরগনা। ৬৬ বছর আগে, ১৯৫২ সালের গ্রীষ্মে বছর তেত্রিশের এক বাঙালি কবি তাঁর ইউরোপ-ফেরত স্ত্রী গীতাকে নিয়ে উঠলেন এই ঠিকানায়। ছোট্ট মাটির বাড়ি। দু’টো পাশাপাশি ঘর, সামনে বারান্দা। আছে এক ফালি উঠোনও।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় নামের সেই তরুণ কবি পরে লিখছেন, ‘নেমেছিলাম চড়িয়ালে। গ্রাম ব্যঞ্জনহেড়িয়া। চটকল আর তেলকলের মজুরদের বাস। মাটির ঘর। সামনে এঁদো পুকুর। আঠারো টাকা ভাড়া। দু’জনেই সর্ব ক্ষণের কর্মী। বিনা ভাতায়। লেখালেখি থেকে মাসে সাকুল্যে আয় পঞ্চাশ টাকা। একে অনিশ্চিত, তাও পাঁচ-দশ টাকার কিস্তিতে। তাই সই। চলো বজবজ।’ এই বাড়ির কয়েকটি বাড়ি পরেই ছিল সালেমনদের বাড়ি। বাড়ি বলতে মামাবাড়ি। সালেমনকে নিয়ে তাঁর মা লতিমন বাপের বাড়িতেই থাকতেন।
সালেমন, এখন যেমন।
সুভাষ-গীতার বাড়ির দরজা সকলের জন্য খোলা থাকত। ছোট্ট সালেমন একমাথা এলোমেলো চুল নিয়ে প্রায়ই এসে দাঁড়াত কবির বারান্দায়। সঙ্গে বন্ধু সাকিনা। লেখায় ব্যস্ত কবিকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলত নানা প্রশ্নে। ‘‘এই সালেমনই ছোটবেলায় বারান্দায় উঁকি দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী কর তুমি?’ ও জানতে চেয়েছিল আমি পেট চালাই কেমন করে। বলেছিলাম, ‘আমি লিখি’। শুনে অবাক হয়ে বলেছিল, ‘বা রে, লিখে কেউ টাকা পায় নাকি? লেখাপড়া করতে গেলে তো টাকা দিতে হয়।’ খুব মিথ্যে বলেনি, হাড়ে হাড়ে আজ টের পাচ্ছি।’’ লিখেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তাঁর ‘আবার ডাকবাংলার ডাকে’ নামক গদ্যগ্রন্থে।
বজবজে শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করার দায়িত্ব নিয়ে এই কমিউনিস্ট দম্পতি ব্যঞ্জনহেড়িয়ায় পৌঁছন ১৯৫২-র মে মাসে। ’৫৪-র অক্টোবরে তাঁরা ফিরে আসেন কলকাতায়। কেমন ছিল তাঁদের বছর আড়াইয়ের বজবজ পর্ব? তথ্য বলছে, ভোরবেলায় উঠে সুভাষ চলে যেতেন একের পর এক কারখানায় গেট মিটিংয়ে। তার পর বাড়ি ফিরেই ন্যাশনাল লাইব্রেরি। সেখানে তখন চলছে নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙালির ইতিহাস’-এর কিশোর সংস্করণ তৈরির কাজ। সন্ধেয় ফিরে পার্টি অফিস বা ইউনিয়ন অফিস, কখনও বস্তিতে কোনও ছোট সভা। ওখানেই কোথাও দেখা হয়ে যেত গীতার সঙ্গে।
অনেক রাতে ‘দুজনে যখন ফিরি, দূর থেকে আমাদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে ছুটতে ছুটতে আসে দোআঁশলা কুকুর বিলি আর তার ল্যাজে ল্যাজে আমাদের বেড়াল রুসি।’— লিখেছেন সুভাষ। এর সঙ্গেই গীতা চালাতেন অবৈতনিক স্কুল, ‘প্রতিভা পাঠশালা’। শ্রমিকদের বাড়ির মা-মেয়ে-স্ত্রী যেখানে অক্ষর চিনতেন।
সালেমনের সাক্ষরতার পাঠও এইখানেই। তাঁর মনে আছে, গীতাপিসি তাঁকে খবরের কাগজ পড়তেও শিখিয়েছিলেন। অনভ্যাস আর ‘চোখের জ্বালা’য় সেই সব নেশা এখন একেবারে গিয়েছে। শুধু এটুকুই স্পষ্ট মনে আছে, পুকুরপাড় দিয়ে যাতায়াতের সময় সুভাষকাকা বার বার বলতেন, ‘‘সাবধানে, সাবধানে সালেমন। ছুটে যাবি না। আস্তে হাঁট।’’ সেই পুকুরের অবস্থা তো তখন ভয়াবহ। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নিজের কথায়— ‘পুকুরটা আকণ্ঠ বুঁজে আছে পাতা-পচা ছ্যাতলায়। জলের ওপর যেন কেউ বিছিয়ে দিয়েছে একটা তেলচিটে চাদর। তার মাঝখানে বিজগুড়ি কাটছে বেলফুলের কুঁড়ির মতো অসংখ্য বুদবুদ।’
অতীত: ‘সালেমনের মা’ কবিতার অংশ।
জানা যাচ্ছে, খাওয়া ছাড়া অন্য সমস্ত কাজে একমাত্র ভরসা ছিল এই পুকুরের জল। এই জলের কারণেই কিছু দিনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন গীতাদেবী। কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ও সবে পরোয়া নেই। তাঁর কথায়, ‘অল্প ক’দিনেই সয়ে গেল’ সেই জল। সালেমন বলছিলেন, ‘‘আমরা তো অবাক। শহুরে মানুষ, এ সব সইতে পারে!’’
