বহু কাল আগে ইমাম হুসেনের ট্রাজেডিকে স্মরণ করে। নদীর জল আটকে, নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের কোতল করা হয়েছিল সেখানে
Karbala

লাল পতাকার সঙ্গে কারবালার পথে

এখন নদীতে স্রোত নেই। তবু হরেক দেশের হরেক পতাকা নিয়ে লাখো জনতার ভিড়। হিন্দুস্থান থেকে এসেছি জেনে আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন আফগান বৃদ্ধ।

Advertisement

সৌরভ ষড়ঙ্গী

শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২১ ০৮:১৫
Share:

Advertisement

মার তখন টেবিলে বঙ্কিম আর লেপের তলায় শরৎ পর্ব চলছে। এর মাঝে বাঁধানো, পাতা হলুদ হয়ে আসা একটা বই হাতে দিয়ে বাবা বলল ‘পড়ে দেখো।’ হাসান-হুসেনের কাহিনি আমায় কাঁদিয়ে ছাড়ল। এক বার নয়, অনেক বার। ‘বিষাদ-সিন্ধু’, মীর মোশারফ হোসেন। আমার ছোটবেলা কেটেছিল কাঁথিতে। কাঁথির পুব-পশ্চিমে তখনও ধূ ধূ বালিয়াড়ি। পুব দিকে দারুয়া, সেখানে কারবালা প্রান্তর নামে একটা মাঠ, এখনও আছে। বাঁধানো দুটো গোর ছিল সাদা রঙের, মহরমের মেলা বসত প্রতি বছর, তার পর শুনশান।

একটা ই-মেল মনে করিয়ে দিল কারবালার কথা। কাঁথি নয়, খোদ ইরাকের কারবালা! প্রথমে পাত্তা দিইনি, মাসখানেক পর আবার খোঁচা, ‘আসছ তো? একটা ক্যামেরা আর সঙ্গে কাউকে নিয়ে এস, আরবাইনে আমরা সবাই আসছি।’ নড়েচড়ে বসলাম। পত্রপ্রেরক আমার চেনা ইরানি বন্ধু। কিন্তু আরবাইন বস্তুটি কী? গুগল করে চক্ষু চড়কগাছ, জানতামই না এই রকম একটা ব্যাপার আছে!

Advertisement

ইরাক দেশের নাজাফ খুব বড় শহর নয়, কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক বললে ভুল হয় না। পাশে বয়ে চলেছে ফুরাদ, মানে ইউফ্রেটিস। নদীর চেহারা হতাশাজনক। কলকাতার গঙ্গার চেয়েও ক্ষীণকায়া, প্রতিবেশী সিরিয়ার বাঁধনে ক্রমশ শুকিয়ে আসছে। ইসলাম ধর্ম চালু হওয়ার আগে এখানে খ্রিস্টপন্থী আর ইহুদিদের আড্ডা ছিল। মাটি খুঁড়লে এখনও পাওয়া যায় ক্রস আঁকা খ্রিস্টান কবর, তার ওপর মুসলিম গোর। পৃথিবীর সব চেয়ে পুরনো গোরস্থান এখানেই, আরবিতে নাম ‘ওয়াদি উস সালাম’, মানে শান্তি উপত্যকা। হাজার বছর ধরে কত কোটি নরনারী এখানে শুয়ে, তার হিসেব করা অসম্ভব। এখনও শবের মিছিল অব্যাহত। তবে শিয়াপন্থী মুসলিম ছাড়া এখন অন্য কারও ঠাঁই নেই।

শিয়া-সুন্নি ব্যাপারটা আমার কাছে জট পাকানো বিষয়, এখানে এসে একটু খোলসা হল। জানতাম ইরান আর ইরাকে শিয়া মুসলিমরা সংখ্যায় বেশি, বাকি আরব দুনিয়ায় সুন্নিরা। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানেও তাই। শিয়া তীর্থ নাজাফে এসে একটু ভেতরে ঢুকে জানার সুযোগ ঘটে গেল। মৃত্যুর আগে মহম্মদের মুদ্রা-সঙ্কেত বোঝা সহজ ছিল না। এক দিকে বংশধর পরিবারের জন্য ঐশী নির্দেশ, আর অন্য দিকে বিচক্ষণ মুরুব্বির দল বা উম্মার আনুগত্য। শিয়া ইমাম বনাম সুন্নি খলিফা। আদর্শ এক রেখে নেতৃত্ব আর ক্ষমতার বিরোধ, যা আজও চলেছে এবং মেটার নয়। ১৪০০ বছর আগে কারবালার যুদ্ধ এই বিরোধেরই অনিবার্য পরিণতি, যা নাকি নবি মানসচক্ষে দেখতে পেয়েছিলেন!