সুভাষ মুখোপাধ্যায় অসুস্থ গীতাকে বার্নপুরে পাঠিয়ে আরও পুকুরপ্রেমী হয়ে উঠলেন। ছুটির দিনে ছিপ হাতে বসতে লাগলেন। যা উঠত, তা রান্না করে সব্বাই একসঙ্গে মিলে খেতেই তাঁর আনন্দ। মাছ কম উঠলে ঝোলা নিয়ে ছুটতেন চড়িয়াল বাজারে। বেলার দিকে সস্তা মাছ এনে ঢুকিয়ে দিতেন সালেমন কিংবা আহম্মদের মা কবিরণদের ঘরে। রান্না হলে সবার ভোজ— জানাচ্ছেন সালেমন।
আজও পুকুরের পাশ দিয়ে যাতায়াতের সময় তাঁর কানে বাজে ছোট্টবেলায় সুভাষকাকার সাবধানবাণী। সতর্ক হয়ে হাঁটেন। মনে আছে, বন্ধু সাকিনার অসাধারণ রূপের কথা। কবি-দম্পতি নাকি তাকে দত্তক নিতে চেয়েছিলেন। সাকিনার বাপ-মা’র আপত্তিতে হয়নি।
এই পুকুরপাড়েই সালেমনের বাবাকে দেখেছিলেন কবি? যার ঘোলাটে চোখ মিলে গিয়েছিল বজবজের আকাশের সঙ্গে? এখানে তিনি কোলে নিয়েছিলেন ছোট্ট সালেমনকে?
পাগল স্বামীকে ছেড়ে সালেমনের মা লতিমন বাপের বাড়ি চলে আসেন একরত্তি মেয়েকে নিয়ে। মামা শেখ সাজ্জাদ আলি কোলেপিঠে মানুষ করেন ছোট্ট সালেমনকে। যখন ওর বছর চারেক বয়স, তখন হঠাৎ এক বার আব্বু (বাবা) বাবরালি (প্রকৃত নাম হামিদ আলি খান) ফিরে এসেছিলেন তাঁর মেয়ে-বউয়ের কাছে। তাঁর মনের অসুখ অনেকটাই সেরে গিয়েছে তখন। ওই পুকুরপাড়েই বাচ্চা মেয়েটাকে ঘুরতে দেখে কোলেও তুলে নিয়েছিলেন সালেমনকে। কিন্তু লতিমনকে দেখে, আর গ্রামের সকলের হইহই চিৎকারে ভয় পেয়ে মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে রেখে সেই যে পালালেন, আর আসেননি কখনও।
এই ঘটনার কিছু দিন পরই মৃত্যু হয় তাঁর। লতিমন দ্বিতীয় বিয়ে করেন খন্দেকর শাহিদ ইসলামকে। একটু বড় হয়ে এ সব জেনেছেন সালেমন তাঁর মামার কাছে, আর মনে মনে খুঁজেছেন হারিয়ে যাওয়া বাবাকে। সমসাময়িকতা ছিঁড়ে তাঁর মন সব সময় আশ্রয় খোঁজে সুদূর অতীতেই— ‘‘এই সময়ের কিছুকেই আমার নিজের বলে মনে হয় না। আমি ওই ফেলে আসা দিনগুলোতেই শ্বাস ফেলি। কেবল ওই দিনগুলোর কথা ভেবেই বাঁচি।’
১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসে পাকাপাকি ভাবে ব্যঞ্জনহেড়িয়ার পাট ছেড়ে আসার পরও কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেনি বজবজের। দু’দশক পর আবারও তাই ফিরে আসবেন তিনি এখানে। ফিরে আসবেন সালেমনদের নৈকট্যে। লিখবেন— ‘এই কুড়ি বছরের মধ্যে যে পরিবর্তনটা হয়েছে, তার বেশির ভাগটাই মানুষের শরীরে। নাবালকেরা সাবালক, মাঝবয়সিরা বুড়ো আর বুড়োদের অনেকেই গিয়েছে টেঁসে। কী মিষ্টি দেখতে ছিল ছোট্ট সাকিনা। তার সেই চকচকে ভাব চলে গিয়ে কীরকম মিইয়ে গিয়েছে। কোলে তার পনেরো দিনের ছোট্ট বাচ্চা। এই নিয়ে তার চারটি হল। বিয়ের জল গায়ে পড়ার পর এক বার দেখে গিয়েছিলাম সালেমনকে। কী সুন্দর যে দেখতে হয়েছিল কী বলব।