ততদিনে বাগদাদ থেকে এসে গেছে ইরাকি ক্যামেরাম্যান উসামা, সঙ্গে মুশকিল আসান সহযোগী আবু মাসুমে, হাজির হায়দারও— ওর একটা গাড়ি আছে, শুধু স্টার্ট দেওয়ার অপেক্ষা। পাশে বসে খেয়াল করলাম উসামার হাতে লম্বা সেলাইয়ের দাগটা। গাড়িতে একটা বোমা রেখে গিয়েছিল কেউ। এ দেশে অমন হতেই থাকে, ও কিছু নয়! রাস্তায় মানুষের ঢল, বাচ্চাবুড়ো সবাই আসছে নাজাফের দিকে, মেয়েদের হাতে ঠেলাগাড়ির হাতল, তার ভেতর থেকে ছোট্ট ছোট্ট আঙুল হাত নাড়ছে। তরুণরা বয়ে নিয়ে চলেছে লম্বা নিশান। মহরম মাসখানেক আগে হয়ে গেছে, তা হলে এরা চলেছে কোথায়, কেন? মাথায় রাশি রাশি প্রশ্ন। মহরম হল আরবি ক্যালেন্ডারে বছরের প্রথম মাস, আর দশম দিন হল আশুরা, যে দিন সারা পৃথিবীতে মহরম পালন করা হয় উপবাস করে। সময় পিছিয়ে দিলে প্লাবনের মাঝে এই দিন নৌকো ভাসিয়েছিলেন নোয়া, মিশরের ফারাওয়ের হাত থেকে মোজেস ও অনুগামীদের বাঁচানোর জন্যে লোহিত সাগর ভাগ হয়ে গিয়েছিল অলৌকিক ভাবে, প্রথম বারের মতো মদিনা পৌঁছেছিলেন মহম্মদ, আর এই আশুরার পরের রাতেই ঘটেছিল কারবালার সেই অসম যুদ্ধ, এক দিকে মোটামুটি একশো মানুষ, বাচ্চা আর মেয়েদের নিয়ে। আর অন্য দিকে কয়েক হাজার সশস্ত্র সেনা।

শুনতে শুনতে কখন যে শহর ছাড়িয়ে একটা গ্রামে ঢুকে পড়েছি, খেয়াল করিনি। এখানেও বইছে ফুরাদ, টলটলে কাচের মতো জল, পাড়ে জলফড়িং আর আল দেওয়া ধানখেত। খেজুরের বদলে কয়েকটা নারকেল গাছ থাকলেই বাংলার গ্রাম বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। দূর থেকে পিঁপড়ের সারির মতো এগিয়ে আসছে গ্রামের মানুষ। একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে কয়েকটা খেজুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে টানাটানি শুরু করল। রাস্তার ধারে একটা তাঁবু খাটানো, এখানে বলে ম’কেব। হাতমুখ ধুয়ে সবাই চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে। একটু পরে বিরাট থালায় এল মাংসের সুরুয়া এবং পেল্লায় সাইজের রুটি। রুটির নাম তেন্নুর, আমাদের তন্দুরি রুটির জন্মরহস্য বোঝা গেল। বাচ্চা মেয়েটা বেজায় ব্যস্ত রাস্তা থেকে লোক ধরে আনতে, রান্নাবান্না ওর মা দাদিরাই করছে, বাবা বানাচ্ছে চা। ব্যবসা ভালই, ভেবে পকেটে হাত ঢোকালাম। সবাই এমন করে তাকাল যেন জ্যান্ত সাপখোপ বার করছি। এটা তীর্থযাত্রীদের জন্য ওই পরিবারের সেবা, সারা বছর ধরে পয়সা জমিয়ে জমিয়ে ওরা অপেক্ষা করছিল। কী ভাষায় ধন্যবাদ বলতে হবে ভাবতে ভাবতে হায়দারের গাড়ির বাঁশি বেজে উঠল। এ বার গন্তব্য কুফা।

নাজাফ থেকে খুব দূর নয়। কুফা মসজিদ পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো মসজিদগুলোর মধ্যে একটা। ঢুকতে গিয়েই চোখ আটকে গেল ভেতরের খিলানে, কাঠের অপূর্ব কারুকার্য। গম্বুজের ভেতরে ঢুকতেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়, সোনা রুপো মানিক কাচ আর ঝাড়বাতির রোশনাইয়ের সঙ্গে মিলেছে ধূপের গন্ধ, কিন্তু বেজায় ভিড়। শবাধারে এক বার হাত ছোঁয়ানো আর সেলফি তোলার চাপে ছিটকে বেরিয়ে এসে বিশাল চাতালে একটু স্বস্তি। হাজার সাল আগে এখানে বসত ন্যায়নীতির বিতর্কসভা। প্রথম ইমাম আলি ইবন আবি তালিব বিচার করতে বসতেন এখানেই। এই আলি ছিলেন হজরত মহম্মদের জামাই। বিচক্ষণ, মৃদুভাষী। সুবিচারের আশায় সবাই ছুটে আসত আলির কাছে। আলি-ই একমাত্র, যাঁকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে সুন্নিদের আপত্তি হয়নি। শোনা অনেকগুলো গল্পের মধ্যে একটা বিচারের গল্প বলি। কোনও এক মহিলার বিরুদ্ধে পরকীয়ার অভিযোগ, এবং তিনি গর্ভবতী, সেটা দেখলেই বোঝা যায়। সব শুনে আলি তাকালেন মহিলার দিকে। মহিলা বললেন, তিনি নির্দোষ এবং গর্ভে কোনও সন্তান নেই। সবাই হইহই করে উঠল। তাদের থামিয়ে আলি একটা বড় গামলায় জল ভরে আনতে বললেন, মহিলার প্রতি নির্দেশ হল তার ভেতরে গিয়ে বসতে, কিছু ক্ষণ পরে দেখা গেল অজস্র কৃমি বেরিয়ে এল মহিলার শরীর থেকে, পেট ফুলে উঠেছিল ওই কারণেই। বালিতে পুঁতে পাথর ছুড়ে মারার হাত থেকে অন্তত এক মহিলার প্রাণ বাঁচল।

বুঝতে পারছিলাম, ইসলাম ধর্মের গোড়াপত্তন করাটা মহম্মদের কাছে কতটা কঠিন ছিল। আরবদেশে তখন চলছিল এক বর্বর দশা। এক দিকে বিলাসী ব্যবসায়ী, অন্য দিকে যাযাবর লুঠেরা, মাঝখানে গরিব সাধারণের সন্ত্রস্ত পরিশ্রম। সামাজিক নিয়মকানুনের কোনও বালাই ছিল না। সেখানে অনাথ মেধাবী শিশু মহম্মদের বড় হয়ে ব্যবসায়ী মহলে প্রবেশ, প্রেম ও বিবাহ যতটা না চমৎকার কাণ্ড, তার চেয়ে বেশি চমকপ্রদ তাঁর শ্রেণিহীন সাম্য, ন্যায়, নীতি, সমাজে মেয়েদের অবস্থান ঠিক করা, এ সব নিয়ে কথা। এই কুফা মসজিদে প্রার্থনায় বসে, আগের খলিফাদের মতোই, আলির প্রাণ গিয়েছিল বিষাক্ত তরোয়ালের কোপে।

ঐতিহাসিক: কুফা মসজিদ চত্বরে তীর্থযাত্রীরা। ডান দিকে উপরে, ইমাম আলির স্মৃিতসৌধ, ওয়াদি উস সালাম। উপরে মূল ছবি, ইমাম হুসেনের স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের ভিড়। মোয়াজ্জিনের নমাজের সঙ্গে সঙ্গে আজও এখানে কান্নায় ভেঙে পড়েন লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থী

বেরনোর আগে চমক অপেক্ষা করছিল মসজিদের চাতালে। একটা ক্ষয়ে আসা পাথর দেখিয়ে উসামা বলল, এখানেই বাঁধা ছিল নোয়ার নৌকো। এখানে বসেই নাকি সেটা তৈরি হয়েছিল, মহাপ্লাবনে যা গিয়ে ঠেকেছিল আর্মেনিয়ার আরারাত পাহাড়ের গায়ে। ভাবলাম বলি আমাদের মনুর নৌকোর কথা, প্রলয়ের আগে বিষ্ণুর মৎস্যাবতার হিসেবে আবির্ভাব, কী ভেবে চেপে গেলাম। বাইরে তখন আসন্ন পূর্ণিমার চাঁদ মেঘেদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। ফিরতে হবে হোটেলে, কিন্তু আমার জুতোজোড়া খুঁজে পাওয়া গেল না। রাস্তার অবস্থা ভাল নয়, পদে পদে নুড়িপাথরের খোঁচা। খেয়াল করে দেখি, সবাই খালি পায়ে হাঁটছে জুতো হাতে।

ঝলমলে একটা সকাল অপেক্ষা করছিল পরের দিন। আজ আমার সঙ্গী ইরানি বন্ধু হোসেন, সে নিয়ে চলল নাজাফ শহরে ছড়িয়ে থাকা স্মৃতিসৌধগুলো চেনাতে। মানুষের ভিড়ে রাস্তায় হাঁটাই মুশকিল। রাতারাতি যেন ফুলে-ফেঁপে উঠেছে শহরটা। আল সাহ্‌লাহ্‌ মসজিদ থেকে হজরত সালেহ্‌র সমাধি, সেখান থেকে ইমাম আলির স্মৃতিসৌধ। আলির সমাধি নিয়ে একটা গল্প আছে। মারা যাওয়ার আগে তিনি চাননি শত্রুরা জানুক কোথায় তাঁর শরীরে মাটি দেওয়া হবে। মানুষ নয়, একটা উট তাঁর মৃতদেহ বয়ে হাঁটতে হাঁটতে নির্জন এক জায়গায় এসে দাঁড়াল। সেখানেই গোপনে সারা হয় তাঁর শেষকৃত্য। চোখের আড়ালে থাকা সেই সমাধি হরিণ শিকার করতে গিয়ে খুঁজে পান খলিফা হারুন আল রশিদ এবং গড়ে তোলেন এই সৌধ, বহু দূর থেকেও যার সোনায় মোড়া গম্বুজে আলো ঠিকরে পড়ে, সে দিন-ই হোক বা রাত। ভেতরের চাতালে কয়েকটা ফুটবল মাঠ ঢুকে যায়, ওপরে শামিয়ানা টাঙানো, তলায় কয়েক হাজার মানুষ। আলোর রোশনাইতে দেওয়ালের কাচ আর দামি পাথর ঝিকমিক করছে।