‘দেখি উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে আছে সালেমন। ওর কোলেও তিন মাসের ময়না। এটা নিয়ে ওর ছ’টা হল।’
প্রান্তিক এই মানুষগুলির সঙ্গে নিবিড় ভাবে মিশে যেতে পারতেন পদাতিক কবি। সেই নিবিড় সম্পর্কে যে কোনও খাদ ছিল না, সমগ্র ব্যঞ্জনহেড়িয়া তা আজও মর্মে মর্মে জানে, বিশ্বাস করে। ৬২ বছর আগে ১৯৫৬ সালে একটি পত্রিকার পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত ‘সালেমনের মা’ কবিতাটির প্রকাশ-মুহূর্ত সম্পর্কে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন— ‘‘একেবারে হুড়মুড় করে আসার দলে ছিল আমার ‘সালেমনের মা’ কবিতাটি। পকেটে কাগজ ছিল। লেগেছিল দু’কাপ চা। তা-ও খুব একটা ঠান্ডা করে খেতে হয়নি। কাটাকুটি হয়েছিল সামান্য। ‘সালেমনের মা’ কি আমার মনে কিংবা মাথায়
আগে থেকে সাজানোই ছিল? অনেক ভেবেও এ সব জিনিসের কূলকিনারা পাওয়া যাবে না।’’
আসলে তাঁর মনের বাস্তুভূমিতেই জেগে আছেন এই সব মানুষ। আর প্রবীণ সালেমনও তা জানেন। জানেন বলেই ব্যঞ্জনহেড়িয়া কখনও বিস্মৃত হয় না এই কবির স্পর্শ।
তাঁদের সুভাষকাকার সেই বাড়ি আজ বদলে গিয়েছে। বদলেছে সেই এঁদো পুকুর, সংলগ্ল রাস্তাঘাটও। ফকির মহম্মদ খান রোড নাম বদলে এখন হয়েছে হাজি মহম্মদ মহসীন রোড। কিন্তু কোনও এক অলিখিত পরম্পরায় এখানে ঘরে ঘরে বিশ্রুত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ‘পদাতিক’ কবির শতবর্ষে এলাকার সমস্ত মানুষ শামিল নিজেদের মতো করে উৎসবের আয়োজনে।
মেয়ের বাড়িতে থাকা অসুস্থ, অশক্ত শরীরের সালেমন আজ হয়তো এক বার চেষ্টা করবেন ওই পুকুরপাড়টায় এসে দাঁড়াতে। যদি নিভৃতে কিছুমাত্র অনুভব করা যায় সুভাষকাকার, বা হারিয়ে যাওয়া তাঁর আব্বুর অনুষঙ্গ!
’৪২-এর বর্ষা কিংবা ’৪৩-এর মন্বন্তরে খুব সম্ভবত জন্ম হয়েছিল তাঁর। এর বেশি কিছুই জানেন না তিনি। তিন ছেলে আর পাঁচটি মেয়ে— আট সন্তানের জননী সালেমন তাঁর স্বামীর (নাম শেখ সামাদ) মৃত্যুর পর এখন সত্যিই অসহায়, নিঃস্ব। বাঙালি কবিকুল এক বারও কি ভাববে না তাঁর কথা?