ইচ্ছে হল গম্বুজের ওপরে যাওয়ার। তার পর ওপর থেকে সেই দৃশ্য ভোলার নয়। এক দিকে আলোয় মোড়া নাজাফ শহর, অন্য দিকে এয়ারপোর্টের উঁচু সড়কে চলন্ত আলোর ফুলকি, অন্ধকারে ভূতুড়ে ওয়াদি উস সালামের সীমাহীন বিস্তার, কিন্তু তার ওপারে কী? চাঁদের আলোয় জল ঝিকমিক করছে! ওটা নাজাফ সাগর, আসলে একটা হ্রদ। নোয়ার নৌকো ওই পথেই ভেসে গিয়েছিল মক্কা, মিশর হয়ে আরও উত্তরে। সেই প্লাবনের দিনে সবই ছিল জলময়। এখন যে মরুর দেশ পশ্চিম এশিয়া দেখি, তা নাকি জেগে উঠেছিল পরে। কয়েক মুহূর্তে যেন যুগান্ত, বিশ্বাস-অবিশ্বাস আর কল্পনা একাকার হয়ে গেল।

স্মৃতিবিজড়িত: বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন মসজিদ কুফা। এখানেই বসত ইমাম আলির বিচারসভা। উপরে ডান দিকে, ইমাম হুসেনের স্মরণে প্রার্থনা।

নীচে নেমে অন্য জগৎ, অনেকের ঘাড়ে বাক্সপ্যাঁটরা, মানে এরা রাত কাটাবে রাস্তায়। খেয়াল করলাম হাতে ধরা অজস্র পতাকায় আঁকা এক জনের মুখ, সে হল হুসেন। ‘বিষাদ সিন্ধু’ পড়ে জানা ছিল নবির দুই নাতি হাসান আর হুসেনের কথা, মেয়ে ফতিমা আর আলির সন্তান, প্রিয় দাদুর খেলার সঙ্গী। চুক্তি ভেঙে হাসানের বদলে খলিফা মুয়াউইয়া ক্ষমতায় বসালেন নিজের ছেলে ইয়াজিদকে। তত দিনে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু মদিনা থেকে সরে গিয়েছে সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসে। বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে দামাস্কাসের তখন রমরমা, বাতাসে টাকা ওড়ে। তরুণ ইয়াজিদ গা ভাসাল বহুগামী বিলাসব্যসনে, চুলোয় গেল ইসলামের নীতিবাক্য। ভয়ে টুঁ শব্দটি কেউ করে না। ও দিকে হাসান ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত মক্কায়, তার প্রাণ গেল গুপ্তচরের হাতে বিষ খেয়ে। মাঠে নামল ভাই হুসেন, শিয়াদের দলপতি ইমাম হিসেবে নির্বাচিত হতে কোনও বাধাই তার আসেনি। দুই ভাইয়ের চরিত্র আলাদা। হুসেন সাহসী, প্রতিবাদী এবং আপসে অবিশ্বাসী। দাদা হাসানের মৃত্যু, তারও আগে অন্যায়ভাবে দুরাচারী ইয়াজিদের ক্ষমতায় আসা, এ সব তাকে জ্বালিয়ে বেড়ায়। আবার সে দাদার মতোই দয়ালু প্রেমিক, কেউ বিপদে পড়লে সবার আগে এগিয়ে আসে। জনপ্রিয়তায় তার ধারেকাছে কেউ আসে না। ইয়াজিদের এ সব সহ্য হয়নি, অবিলম্বে হুসেনের আনুগত্য দাবি করে সে চিঠি পাঠাল মদিনায়। হুসেন রাজি হয়নি, ব্যস, তুষের আগুন ধিকিধিকি জ্বলতে শুরু করল।

সব কথাই হচ্ছে রাস্তায় ফ্রুট-বার বা শিশাখানায় বসে। ইংরেজি, আরবি, ইরানির মাঝে পড়ে খাবি খাচ্ছি। আলোচনাটা ঘুরে গেল আর এক হুসেনের কথায়। সাদ্দাম হুসেন, ইমাম হুসেনের জনপ্রিয়তা তিনিও মেনে নিতে পারেননি, প্রবল শিয়া-বিদ্বেষ তো ছিলই। সাদ্দামের সাফ কথা, ইরাকে হুসেন একটাই, সেটা আমি। সব স্বৈরাচারীর মতো তাঁর নির্দেশ ছিল, বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে হয় তাকে জেলে পোরো, মিথ্যে অভিযোগে ফাঁসাও, নয় দেশদ্রোহী বলে খুন করো। এখানে ঢুকে পড়ল ইরাকের বিভিন্ন ধর্ম এবং জনগোষ্ঠীর জটিলতা। শুধু তো শিয়া-সুন্নির দেশ নয় ইরাক। ইহুদিরা পাততাড়ি গোটালেও রয়ে গেছে নানা মতাবলম্বী জনগোষ্ঠী, নগণ্য কিছু খ্রিস্টান। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হল কুর্দদের আধিপত্যে ঘেরা পাহাড়ি উত্তুরে অঞ্চল, যেখানে তেলের খনি রয়েছে। সেখানেই দায়েশ বা আইএসআইএস-এর শেকড় পাথরে গেড়ে বসেছে, যা পুরোপুরি উপড়ে ফেলা সোজা কথা নয়। ইরাকের কুর্দরা আচার-ব্যবহারে সুন্নি হলেও জরথুস্ট্র-র প্রাক-ইসলাম ঈশ্বরচেতনা ওঁদের আলাদা করে রেখেছে, ওঁরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজের দেশ। এত ভেদাভেদের দেশে তেলপিপাসু পশ্চিমের ঢুকতে সমস্যা হয়নি, সাদ্দামের ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন হয়ে ওঠা আমেরিকার হাতেই, একই জাদুদণ্ডে তাঁর পতনও অনিবার্য ছিল। মাঝখান থেকে ওয়াদি উস সালামের কবর উপড়ে সাঁজোয়া গাড়ির রাস্তা তৈরি হল ইরাক যুদ্ধের সময়। ইমাম হুসেনের স্মৃতিসৌধ কামানের গোলায় উড়িয়ে টাঙানো হল সাদ্দাম হুসেনের ছবি। হুসেনের স্মৃতিতে হাজার বছর ধরে চলে আসা কারবালার পদযাত্রা বারণ হল।

নাজাফ ছেড়ে সেই কারবালার রাস্তায় এ বার আমাদের হাঁটা শুরু। এখানেই হায়দারের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি! কারবালা কোন দিকে দেখিয়ে চোখের জল লুকিয়ে চলে গেল সে। আর আমরা মিশে গেলাম সামনে গড়িয়ে চলা জনস্রোতে। নাজাফ থেকে ৭০ কিলোমিটার, পায়ে হেঁটে চার কি পাঁচ দিন লাগে। একটু দূরে সমান্তরাল মসৃণ গাড়ি চলার রাস্তা, সেখানে প্রবল জ্যাম। মরুভূমি চিরে এই ধুলোমাখা রাস্তা সারা বছর শুয়ে থাকে উপেক্ষিত হয়ে। মাথার ওপর গনগনে সূর্য। কেউ হাঁটছে একা, কেউ সপরিবার, অনেকে দল বেঁধে। অনেক দেশের জাতীয় পতাকা, সব কটা চিনি না, হিসেব গুলিয়ে গেল কত দেশের মানুষ সেটা গুনতে গিয়ে। নিজের দেশের পতাকা দেখে আমি আর ক্যামেরাম্যান মিনারুল বেশ পুলকিত। কিছুটা দূরে দূরে নম্বর লেখা খুঁটি, কেউ হারিয়ে গেলে ওই নম্বরগুলোই ভরসা। এই পদযাত্রার নামই ‘আরবাইন’, আরবি অর্থ চল্লিশতম। যুদ্ধের চল্লিশ দিন পরে কারবালার যুদ্ধবন্দি মেয়ে আর শিশুরা দামাস্কাসের জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে দেখতে এসেছিল তাদের প্রিয়জনের গোর। অর্থাৎ আমরা যে দিন মহরম পালন করতে দেখি, তার চল্লিশ দিন বাদে এই পদযাত্রার শেষ।

সূর্য ঢলে পড়ার পর শ্রান্ত পথিকেরা বসেছে মাঠে, আর নানা ভাষায় কেউ না কেউ গেয়ে চলেছে কারবালার আখ্যান। মূল গায়কের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাকিরাও গলা মেলাচ্ছে। ফারসিতেই বেশি, শুনে বোঝা যায় আমাদের কথকতার মতো একটা গল্প বলা হচ্ছে। কোথাও আরবিতে শান্ত প্রার্থনার সুর, এক জায়গায় ইংরেজিতে র‌্যাপ শুনে মোটেও পছন্দ হল না, ওরা এসেছে আমেরিকা থেকে। লেবানিজ় এক কবি খাতা দেখে পড়ছেন, ইংরেজি তরজমা নিজেই করে দিচ্ছেন মাঝে মাঝে। কান জুড়িয়ে গেল উর্দু একটা গান শুনে, অন্ধকার জেলখানায় ছোট্ট মেয়ে সাকিনার প্রার্থনা। পাকিস্তানি দলের এক মাঝবয়সি গাইছেন।

বাবা হুসেনের কাছে ছোট্ট সাকিনার নালিশ, কেন সে ওকে ওখান থেকে নিয়ে যাচ্ছে না! কেন ওর ভাইয়ের দোলনায় আগুন দিল ওরা, মাথার চাদর কেন কেড়ে নিল মায়ের, কেন নেই জল। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে বিহ্বল শ্রোতাদের। পরে জেনেছিলাম, সাকিনার চিৎকার থামাতে কারারক্ষীরা থালায় হুসেনের কাটা মাথাটা হাজির করেছিল, সাকিনার কাহিনি এখানেই শেষ, মুহূর্তে সে মিশে গিয়েছিল বাবার সঙ্গে।

সূর্য ডুবতেই ঝুপ করে নেমে এসেছে মরুভূমির ঠান্ডা। প্রমাদ গুনলাম, কিন্তু আবু মাসুমে এর মধ্যে আমাদের রাতে শোয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। বালিশ-কম্বল তো বটেই, মোবাইল আর ক্যামেরার ব্যাটারিও চার্জ দেওয়া যাবে। বিরাট এক তাঁবু, মানে ম’কেব, ভেতরে দেড়-দুশো মানুষের এলাহি ব্যবস্থা। রাস্তার ধারে এই রকম ছোট-বড় ম’কেবের সারি, পছন্দমতো কোনও একটায় ঢুকে পড়লেই হল। বাইরে এলাহি খানাপিনার ব্যবস্থা। পিনা বলতে ইরানি চা বা টার্কিশ কড়া কফি, টেবিলে জলের বোতল সাজিয়ে রাখা, তেষ্টা পেলে তুলে নাও। আর খানার লিস্টিতে কী নেই, হরেক রকমের কাবাব, মুচমুচে ভাজা মাছ, সুগন্ধি পোলাও, রুটি, সুরুয়া, কুশকুশ, ফালাফেল, দোলমা, হামাস, অপূর্ব স্বাদের মন্ডা মিঠাই থরে থরে সাজানো। তুর্কি, ইরানি, লেবানিজ়, ইরাকি, ইয়েমেনি, সব দেশের নানা পদ রান্না হচ্ছে। কোথাও বাড়ির দিদিমা, কোথাও নামী রেস্তরাঁর শেফ, সবাই ব্যস্ত। বাকিরা ব্যস্ত রাস্তা থেকে লোক ধরে এনে পাতে বসাতে।
বসতে না চাইলে হাতে প্লেট প্রায় জোর করে ধরায়। সারা দিন ধরে অনেকে মাথায় মস্ত থালা-ভর্তি খাবার সাজিয়ে বসে আছে রাস্তায়। মনের সুখে নিখরচায় রাজকীয় খাওয়া সেরে একটা চেয়ারে বসে সিগারেট ধরিয়েছি। হঠাৎ দেখি এক
সমবয়সি ভদ্রলোক এসে পা টেপাটেপি শুরু করলেন। চমকে উঠে থামাতে যেতেই তার মুখ দেখে মায়া হল। হয়তো এটাই ওঁর পুণ্য, আমার কী অধিকার সেটা কেড়ে নেওয়ার? পাশে বসা এক তরুণকে দোভাষী হিসেবে পেয়ে একটু আলাপ করার চেষ্টা করলাম। বাগদাদে ছোটখাটো ব্যবসা আছে। উনি পা টিপছেন আর এক জনের, সবার পায়ে পায়ে যিনি হেঁটে চলেছেন।

হুসেনের মুখ পতাকায় দেখতে দেখতে মুখস্থ হয়ে গেছে। তাকিয়ে ছিলাম তাঁবুর ঠিক সামনে একটা প্রায় আড়াই তলা উঁচুতে দুলতে থাকা লাল পতাকার দিকে। কারবালার রাস্তায় লাল পতাকার সারি। ওটাই হুসেনের প্রতীকী রং। এই লাল প্রতিবাদের র‌ং, না যুদ্ধের? কেনই বা সে দূর মদিনা থেকে এসেছিল কারবালায়? তারা-টিপটিপ আকাশের তলায় গল্প হচ্ছিল। অনেকের অনেক মত, এটা মেলে তো ওটা মেলে না। ফেলে-আসা কুফার কথা ফিরে এল। ইয়াজিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ কুফার মানুষ একটা চিঠি পাঠিয়ে ডেকে পাঠিয়েছিল হুসেনকে, একমাত্র সে-ই পারে বাঁচাতে। বয়োজ্যেষ্ঠরা বারণ করলেও হুসেনকে আটকানো যায়নি। আত্মীয়-পরিবার আর কিছু বন্ধুকে নিয়ে সে রওনা দিল মক্কা থেকে। খবর চাপা থাকেনি, ইয়াজিদের নির্দেশে কুফার রাজ্যপাল রাতারাতি বদলে সেখানে জারি হল কারফিউ। প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার মরুপথ পেরিয়ে হুসেন যখন কুফার দিকে এগিয়ে আসছে, বিরাট সৈন্যবাহিনী ঘিরে ধরল তার মরুযাত্রী দলকে। যুদ্ধ চাই, এখনই। হুসেনের দলে বেশির ভাগই মহিলা ও শিশু, গর্ভবতী মহিলারাও আছেন। হুসেনের শান্তিপ্রস্তাব খারিজ হল। শুধু একটা রাত পাওয়া গিয়েছিল, সে রাত কেটেছিল প্রার্থনা আর তৃষ্ণায়। পাশে বয়ে চলা ফুরাদের জল ছিল আটকানো। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কান্না সইতে না পেরে ভাই আব্বাস, যার ওপর দায়িত্ব যুদ্ধ পরিচালনার, সে গেল জল আনতে। আর ফেরেনি। ঘিরে থাকা সৈন্যবাহিনীর কাছে ছ’মাসের ছেলে আলি আসগরকে বুকে জড়িয়ে হুসেন শুধু একটু জল চেয়েছিল, উত্তর এসেছিল একটা তিরের ফলায়, নিপুণ তিরন্দাজিতে শিশুর কণ্ঠনালি ছিঁড়ে রক্ত চলকে উঠেছিল। ‘ওরা শুধু আমার রক্ত চায়, রাতের অন্ধকারে তোমরা ফিরে যাও’— কেউ ফেরেনি হুসেনের কথায়। মরুপ্রান্তরে অখ্যাত সেই জায়গার নাম কারবালা।

হুসেনের ছবি ছাড়াও চোখে পড়ে অনেক মানুষের মুখের ছবি। খুঁটিতে, তাঁবুর গায়ে, হাতে, বুকে... মুখের ছবি সর্বত্র। এক জায়গায় দেখি গণকবর সাজিয়ে তার সামনে স্ট্যান্ডে রাখা মুখের সারি। অনেকে দাঁড়িয়ে পড়ে দেখছে আর আলোচনা করছে, মুখগুলো ওদের চেনা। জিজ্ঞেস করে বুঝলাম, দায়েশ বা আইএসআইএস-এর সঙ্গে লড়তে গিয়ে এঁরা সবাই ‘শহিদ’ হয়েছেন কিছু দিন আগে। রাষ্ট্র এঁদের বাধ্য করেনি, কোনও বিদেশি শক্তি ওঁদের পয়সা জোগায়নি। শুধু কি দেশ বাঁচানোর জন্যে এই আত্মাহুতি? এর পিছনে ধর্ম কাজ করেনি? করেছিল। উত্তর পেলাম আবু মাসুমের কাছে, এই ক’দিনে আমরা বন্ধু হয়ে গেছি। শিয়া কাজিরা বলেছিল দায়েশের কোনও ধর্ম নেই, ইসলামকে ওরা অপব্যবহার করছে, মানুষকে খুন আর অত্যাচার করে ধর্ম হয় না। প্রতিবাদ করতে তাই আগ্নেয়াস্ত্র কিনে নিজেরাই এঁরা বাড়িঘর ছেড়ে গিয়েছিলেন। কারবালা আসলে একটা প্রতিবাদ, যেখানে গুমরে মরে স্বজন হারানোর যন্ত্রণা।

কারবালা নাকি আর একটু হাঁটলেই, কিন্তু কবে যে পৌঁছতে পারব তার নেই ঠিক। এত মানুষ এক জায়গায় আটকে যে এক ইঞ্চি জায়গা নেই নড়ার। মাথার ওপর হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে, জানা গেল আড়াই কোটি মানুষ হাজির হয়েছে কারবালা দর্শনে। দেড় ঘণ্টা ধস্তাধস্তির পর একটা খোলা জায়গা পাওয়া গেল, সবাই সেখানে খানিক জিরিয়ে নিতে ব্যস্ত। আমাদের সে সুযোগ নেই, কারণ দেরি করলেই হোটেল বুকিং খারিজ হয়ে যাবে। বুদ্ধি করে তাই একটা ট্যাক্সি ধরা হল, কিন্তু একটু এগিয়েই বোঝা গেল হেঁটে গেলে তাড়াতাড়ি হবে।

কারবালার কেন্দ্রে হুসেনের স্মৃতিসৌধ, সব রাস্তা এসে এখানে মেলে। মুখোমুখি দুটো আকাশছোঁয়া গম্বুজ— একটা হুসেনের সমাধি, অন্যটা ভাই আব্বাসের। মাঝখানে অনেকটা খোলা জায়গা। ভেতরে খেজুরগাছের সারি, পাশে ফোয়ারা, ঝিরঝির শব্দ হয়ে চলেছে সারা ক্ষণ। এই সৌধের আশেপাশে অনেক কবর রয়েছে, দেখে দরগা বলে মনে হয়। হুসেনের সঙ্গীরা হয়তো সেখানেই চিরবিশ্রামে শুয়ে রয়েছেন। এগুলোতে এত চাকচিক্য নেই, ভিড়ও কম। কারবালার যুদ্ধ হয়েছিল ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে, হিজরি সন ৬১। দামাস্কাসের জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে বোন জয়নাব, স্ত্রী শাহরবানু আর ছোট ছেলে জয়নাল আবেদিন যখন ফিরে এসেছিলেন, তখন হয়তো এটা ছিল আমার ছোটবেলার কাঁথির লাগোয়া বালিয়াড়ির মতো একটা ফাঁকা জায়গা। ইয়াজিদের দরবারে বিচারের নামে প্রহসনের উদ্দেশ্য ছিল মহম্মদের বংশের মেয়েদের বাঁদি করে রাখা, ছেলেরা এক এক করে মারাই গেছে। গর্জে উঠেছিলেন একা জয়নাব, তাঁর ওজস্বী যুক্তি প্রশ্ন তর্কের সামনে মাথা নোয়াতে হয় সবাইকে। সে যুগে মেয়েদের সামাজিক অবস্থান আজকের চেয়ে অনেক অনেক নীচে ছিল সন্দেহ নেই। সে কথা মানলে কারবালা উপাখ্যানে জয়নাব এক অসামান্য চরিত্র, যিনি পুরুষতান্ত্রিক হিংস্র এক শাসনব্যবস্থাকে ছুড়ে দিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জ!

হঠাৎ চোখ আটকে গেল একটা দেয়ালচিত্রে। হুসেন আর জিশু পাশাপাশি, এক দিকে ক্রুশ মাথায় গির্জা, অন্য দিকে মিনারওয়ালা মসজিদ। ওপরে আরবি আর ইংরেজিতে লেখা দৈবজ্ঞ পয়গম্বরদের নাম। আদম, নোয়া, আবেল, ইব্রাহিম, মোজেস, জিশু এবং সব শেষে মহম্মদ। আব্রাহামীয় ধর্মগুলো একই সূত্রে গাঁথা, যেন একই পরিবারের গল্প যার ছত্রে ছত্রে রক্তধারা। কোন নামে তাঁকে ডাকা হবে, নবি ঈশ্বর নাকি মানব-পুত্র, এই সব নিয়ে বিরোধ, না কি আঞ্চলিক ক্ষমতার লড়াই? রাজনীতির সঙ্গে ধর্মশাসনের ভাবনা বরাবর পশ্চিম এশিয়াকে অনন্ত কুরুক্ষেত্র করে রেখেছে। এখনও তার শেষ নেই।

ভাবতে ভাবতে বুঝলাম সেই মাহেন্দ্রক্ষণ সমাগত। নমাজ শুরু হতে দেরি নেই। সবাই চলেছে হুসেনের স্মৃতিসৌধে, আমিও ভিড়লাম। সোনায় মোড়া মিনার আর গম্বুজের মাথা থেকে সূর্যের আলো গড়িয়ে পড়ল মায়াবী অন্ধকারে। হুসেনের স্মৃতিসৌধের ভেতরে ও বাইরে, যত দূর চোখ যায় নতজানু মানুষ ছাড়া আর কিছু নেই, দৃষ্টি সবার এক দিকে। মোয়াজ্জিনের সুরেলা গলা ভেসে এল ঘড়ির কাঁটা মেনে। পরের দৃশ্যটা ভোলার নয় কোনও দিন। অনন্তের নীচে এক ব্যালে নাচ, প্রার্থনার সঙ্গে শরীরের ওঠাবসা আর ডাইনে-বাঁয়ে তাকানো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। মীর মোশারফ হোসেন উপন্যাসের নাম ‘বিষাদ সিন্ধু’ রেখেছিলেন। পরস্পরকে জড়িয়ে যে কান্না রাস্তায় নেমে দেখলাম তা মর্মান্তিক। যেন পরিবারে কোনও প্রিয়জন এখুনি মারা গেছে, এই একটু আগে।

খানিক বাদে সব শান্ত হয়ে এল, আকাশে চাঁদের রোশনি তখন জমিনের আলোর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। ভোরের আলো ফুটতেই দেখি প্রায় নির্জন কারবালা। এই প্রথম রাস্তা দেখতে পেলাম, রাত অবধি ওগুলো মানুষের মাথায় ঢাকা ছিল। সবাই ফিরে গেছে বাড়ির রাস্তায়, দু’-একটা পরিবার শুধু গুছিয়ে নিচ্ছে বাক্সপ্যাঁটরা। রাতজাগা পাখির মতো বসে আছি, হঠাৎ একটা ছোট্ট টোকা। এক বৃদ্ধ অজানা ভাষায় জানতে চাইছেন আমার পরিচয়। আফগানিস্তান শব্দটাই শুধু বুঝলাম, আমিও হেঁকে বললাম ‘হিন্দুস্থান, হিন্দুস্থান!’ সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধের চোখে আলো জ্বলে উঠল। গোল হয়ে বসা পরিবারের সবাই আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে, মায়ের নির্দেশে একটা বাচ্চা টলোমলো পায়ে সামনে এসে এগিয়ে ধরল এক টুকরো রুটি। এই সব আশ্চর্য বিস্ময় নিয়ে আমার কারবালা-কথা!

ছবি: মিনারুল মণ্ডল

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement